বৃহস্পতিবার ৯ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব

বীমা কোম্পানিগুলোতে জাল স্ট্যাম্পের ছড়াছড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ০৬ জুলাই ২০২২   |   প্রিন্ট   |   152 বার পঠিত

বীমা কোম্পানিগুলোতে জাল স্ট্যাম্পের ছড়াছড়ি

দেশের কতিপয় বীমা কোম্পানিতে নানা কৌশলে ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি না থাকায় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সহায়তায় দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক বীমা কোম্পানিতে গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্র, দলিল সম্পাদন এবং সরকারি অফিসিয়াল কাজে সুকৌশলে এগুলো ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এসব ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ ব্যবহারের ফলে সরকার প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এদিকে বীমা পলিসির ওপর প্রদেয় স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ বিধিমালা-২০০২ অনুযায়ী, কোন বীমা পলিসির উপর পলিসিভিত্তিক স্ট্যাম্প শুল্কের পরিমাণ অনধিক দুই হাজার টাকা হলে, ওই স্ট্যাম্প শুল্ক বীমা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে দুই হাজার টাকার অধিক হলে সম্পূর্ণ স্ট্যাম্প শুল্ক ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। ওই বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে, বীমাকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সংখ্যক বীমা স্ট্যাম্প ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরাসরি ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করবে। একইসঙ্গে বীমা পলিসির উপর পরিশোধকৃত স্ট্যাম্প শুল্কের পরিমাণ, বীমা শুল্ক পরিশোধকারীর নাম, ট্রেজারি চালানের নম্বর ও তারিখ, ট্রেজারি ও ব্যাংকের নাম সম্বলিত বিস্তারিত তথ্য ও বিবরণী নির্ধারিত রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করতে হবে।

কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু বীমা কোম্পানি এবং তাদের অসাধু কর্মকর্তারা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে সরাসরি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে না। এমনকি অনেক কোম্পানি যথাযথভাবে রেজিস্ট্রারও সংরক্ষণ করে না। কখনো কখনো ট্রেজারির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জাল স্ট্যাম্প কেনাবেচার ঘটনাও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বীমা কোম্পানি নানা অজুহাতে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বীমা স্ট্যাম্প না কিনে জালিয়াত সিন্ডিকেটের কাছ থেকে কমমূল্যে জাল স্ট্যাম্পও সংগ্রহ করে। এভাবে প্রতিনিয়ত সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে কিছু বীমা কোম্পানি। বীমা পলিসির উপর প্রদেয় স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ বিধিমালায় বলা আছে, বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ সংক্রান্ত ট্রেজারি চালানের সত্যায়িত কপিসহ একটি মাসিক বিবরণী পরবর্তী মাসের ২০ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর কমিশনার-উপ কর কমিশনার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠাতে হবে।

এক্ষেত্রে বেশ কিছু কোম্পানির ব্যাপক গাফিলতি রয়েছে। অনেক বীমা কোম্পানিই স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ সংক্রান্ত ট্রেজারি চালানের সত্যায়িত কপিসহ মাসিক বিবরণী সংশ্লিষ্ট কর কমিশনার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠায় না। বীমা পলিসির স্ট্যাম্প শুল্কখাতে সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে নন-লাইফ কোম্পানিগুলোর জন্য একটি নির্দেশনা জারি করে বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী স্বাক্ষরিত (নন-লাইফ ৬৫/২০১৯) এ সার্কুলারে বলা হয়, বীমা পলিসির স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ চালানে গ্রাহকের নাম, ঠিকানাসহ পলিসি নম্বর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়াও ২০ হাজার টাকার উপরে বীমা স্ট্যাম্প প্রদেয় হলে তা অন্য বীমা পলিসির সাথে একত্রিত না করে পৃথক চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে।

সার্কুলারে বলা হয়, বীমা পলিসির ওপর প্রদেয় স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ বিধিমালা-২০০২ ও অন্যান্য বিধি বিধান যথাযথভাবে পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ বিধিমালার ৩(২) অনুযায়ী পরিশোধিত চালানে বর্ণিত তথ্যসমূহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। বীমা পলিসির উপর প্রদেয় স্ট্যাম্প শুল্ক পরিশোধ বিধিমালা অনুযায়ী, বীমা অংক ন্যূনতম ৩০ হাজার টাকা হলে স্ট্যাম্প শুল্ক হবে ২৫ টাকা। ১০ হাজার টাকা হলে ৫ টাকা। এক লাখ হলে ৯৫ টাকা। ৩০ লাখ হলে ২ হাজার ৯৯৫ টাকা স্ট্যাম্প শুল্ক হবে।

