বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংকের আমানত ব্যবস্থাপনা ও করনীয়

  |   মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০   |   প্রিন্ট   |   434 বার পঠিত

ব্যাংকের আমানত ব্যবস্থাপনা ও করনীয়

বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো অনির্ধারিত সুদহারে আমানত সংগ্রহ এবং নির্ধারিত সুদহারে (নয় শতাংশ হারে) ঋণ প্রদান ও বিনিয়োগ। আমানত ও ঋণের এই অসম হারের কারণটাই হচ্ছে ব্যাংকারসহ সংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথা।
ছয় শতাংশ সুদে এখন আর কেউ ব্যাংকের কাছে আমানত রাখতে আগ্রহী হচ্ছে না। যেখানে সব শ্রেণীর আমানতকারী দশ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পেয়ে অভ্যস্ত সেখানে সে কেন পাঁচ বা সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ সুদে আমানত রাখবে? সঙ্গত কারণেই আমানতকারী ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে বেশি সুদের বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমের দিকে। তাই ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়ে চলে যাচ্ছে নতুন গন্তব্যে-সঞ্চয়পত্র (যেখানে ভারিত গড় সুদহার প্রায় এগারো শতাংশ), শেয়ার ক্রয়, সমবায় ব্যাংকের অধীন পরিচালিত বিভিন্ন উচ্চতর সুদের অবাস্তব প্রকল্প।

অর্থ যে দেশের বাইরে রিয়াল এষ্টেটসহ বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্পে পাচার হচ্ছে না তা কিন্তু বলা যাবে না। তাহলে ব্যাংক কোথায় আমানত পাবে, কিভাবে ঋণের ব্যবসা করবে? এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভবিষ্যতই বা কি? এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সমাধান আছে। নীচে বিষয়টি একটু আলোচনা করি এবং পাঠকের চিন্তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি।

এবার দেখা যাক, ব্যাংকগুলোর আমানত ও তহবিল কিভাবে ব্যবস্থিত হয়। ব্যাংকের মূল তহবিলের উৎস হলো জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ। এর বাইরের উৎসগুলো হলো উদ্যেক্তা মূলধন, কলমানি বা আন্তঃব্যাংকিং স্বল্প মেয়াদি ঋণ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে দেশি উৎসগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ ও বন্ডের মাধ্যমে মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ সংগ্রহ। যেহেতু আমানত চলে যাচ্ছে ব্যাংক থেকে উচ্চতর সুদের বিভিন্ন সঞ্চয়ী প্রকল্পে, সেহেতু এসব প্রকল্প থেকে আমানতগুলো আবার ব্যাংকিং ধারায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া হাতে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়া এখনো চালু আছে। শুধুমাত্র বর্তমান প্রক্রিয়াকে একটু ঢেলে সাজাতে হবে। এখন আসি প্রক্রিয়াটি কি?

ব্যাংক বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে, বেকারত্ব দূর হবে, শিল্পায়ন হবে, ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। সেইজন্য ব্যাংক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বলা হয়। অর্থনীতির এই হৃদপিণ্ড সচল রাখতে প্রয়োজনীয় কিছু প্রস্তাবনা রাখছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা যায় বর্তমান রেপো ও রিভার্স রেপো কার্যক্রমের সুদের হার বর্তমান হার থেকে কমপক্ষে তিন শতাংশ কমিয়ে। এতে করে বেশি সুদের সঞ্চয়পত্রের অর্থ আবার ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরে আসবে, ব্যাংকের বিনিয়োগ যোগ্য তহবিল বাড়বে এবং সরকার ঘোষিত নয় শতাংশ সুদ হার বাস্তবায়ন আরো সহজ হবে।

সমবায় ব্যাংকিংয়ের নামে মাল্টিপারপাস কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। এতে করে আমানতকারী প্রতারিত হচ্ছে। প্রতি লাখ টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকার লোভনীয় ফাঁদ কোনো অর্থনৈতিক সূত্রেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এটাই হচ্ছে অর্থনীতিতে। সমবায় ব্যাংকের নিয়ম হচ্ছে সমিতির সদস্যরা সঞ্চয় করবে এবং সঞ্চয় থেকে সদস্যদের প্রয়োজনে ঋণ দেয়া হবে। কিন্তু এখানে হচ্ছে উল্টোটা। আজকেই সদস্য বানিয়ে আজকেই বিশাল অংকের অবাস্তবায়নযোগ্য সুদে আমানত নিচ্ছে। আজকেই আবার কাউকে নতুন সদস্য বানিয়ে ঐ নতুন সদস্যের অভাবের সুযোগ নিয়ে আরো বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করছে। এতে করে আমানতকারী প্রতারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ফাঁদ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে মানুষ আরো প্রতারিত হবে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিলগুলো যৌক্তিক হারে সব ব্যাংকে আমানত হিসাবে রাখতে হবে। এতে করে অর্থ প্রবাহে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এখন দেখা যাচ্ছে সুদের হারই মুখ্য হয়ে গেছে, ব্যাংকের সামর্থ্য ও পরিশোধ সক্ষমতা অবিবেচ্য। কোন সক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাংক যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তার অপছন্দের তালিকায় থাকেন, তবে আমানত না দেয়ার জন্য যত ধরনের কাগজপত্র চেয়ে বসেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ক্যামেলস রেটিংস্। যা দেয়ার পরেও অতৃপ্ত কর্মকর্তা অপছন্দের ব্যাংকটির ছঁধষরঃধঃরাব ঔঁফমবসবহঃ এ চলে যান, যে পরীক্ষা পাস করা সব ব্যাংকের পক্ষে খুবই অসম্ভব। কিন্তু বেশি সুদের ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই যৌক্তিক বিবেচনাগুলো আসে না। এই পক্ষপাত দুষ্ট কার্যক্রম বন্ধ করে যৌক্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত সদস্য ও ব্যাংকারদের হাতে একটি বিশাল অংকের তহবিল থাকে যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা Beneficiary Owners(BO) শেয়ার কেনাবেচার জন্য ঐ হিসেবে জমা করে থাকে।

কিন্তু এই অর্থ স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা বাণিজ্যেক ব্যাংকে উচ্চতর সুদে আমানত হিসাবে রাখেন। এই আমানতগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে চলতি হিসেবে এবং বিনা সুদে রাখতে হবে। কারণ এসব তহবিল ব্যাংক সুদ আয়ের জন্য নয়, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য। যেখানে এই অর্থ বিনিয়োগ কার্যক্রমে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের কমিশন আয় রয়েছে, সেখানে উচ্চতর সুদের জন্য দরকষাকষি একেবারে অবান্তর।

দেশের উন্নয়ন গতি ধরে রাখতে হলে ব্যাংক ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হবে। ব্যাংক ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকিংকে আর্থিক খাতের মূল কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করতে হবে। তবেই ব্যাংকের আমানতের সংস্থান হবে, ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। অন্যথায় আমানত সংকটে আর্থিক পলিসি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধার সৃষ্টি হবে।

লেখক: মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সার্টিফায়েড ট্রেড স্পেশালিষ্ট এবং ব্যাংকার।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:১৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।