শুক্রবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতীয় রুপির মূল্যহ্রাস ও বাংলাদেশী শক্তিশালী টাকা

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ২৩ মে ২০২১   |   প্রিন্ট   |   1095 বার পঠিত

ভারতীয় রুপির মূল্যহ্রাস ও বাংলাদেশী শক্তিশালী টাকা

ভারতের রুপির দরপতন হচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রার মান এখন তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়েছে। ভারতীয় মুদ্রার মান হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভালো খারাপ উভয় ধরনের প্রভাব পড়বে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে বাংলাদেশের মুদ্রার মান ভারতীয় মুদ্রা মানের সমান ছিল অর্থাৎ ভারতীয় ১০০ রুপি ভাঙ্গালে পাওয়া যেত বাংলাদেশী ১০০ টাকা। তারপর ক্রমাগত বাংলাদেশী টাকার মান পড়তে থাকে। একসময় অর্ধেকের কমে চলে এসেছিল। তবে কখনো কখনো বাণিজ্য ভারসাম্য করার জন্য টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। আবার কখনো টাকার অপচয়ন হয়েছে। বিদেশী মুদ্রার স্বয়ংক্রিয় চাহিদা জোগানের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলে দেশীয় মুদ্রার মান হ্রাস পেলে অপচয়ন হয়। অপচয়ন দেশীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে সরকার যখন ইচ্ছাকৃতভাবে রপ্তানি উৎসাহিতকরণের জন্য মুদ্রার মান হ্রাস করে তখন মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়।

ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। বাংলাদেশের টাকার পাশাপাশি মার্কিন ডলার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর বিপরীতে ও দরপতন ঘটেছে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণের মধ্যেও বাংলাদেশের মুদ্রার মান বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপরীতে স্থিতিশীল (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)। তা ছাড়া করোনার বড় ধাক্কায় উৎপাদন রপ্তানি ও ব্যবসা বাণিজ্যের কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার বিপরীতে ভারতীয় রুপির দাম কমে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচের অনেক দেশ ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিকভাবে ভ্রমনে বিধি নিষেধ আরোপ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে সংক্রমণের হার নয় বরং ‘বিচ্ছিন্ন’ ও অবরুদ্ধ করার নীতিই বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে ডলার ও টাকার বিপরীতে রুপির মান অবমূল্যায়ণ হয়েছে।

সর্বশেষ ২২ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার ভারতীয় ১ রুপির বিনিময় মূল্য বা দর ছিল বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ টাকা ১২ পয়সা, অথচ এপ্রিল মাসের শুরুতে ভারতীয় রুপির দর ছিল ১ টাকা ১৫ পয়সা। অর্থাৎ এক মাসের ও কম সময়ে ভারতীয় রুপির দর কমেছে ৩ পয়সা। অবশ্য গত বছর থেকে ভারতীয় রুপির বিপরীতে টাকা শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২০ সালের মার্চের শেষ দিকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগের দিন থেকে ভারতীয় রুপির দর ১ টাকা ১১ পয়সায় নেমে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশী ১ টাকা ১১ পয়সার সমান ভারতীয় ১ রুপি।

করোনা মহামারীর মধ্যে দেশের অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও গত মে ২০২১ সালে প্রথম ৯ দিনে দেশে রেকর্ড পরিমান রেমিট্যান্স এসেছে। এসময় প্রবাসীরা ৯১ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে গত ৩ মে ২০২১ দিন শেষে প্রথম বারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৫১০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ রিজার্ভ দিয়ে আগামী ১২ মাসের আমদানী ব্যয় মেটানো সম্ভব।
এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমে যাওয়া, গড় আয়ু বৃদ্ধি, স্যানিটাইজেশন, ক্ষুধা সূচক, নিরাপদ পানির ব্যবহার, নারীর অংশ গ্রহণসহ সামাজিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় এগিয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসে। ফলে বড় ধরণের বিপর্যয় না ঘটলে রুপিকে টপকে যাবে টাকা বলে আশা ও প্রকাশ করেন গবেষকরা।
গত অক্টোবর ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক পূর্বাভাসে জানা যায় ২০২০ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ওই পূর্বাভাসের পর ভারতের অনেক গণমাধ্যম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে সংবাদ ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে।

আইএমএফ (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক) বলা হয়, ২০২১ সালে মার্চে ভারতের অর্থবছর শেষে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাড়াঁবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থবছর শেষ হবে জুনে, মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাড়াঁবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মার্চ শেষে ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার রুপি বা ১ হাজার ৬৯৪ ডলার। অর্থাৎ আইএমএফ এর পূর্বাভাসের চেয়েও জাতীয় মাথাপিছু উৎপাদন কমেছে ভারতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন করোনার কারণে ভারতে রপ্তানি রেমিট্যান্স কমে গেছে, অন্যদিকে চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে রুপির মান অবমূল্যায়ন হয়েছে।