স্ট্যাম্প জালিয়াতির মাধ্যমে কতিপয় বীমা কোম্পানির সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার এই প্রবণতার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জেনিথ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, এক্ষেত্রে সরকারের আরো কঠোর আইন করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা যেমন ভ্যাট-ট্যাক্স সরাসরি কেটে নেই, এখানেও সেরকম বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসতে হবে। প্রিমিয়াম থেকেই স্ট্যাম্প শুল্ক সমন্বয় করতে হবে। তখন আর জালিয়াতির মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকবে না। এক্ষেত্রে জেনিথ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স বরাবরই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরাসরি স্ট্যাম্প ক্রয় করে। আমরা সমস্ত নথি এবং চেকের ফটোকপি সংরক্ষণ করি।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব ‘জাল স্ট্যাম্প’ ধরার কোন উপায় নেই। তবে সিআইডি এবং ছাপাখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যন্ত্রপাতি এবং ক্যামিকেল ব্যবহারের মাধ্যমে আসল কিংবা জাল শনাক্ত করতে পারেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রিন্টিং প্রেসে গোপনে হাজার হাজার কোটি টাকার এসব জাল ‘রেভিনিউ স্ট্যাম্প, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ ছাপানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ওইসব প্রিন্টিং প্রেস থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সংঘবদ্ধ দালাল, প্রতারক, কতিপয় অসাধু স্ট্যাম্প ব্যবসায়ির মাধ্যমে অধিকাংশ বীমা কোম্পানির মালিক পক্ষ বাজার তুলনামূলক অনেক কম মূল্যে ওইসব জাল স্ট্যাম্প ক্রয়ের মাধমে ব্যবহার করছেন। এসব জাল স্ট্যাম্প শুধু বীমা কোম্পানিগুলোতেই নয়, উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত এবং কখনো কখনো সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যার ফলে সরকার প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে জোরালো কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। সরকারি ছাপাখানা ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে রেভিনিউ স্ট্যাম্প, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ বিক্রির তথ্যের সঙ্গে ‘বীমা কোম্পানিলোতে’ ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের তথ্য মিলালেই অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে বীমা কোম্পানিলোতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা প্রয়োজন। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি এবং হাউজিং কোম্পানির অফিসে অভিযান প্রয়োজন।

সিআইডি’র সূত্র মতে, গত ১৯ মে দুপুরে সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তারা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. বজলুর রহমান ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রাব্বানীর সহযোগিতায় সুপ্রিম কোর্টে অভিযান চালিয়ে ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করেন। ওই ৩ জন হলেন; দেলোয়ার হোসেন, মো. মনি হোসেন ও জাকির হোসেন। তাদের কাছ থেকে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ উদ্ধার করা হয়। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ সুপ্রিম কোর্টে ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’ ক্রয় এবং বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি সিআইডি কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছে। সিআইডির এক্সপার্ট দিয়ে পরীক্ষা করার পরে ধরা পড়েছে ‘জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’। সিআইডি’র পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে।
সূত্রমতে, আসল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ১০ টাকা ২০ টাকা যাই হোক তার অংশ তো কয়েক টাকা হলেও লভ্যাংশটা সরকার পাচ্ছে। কিন্তু নকল হওয়ায় ওই দামের রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ১০ টাকার স্থলে তারা ৫ থেকে ৬ টাকা বিক্রি করছে। এ জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি দফতরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মার্কেট, বিভিন্ন পোস্ট অফিস এমনকি আদালতেও। সুপ্রিম কোর্টে ফৌজদারি, সিভিলসহ বিভিন্ন শাখা মিলিয়ে সপ্তাহের ৫দিন গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার মামলা দায়ের হয়। মামলার কোর্ট ফি খাতের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এছাড়াও মামলার রায় লেখাসহ বিভিন্ন কাজে রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি জাল ধরার পর প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সবাইকে সতর্ক করেছেন।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, ২০২১ সালে ২৪ ও ২৫ জুন ডিবি পুলিশের একাধিক টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর মাতুয়াইল দক্ষিণপাড়া ও নারায়ণগঞ্জে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ২০ কোটি ২ লাখ ২৪ হাজার টাকার ১৩ লাখ ৪০ হাজার পিস জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি এবং এসব তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১১টি সিল, ২টি স্ট্যাম্প পরীক্ষার ইলেকট্রিক মেশিন, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের রশিদের কপি ৩০০ পাতা, একটি বড় প্রেস মেশিন, দুইটি কাটিং মেশিন, একটি ডাই কাটিং মেশিন, একটি পোলার পেপার কাটিং মেশিনসহ ১০০ কোটি টাকা সমপরিমাণের জাল স্ট্যাম্প তৈরির কাগজ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার ১৮টি চেকের পাতা জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন; মো. আবু ইউসুফ ওরফে পারভেজ ওরফে রানা, মো. আতিয়ার রহমান সবুজ, নাসির উদ্দিন ও নুরুল ইসলাম ওরফে সোহেল। এছাড়া সিআইডি, ডিবি পুলিশ এবং র‌্যাবের কর্মকর্তাদের পৃথক অভিযানে জাল জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি এবং এসব তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারসহ আরও বেশ জনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার নজির রয়েছে।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৯:০৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৬ জুলাই ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।