শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সেবাগ্রহীতার অজ্ঞতায় টাউট-বাটপারদের ডিজিটাল দৌরাত্ম্য

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম   |   সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   228 বার পঠিত

সেবাগ্রহীতার অজ্ঞতায় টাউট-বাটপারদের ডিজিটাল দৌরাত্ম্য

করোনাকালে সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এখন ঘরবন্দি মানুষের হাতে হাতে ডিজিটাল ডিভাইস। বলা হচ্ছে, মানুষের হাতের মুঠোয় পৃথিবীটা চলে এসেছে। কিন্তু বিশ্বের মোট প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে শতাংশ মানুষ তাতে অংশগ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা নেই, সহজে জানার উপায়ও নেই। কারণ দেশে দেশে তথ্যের বিষয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপিত রয়েছে।

উন্নত বিশ^ সুকৌশলে ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জন করে তার মাধ্যমে প্রায় সবধরনের সেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে বহু আগেই। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পূর্বে স্কান্ডিনেভিয়ান কোনো দেশের অবসরপ্রাপ্ত একজন বয়স্ক অক্ষম ব্যক্তি সে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে পেনশন পেতেন, বাড়িতে একাই থাকতেন, সপ্তাহান্তে তার রেফ্রিজারেটরের দুধের বোতল, ফলমূল, রুটি না ফুরালে বাসি হয়েছে, বিধায় সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন তাজা খাবার ভরিয়ে দিয়ে যেতেন সরকারি সেবাকর্মীরা। এখনেও সেই ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। তাদের অনুকরণে অনেক ধনী দেশে এই ধরনের সেবাদান প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। আমাদের কাছে এখনো সেগুলো গল্পের মতো মনে হয়।

আমরা একবিংশ শতাব্দীর একুশ বছর পেরিয়ে সমাজের ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাহীন, ভিক্ষুক, ভাসমান মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কথা ভাবছি। যারা কোনো সরকারি চাকরি করেননি, পেনশন পান না, যাদের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়নি অথবা যাদের অনেকেই স্বাক্ষর দিতে জানেন না, শুধু টিপসই দেন, তাদের জন্য ডিজিটাল সেবা চালু হয়েছে, হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতার টাকা প্রদানের ব্যবস্থা। এটুআই সেবা পরিকল্পনার অধীনে সরকারি সাহায্য পাবার জন্য জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় আটটি উইংয়ের মাধ্যমে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক নীতি ও জনকল্যাণের নিমিত্তে বড় সুখবর।

কিন্তু সেদিন অনেক জাতীয় দৈনিকের বড় খবর ছিল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে। কোথাও লাল হেডলাইনের বিবৃতি দেখে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হয়ে গেল। লেখা হয়েছে, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর তথ্য নেই।’

একজন সেবাগ্রহীতার নিজের নামে রেজিস্ট্রিকৃত ফোন বা ডিভাইস ছাড়া ডিজিটাল সেবা চালু হয় কীভাবে? এছাড়া একই ফোন নম্বরে বহুজনের টাকা পাঠানো হয়েছে। এখন তাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের নামে টাকা দেয়া হয়েছে তারা অজ্ঞ, অশিক্ষিত ভাতাভোগী। তাদের নিজের মোবাইল ফোন নেই। যার আছে সে ঠিকমতো চালাতে জানে না, মেসেজ খুলতে জানে না, কদাচিৎ কেউ কেউ খুললেও নিজে পড়তে জানে না।

আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- অনেকের আইডি কার্ডে ভুল তথ্য রয়েছে। অনেকে নিরুদ্দেশ বা বাস্তুভিটা হারিয়ে অভিবাসন করে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করলেও সে তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি অথচ তার নামে ভাতার টাকা ছাড় করা হয়েছে।

এছাড়া নিজের ডিভাইস ব্যতিরেকে অন্যের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংসেবা অনেক অজ্ঞ সেবাগ্রহীতার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক তথ্যে জানা গেছে, ২০২৯-২০ অর্থবছরে মোবাইল ব্যাংকিংসেবা খাতে ৫ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। জিটুপি প্রকল্পের আওতায় ৭৬ লাখ মানুষের জন্য ডিজিটাল সেবা দিতে বিকাশ ও নগদ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিকাশ ২৩টি জেলায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ২২৭ জনের নামে হিসাব খোলে এবং নগদ ৩৯টি জেলায় ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮৬১ জনের নামে হিসাব খোলে। কিন্তু নগদ ৯৯ হাজার ৭৮১ জনের ডাটা খুঁজে পায়নি। এছাড়া যে ৭০ হাজার ভাতাভোগীর হদিস নেই, তাদের নামে টাকা পাঠানো হয়েছে এবং সে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

নিয়মানুযায়ী, মাসিক ৫০০ টাকা হারে বয়স্কভাতা প্রদান করে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ৫০০ টাকা হারে বিধবাভাতা প্রদান করে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ৭৫০ টাকা হারে প্রদান করে দেয়া হয়েছে মোট ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি হিসেবে ৭৫০ টাকা হারে সেবাভোগীদের দেয়া হয়েছে মোট ৯৫ কোটি টাকা।

