নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ১৬ মে ২০২০ | প্রিন্ট | 450 বার পঠিত
কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিতরণকৃত ঋণ থেকে প্রাপ্ত সুদ এবং বিভিন্ন ধরনের ফি আর কমিশন থেকে আয় বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকগুলোর। এ অবস্থায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক। যার মধ্যে রয়েছে নতুন কর্মী নিয়োগ না দেয়া, নতুন শাখা না খোলা, বিদ্যমান শাখার সংখ্যা ও পরিসর কমিয়ে আনা, স্টেশনারি ব্যয় কমানো, কর্মীদের টিএ-ডিএ বিলে কাটছাঁট, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য ইউটিলিটি বিল কমিয়ে আনা। একই সঙ্গে বিদ্যমান কর্মীদের বেতন-ভাতা কর্তন, কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও ভাবছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। ব্যয় কমানোর উদ্যোগে এগিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তবে ব্যয় সংকোচনে সবার আগে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন জরুরি বলে মনে করছেন পরিচালকরা। আর শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, কর্মীদের বেতনে হাত দেয়াটি হবে সর্বশেষ ধাপ।
ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ব্যাংকগুলোর ব্যয়ের প্রধান খাতই হলো কর্মীদের বেতন-ভাতা। দেশের মাঝারি মানের একটি বেসরকারি ব্যাংককেও মাসে ২৫-৩০ কোটি টাকা বেতন-ভাতা দিতে হয়। আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশেই ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। দেশের ব্যাংকগুলোকেও টিকে থাকতে হলে সবার আগে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমাতে হবে। অন্তত ১০ শতাংশ হলেও বেতন কমানো দরকার। ব্যাংকাররা উৎসব ভাতার বাইরেও বছরে চার-পাঁচটি বোনাস ইনসেনটিভ নেন। এ বছর থেকেই এটি বন্ধ করতে হবে। তাহলে ব্যাংকের ব্যয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে আসবে।
ব্যয়ের প্রধান খাত নিয়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটেও। দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংক হলো ব্র্যাক। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির মোট ব্যয় ছিল ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের ৪১ দশমিক ৬৯ শতাংশই ছিল কর্মীদের বেতন-ভাতায়। বছরটিতে ব্র্যাক ব্যাংক কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ পরিশোধ করেছে ৭৮৬ কোটি টাকা। এ হিসেবে প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ গড়ে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। এখন ব্যাংকটি যদি তার কর্মীদের বেতন-ভাতা ১০ শতাংশ কমায়, তাহলে বছরে সাশ্রয় হবে ৭৮ কোটি টাকা। বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমালে চলতি বছর ব্যাংকটির ১৫৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
২০১৩ সালে যাত্রা করা দেশের নতুন ব্যাংকগুলোর একটি মেঘনা ব্যাংক। ব্যালান্সশিটের আকারের দিক থেকে ব্যাংকটির অবয়ব খুব ছোট। ২০১৯ সালে মেঘনা ব্যাংকের মোট ব্যয় ছিল ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদই ৬০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকটি। এ হিসেবে মেঘনা ব্যাংকের মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ২৪ শতাংশই কর্মীদের বেতন-ভাতা খাতের।
ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি শাখায়ই বিপর্যয় নামিয়েছে মহামারী নভেল করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী চালানো তাণ্ডবের অর্থনৈতিক ক্ষত শুকাতে এক দশকও লেগে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা আঘাতের আগে থেকেই খেলাপি ঋণের ভারে বিধ্বস্ত ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। মূলধন ঘাটতি, সঞ্চিতি ঘাটতি, তারল্য সংকটসহ বহুমুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। এখন করোনা মহামারীতে ব্যাংকগুলোর এ সংকট কতটা গভীর হবে, তা নিয়েই উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা।
ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও ৩০ জুন পর্যন্ত গ্রাহকদের খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এপ্রিল ও মে মাসের ঋণের সুদও স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রফতানিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকের কমিশন আয়ও।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যয় সংকোচনে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা চাইলে এখনই কমাতে পারি এমন একটি খাত হলো কর্মীদের বেতন-ভাতা। এছাড়া স্টেশনারি ব্যয়, ইউটিলিটি ব্যয়, কর্মীদের টিএ-ডিএ, বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যয়সহ কিছু খাতের ব্যয় আমরা চাইলেই কমাতে পারি। ব্যয় সংকোচনের জন্য কর্মীদের বেতনে হাত দেয়াটি হলো সর্বশেষ ধাপ। আপাতত আমরা অন্য ব্যয়গুলো কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি।
নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন খাত। এয়ারলাইনস, ব্যাংকসহ যেসব খাতে বেতন-ভাতা বেশি, সেসব খাতে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশে কাঠামোগতভাবেই বেতন-ভাতা সবচেয়ে বেশি, এমন খাতগুলোর একটি ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ নির্বাহীসহ কর্মীদের বেতন-ভাতা ও ইনসেনটিভ বোনাস নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই পরিচালকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। এ নিয়ে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বিভিন্ন সময় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। যদিও কর্মীদের বেতন-ভাতা ও বোনাস কমানোর বিষয়ে বরাবরই বিরোধিতা করেছেন শীর্ষ নির্বাহীরা।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০ জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে। এ সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবিও উঠেছে। এরই মধ্যে এপ্রিল ও মে মাসের সব ঋণের সুদ স্থগিত করা হয়েছে। তার মানে, ব্যাংকে টাকা আসার পথ প্রায় বন্ধ। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে অনেক ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হতে পারে। তখন কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেক কর্মীকে দিয়ে দ্বিগুণ কাজ করানোর নীতি নিয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার শীর্ষ নির্বাহী মো. আরফান আলী। তার মতে, অস্তিত্ব টিকাতে হলে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। আবার কোনো সিদ্ধান্তই যাতে অমানবিক পর্যায়ে চলে না যায়, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা অফিস ব্যবস্থাপনার খরচগুলো কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কর্মীদের প্রতি আমার বার্তা হলো পরিশ্রমী হও। আগের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করো। তাহলে অল্প কর্মী দিয়ে আমরা কাজ করতে পারব।
ব্যয় সংকোচনে কম কর্মী দিয়ে বেশি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে এনআরবি ব্যাংকও। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের ব্যাংক থেকে যেসব কর্মী অন্য ব্যাংকে চলে গেছেন, তাদের স্থলে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিদ্যমান কর্মী দিয়েই শাখার কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যয় কমাতে অপেক্ষাকৃত কম মুনাফা হয়, এমন শাখায় কাটছাঁট করা হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্রেডিট কার্ডসহ রিটেইল সেবাগুলোতে ধস নামবে। ফলে ব্যাংকগুলোর রিটেইল বিভাগে কাজ করা কর্মীদের ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভালো কর্মীদের বেতন কমলে তারা নিরুৎসাহিত হবে বলে মনে করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী। তার মতে, দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ কর্মী পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজন, যারা তদবিরে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব কর্মী ব্যাংকের খুব বেশি কাজে আসে না। ব্যাংকের ২০ শতাংশ কর্মীই ৮০ শতাংশ কাজ করেন। শুধু নন-পারফরমার কর্মীদের বেতন-ভাতাও কমানো সম্ভব হবে না, কারণ তাদের জন্য তদবির আসবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ব্যয় সংকোচনের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয় কমাতে এসব ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ব্যাংকের ব্যয় কমাতে কর্মীদের টিএ-ডিএ বিল, ভ্রমণ ভাতা, বিদেশে প্রশিক্ষণ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন করে শাখা খোলার বিষয়েও আমরা মিতব্যয়ী হব। কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর বিষয়টি সরকারের হাতে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কিছু করার নেই।
Posted ৯:১১ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৬ মে ২০২০
bankbimaarthonity.com | saed khan