বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যয় সংকোচনের বহুমুখী পদক্ষেপে কতটুকু স্বস্তিতে রিজার্ভ

পান্না কুমার রায় রজত   |   বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   300 বার পঠিত

ব্যয় সংকোচনের বহুমুখী পদক্ষেপে কতটুকু স্বস্তিতে রিজার্ভ

বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর মতোই রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। অনাকাক্সিক্ষতভাবে সারা বিশ্বে তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব দেশটিতেও পড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য সহযোগীদের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য-হ্রাস, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

সম্প্রতি জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব সবকিছুর ওপর পড়বে। পরিবহণ খরচ ও পণ্যের দাম বাড়বে। সারের মূল্যও বৃদ্ধি করা হয় ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া জ¦ালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে প্রায় সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে, যার প্রভাবে খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষের সড়ক ও নৌপথে যাত্রীও পণ্য পরিবহনে এবং কৃষি, শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে। সেচে খরচ বাড়ায় শস্য ফলনের ক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয় হবে কৃষকের। জানুয়ারি ২০২১ সালে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, এই হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় দেশের দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষ আরো নিঃস্ব হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। করোনার ভয়াল থাবা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। করোনা যখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এখনো। বাংলাদেশেও এই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যেও এগিয়ে চলছে দেশের মেঘা প্রকল্পগুলোর কাজ। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে পদ্মা সেতু। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস (এসঅ্যান্ডপি) একটি প্রতিবেদনে বলেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতোই স্থিতিশীল হবে। এসঅ্যন্ডিপি গ্লোবাল রেটিং প্রতিবেদনে আরও বলেছে, চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। আগামী তিন বছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বার্ষিক গড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে আশা করা যায়।

বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ট্রাস্ট ফান্ড দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি জানিয়েছে, সব আশঙ্কা দূর করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ( ১ ডলার=৮৪ ) টাকা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের শুরুতে প্রবাসী আয় কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর অধিকতর উৎসাহ দিতে সরকার প্রণোদনার হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। আর আগস্ট মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিও কারণে আমাদের রিজার্ভ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। তবে রিজার্ভ বা বিদেশি মুদ্রা সঞ্চায়নের প্রধান উৎস হলো রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স। এই দুটো ক্ষেত্রে অবশ্য ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া লেগেছে। ফলে রিজার্ভ বাড়ার কারণে ডলারের বাজারের অস্থিরতা কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছর প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পেরিয়ে ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে দেশ। ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্টেটের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পোশাক পণ্য আমদানি ৪৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়েছে। এসময় পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৯৫৮ কোটি ডলারের পোশাক। এতে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি বাড়ে ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক পণ্যের রফতানি ৬০ দশমিক ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে ৫০১ কোটি ৯০ লাখ ৭ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের উল্লস্ফনে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে মূলত ৩৪ ক্যাটাগরির পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে সাত পণ্য থেকেই এসেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ রফতানি আয়। এককভাবে মোট রফতানি প্রায় ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যদিও আমাদের রফতানির তালিকায় সাত শতাধিক পণ্য রয়েছে । শুধু তৈরি পোশাকে বেশি নজর কেন বা একাধিক পণ্যের রফতানি করার জন্য আগ্রহী হচ্ছেন না কেন আমাদের উদ্যোক্তারা বিষয়টা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়া পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য এই সাত ধরনের পণ্যেই মূলত আটকে আছে রফতানি। সম্প্রতি, বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ পণ্যের বহুমুখীকরণের অভাব। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও দেশের রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য আসেনি। আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে পণ্য বহুমুখীকরণ সময়ের দাবি। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর পরেই আমদানি-রফতানির বড় অংশীদার চীন ও ভারত। তবে দুটি দেশেই আমদানির তুলনায় আমাদের রফতানি খুবই নগণ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের ২০২২-২৩ প্রথম মাস জুলাইয়ে রফতানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। জুলাইয়ে ৫৮৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৩৮৮ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে ১৯৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে তা ঠিক যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারে জ¦ালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়া এবং আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-জুন দেশে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৩ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ছিল সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার। এদিকে চলতি হিসাবে ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাইয়ে এই ঘাটতির ঋণাত্মক পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি ১০ লাখ ডলার।আগের অর্থবছরে একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ২৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। চলতি হিসাবে উদ্ধৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্ধৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশের কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়েছে। সামগ্রিক লেনদেনে (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮০ কোটি ডলার। দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে ৩০ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩৯ কোটি ডলারে উঠেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৪৫ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়ে ১৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এলে ডলার প্রবাহ বাড়ে। এই বিনিয়োগ আবার দুই ধরনের। একটা সম্পূর্ণ ফ্রেশ বা নতুন বিনিয়োগ অন্যটি হল পুনর্বিনিয়োগ। অর্থাৎ এদেশে যেসব বিদেশি কোম্পানি রয়েছে তাদের বিনিয়োগ বা মুনাফা বিদেশে না নিয়ে দেশেই নতুন করে বিনিয়োগ করে।