এসব হিসাব রাখার জন্য তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। টিআইবি বলেছে, একজন ভাতাভোগীর তথ্যভাণ্ডারে নাম এন্ট্রি করতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা ঘুষ লাগে। দরিদ্র প্রতিবন্ধীর জন্য এন্ট্রি করতে লাগে ৪০০-৫০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদেরকে এই সুবর্ণ কার্ড পেতে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল পর্যবেক্ষণ (এনএসএসএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাতাগ্রহণের যোগ্য না হয়ে ভাতা নিচ্ছেন ৪৬ শতাংশ, বয়স্কভাতার শর্ত পূরণ করেননি ৫৯ শতাংশ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতায় অনিয়ম হয়েছে ২৩ শতাংশ। তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আসলে কী ঘটে চলেছে তা গভীরভাবে অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

দেশের দারিদ্র্য হ্রাস না করে দিনের পর দিন হতদরিদ্রাবস্থা জিইয়ে রাখতে এসব প্রকল্প দিয়ে উপকার কী? চাটুকার ও বাটপারদের দৌরাত্ম্যকে তো এই ডিজিটাল যুগে আর কোনোভাবে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। এদেরকে এখনই চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে না পারলে আর কখন ঠেকাবেন? পরে এরা আরো বড় হ্যাকার হয়ে ডিজিটাল গ্যাং নিয়ে অপরাধে নেমে পড়বে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৮ সাল থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে এক কোটি মানুষকে ভাতা দেয়। ২০১৮ সালে বিশ^ব্যাংকের অধীনে ক্যাশ ট্রান্সফার মডার্নাইজেশন (সিটিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু ২০২১ সালে দেখা যাচ্ছে, ৭০ হাজার সুবিধাভোগীর হদিস নেই!
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে অনেক আধুনিক সফট্ওয়্যার চালুর কথা বলা হচ্ছে। সেবাভোগীরা কি সেসব সফটওয়্যার চালাতে জানেন? তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া বা নেয়ার মতো শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা ও সামর্থ্যরে জরিপ বা যাচাই করা হয়েছে কী?

গত ১৪ জানুয়ারি ২০২১ জিটুপি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকল্পগুলো থেকে আউটপুট পাবার জন্য যেসব কাজ আগেই করা দরকার তা না করে অর্থ প্রদান করতে থাকলে সে অর্থ ভাতাভোগীর হাতে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতেও পৌঁছবে না বলে মনে হয়। এজন্য যেনতেন বা দায়সারা তালিকা তৈরি না করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিতে হবে।

ভাতাভোগীর নিজের ডিভাইস নিজে চালানোর ক্ষমতা ছাড়া ডিজিটাল সেবা অবান্তর। তা শুধু ডিজিটাল দুর্নীতির ব্যাপক ডালপালা গজাতে সাহায্য করবে। এজন্য পক্ষপাতহীন জরিপের মাধ্যমে ভাতা পেতে উপযুক্ত ও ইচ্ছুকদের নির্বাচন করে ডিজিটাল সেবাগ্রহণের দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকেই ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। অংশগ্রহণকারীরা ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে ভাতার জন্য যোগ্যতা অর্জন করবে। ভুয়া, অযোগ্য ভাতা গ্রহণেচ্ছুদের শনাক্ত করার মাধ্যমে বাদ দিতে হবে।

মোটকথা, ডিজিটাল সেবাদান প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী ডিজিটাল টাউট-বাটপারদের চরম দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। সেটা ভূমি, কোর্ট, পাসপোর্ট, ট্রান্সপোর্ট, হাসপাতাল সব জায়গায়। এসব জায়গায় ডিজিটাল চোর ঠেকাতে জাতীয় পপুলেশন ডাটা ব্যাংকের সরকারি মূল তালিকার তথ্য নিয়ে ভাতাভোগীর স্বার্থরক্ষার জন্য সুরক্ষা সফটওয়্যার বানাতে হবে এবং ‘এক্সপার্ট রি-চেকিং ও ফায়ারওয়াল’ ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হবে। এটা দিয়ে একদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও অন্যদিকে রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তির মতো ভুয়া বিষয়গুলো ঠেকানো সম্ভব। তা না হলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ডিজিটাল দুর্নীতির দৌরাত্ম্য ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।

কারণ দরিদ্র, অজ্ঞ মানুষ এসব ক্ষেত্রে সেবা পেতে গিয়ে ডিজিটাল ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়ে আরো বেশি অসহায় ও নিগৃহীত হয়ে পড়ছে। তাই নব্য ডিজিটাল ঘুষখোর, টাউট-বাটপারদেরকে নির্মূল করতে না পারলে অসংখ্য সহজ-সরল দরিদ্র ও অজ্ঞ মানুষ সব জায়গায় বাধা ও অবিচার পেতে পেতে অচিরেই ধুলোয় মিশে যেতে পারে।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:৫৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।