বাংলাদেশ ভারতে পণ্য রপ্তানির তুলনায় ভারত থেকে আমদানি করে অনেক বেশি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে মোট ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য। একই সময়ে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। এছাড়া অনেক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে কর্মরত আছেন। রুপির দ্রুত দরপতন হলে এসব ভারতীয় বাংলাদেশ থেকে ধীরগতিতে টাকা পাঠিয়ে থাকেন। ফলে টাকা রুপির দর কাছাকাছি এলে বাংলাদেশের লাভই বেশি। ভারতীয় মুদ্রার দর কমলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ চীনের পর ভারত থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমান আমদানি করে। টাকার বিপরীতে বা ডলারের বিপরীতে রুপির দর কমলে আমদানি করা পণ্যে খরচ কমবে। আবার বেশি পণ্য আমদানি হলে, পণ্য মজুদ করে রাখার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। ফলে বাড়তি আমদানি প্রবণতা অভ্যন্তরিণ উৎপাদকের জন্য নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। করোনাভাইরাসে বিপর্যয়ের মুখে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অথনীতির দেশ ভারত। দেশটিতে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ধেয়ে আসছে, তাতে ভারতীয় অর্থনীতির জন্য তৈরি হয়েছে বড় অনিশ্চয়তা। এসবের প্রভাবে দুর্বল হচ্ছে মুদ্রা।

বেনাপোল স্থলবন্দরে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ভারত থেকে ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। যা ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের তুলনায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৯ মেট্রিক টন কম। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন (তথ্য, কাষ্টমস্ হাউজ ও সিএন্ডএফ)। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন এবং ভারতে রপ্তানি হয়েছিল ৪ লাখ ১ হাজার ১৭৭ মেট্রিক টন পণ্য। ওই সময়ে আমদানি পণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানি পরিমাণ কমেছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫৯ মেট্রিক টন। আর ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৪০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। দেশে সরকার অনুমোদিত ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১২টি। এসব বন্দর থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে। বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক শহর কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে এ পথে প্রথম থেকে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি, রপ্তানি বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। আমদানি পণ্যের মধ্যে শিল্প কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস সামগ্রী, কেমিক্যাল ও খাদ্য দ্রব্য উল্লেখযোগ্য। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে পাট, পাটজাত দ্রব্য তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, জুট গার্মেন্টস ও মাছ উল্লেখযোগ্য।

মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আন্তঃ রাষ্ট্রীয় আমদানি রপ্তানি প্রতিযোগিতা বিরাজমান। যে রাষ্ট্রের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আমদানি আয়ের চেয়ে বেশি সে রাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতিতে তত প্রভাবশালী। আমদানি রপ্তানি পার্থক্যের কারণে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা দূরকরণে অনেক সময় প্রতিদ্বন্ধী রাষ্ট্রসমূহ মুদ্রার অবমূল্যায়ণের আশ্রয় নেয়। কখনো কখনো বাণিজ্য ভারসাম্য করার জন্য মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়। ভারতীয় রুপির বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণকে ভারতমূখী অর্থাৎ ভারতীয় পণ্যের প্রতি স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ করবে। সাধারণত উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎসকেন্দ্রিক কেনা কাটার পছন্দের তালিকা ওপার বাংলার কলকাতা নগরী। প্রতি বছর ঈদ, পূজা কিংবা নববর্ষকে কেন্দ্র করে প্রচুর বাংলাদেশী কলকাতা নিউ মার্কেটে পাড়ি জমান। রুপির অবমূল্যায়ণের ফলে চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণসহ নানা কাজে যারা ভারত যান তারা আগের চেয়ে কম টাকা খরচে একই সেবা পাবেন।

ভারতীয় মুদ্রা অবমূল্যায়ণের ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি আরো বাড়বে। বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু, পূর্বের চেয়ে কম টাকায় দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে সেহেতু ভারতীয় বাজার বাংলাদেশকে আকর্ষণ করবে। যে সকল উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ চাহিদা মেটাচ্ছে সে সকল পণ্য প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। তাই অভ্যন্তরিণ উৎপাদিত পণ্যের স্থানীয় বাজার নিশ্চিত করতে এবং বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ভারসাম্য ও রপ্তানি বৃদ্ধি করতে অত্যন্ত সতর্ক সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে আমি মনে করি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৩ মে ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।