বাংলাদেশ যদি ঋণ নেয় তবে সেক্ষেত্রেও ডলার আসা বাড়বে। আমদানি বৃদ্ধির সাথে রফতানির একটি সম্পর্ক আছে। যেহেতু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক হলো প্রধান রফতানি পণ্য তাই রফতানির বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের রফতানি বৃদ্ধি পেলে আমদানিও বৃদ্ধি পায়। কাঁচামালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। তবে বর্তমানে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের ভালো বিকাশ হয়েছে। ভ্যালু অ্যাডিশনও বেড়েছে। আগে দেখা যেত সুতা ও ফেব্রিক আমদানি করা লাগত। বর্তমানে সুতা ও ফেব্রিকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকাল মার্কেট থেকে নেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অর্থবছর আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার। যেখানে পণ্য রফতানি ছিল মাত্র ৫২ বিলিয়ন ডলার। আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের তেল বা গ্যাসের প্রাচুর্য্য নেই। ফলে তেল পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গ্যাসের ভেতর অভ্যন্তরীণ গ্যাসফিল্ড বাদে এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানি করা হয়। তেলের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা হলো, আমরা ক্রুড অয়েল আমদানির পরিমাণ চাহিদার খুব অল্প অংশ। এর কারণ আমাদের দেশে রিফাইনারি মাত্র একটি ইস্টার্ন রিফাইনারি। তবে ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপের সহায়তায় এর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু ক্রুড অয়েল অয়েল বেশি পরিমাণে আমদানি করতে পারে না বাংলাদেশ, ফলে আমাদেরকে বেশি দামে রিফাইন্ড তেল আমদানি করতে হয়। এতে ডলারের খরচ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময় আমদানি বেশি রফতানি কম। ফলে ব্যালেন্স অব ট্রেড সব সময় ঋণাত্মক থাকে। আর এখানে ব্যালেন্সিংয়ে সবচেয়ে বেশি কাজে আসে রেমিট্যান্স। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঋণাত্মক হয়েছে। এই চাপ সামলাতে গিয়ে টাকার দরপতন হয়েছে রিজার্ভও কমেছে কিছুটা। আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, আগস্ট ২০২২ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ। এলসি খোলার ক্ষেত্রেও ছিল নিম্নমুখী প্রবণতা। আগস্টে এলসি পেমেন্ট হয়েছে ৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার যা আগের মাসের ৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে কম। আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৭ এপ্রিল ২০২২। শিশুখাদ্য, জ¦ালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রফতানিমুখী শিল্প এবং কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট পণ্য। আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার নূন্যতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ১০ মে ২০২২ বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করে আরেকটি সার্কুলার জারি করে এবং ওই সার্কুলারেসকল ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। ৫ জুলাই ২০২২ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরেকটি সার্কুলারে বলা হয়, সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, প্রসাধনী স্বর্ণালঙ্কার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক সামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স পানীয়সহ বেশকিছু পণ্য আমদানিতে ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা পাবেন না আমদানিকারকরা। এসব পণ্যের আমদানি বা ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে এর আগে যা ছিল ৭৫ শতাংশ।

রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয় সঙ্কোচনের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। অতিপ্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানি নির্ভরপ্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে সংকট নিরসনে ডলারের দামের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে দাম বাজারভিত্তিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি দায় পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় হিসেবে জুলাই-আগস্টের আমদানির জন্য ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে আরো ৫০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করার পর রিজার্ভের এই অবস্থান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। তবে আমদানি কমার তথ্য (আকু) বিলেও পাওয়া যাচ্ছে। গত মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোসহ এগুলো মোকাবিলা করতে হবে।আমাদের আমদানিতে আরো কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে। কারণ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের ৭৭ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় তা আমাদের আরো বৃদ্ধি করতে পারলে আমদানি ব্যয় হ্রাস করা যাবে। আর স্বস্তিতে থাকবে রিজার্ভ।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:৪৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।