
কামারুন-নাহার-মুকুল | সোমবার, ১৩ মে ২০২৪ | প্রিন্ট | 286 বার পঠিত
বাংলাদেশের বীমার ইতিহাসে খোদা বক্স এক অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব। যিনি জীবন বীমার আইকন ও জাদুকর হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশÑএই তিন আমলেই তিনি জীবন বীমা খাতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৪ সালের ১৩ মে ৬২ বছর বয়সে ইহজগত ছেড়ে চলে গেলেও তার আদর্শে অনুপ্রাণিতদের পথচলা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকা এবং খোদা বক্স মেমোরিয়ার ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশন যৌথ উদ্যোগে খোদা বক্স এর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার দুটো গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, জীবনী আলোচনা এবং সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে। সেখানে বাংলাদেশের বীমা খাতের বরেণ্য এবং অনুপ্রাণিত ব্যক্তিবগের্র উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। হুইল চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থায় এগিয়ে এসেছিলেন সানলাইফ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস আর খান। এ ছাড়াও আরো অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এলেন, যাদের চলার সহায়ক বন্ধু লাঠিকে ভর করে। সেদিন এ দৃশ্য দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোকরাই যে কেবল এই স্বপ্নের সওদাগর খোদা বক্সকে চেনেন তা নয়, চোখে না দেখলেও নামে চেনেন অনেকেই এই শিল্পের প্রতীককে। উপস্থিত অনেকের বক্তব্যে ফুটে ওঠে এই প্রথিতযশা, খ্যাতিমান ও স্বনামধন্য বীমাবিদ খোদা বক্স নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অসংখ্য কর্মকান্ড, অসাধারণ দূরদর্শিতা, দুর্দমনীয় মনোভাব, মানবদরদী, নির্লোভ, নীরব-বিল্পবী আত্মচেতনার কথা প্রকাশ পায়। খোদা বক্স এর কিছু কিছু উক্তিও প্রকাশ পায় তাদের বক্তব্যে। খোদা বক্স বলতেন, ‘বাঙালিরা কারো কদর বোঝে, সে ব্যক্তি মরে যাবার পরÑবেঁচে থাকতে নয়।’ আবার ‘বাঙালি কেউ উপরে উঠলে বড় হলে নাম করলে তাকে নিচে টেনে আনবে, প্রয়োজনে পা ধরে।’
খোদা বক্স ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। মজবুত স্টীলের মতোই এই ব্যক্তিত্ব নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল, অনড়- ঠিক যেন খাপখোলা তলোয়ার যা ভাঙে কিন্তু মচকায় না। তাঁর মতোই তাঁর ইংরেজি বলা ছিল স্মার্ট। তিনি চমৎকার ইংরেজি ও বাংলা লিখতে এবং পড়তে পারতেন। তিনি সহজ শব্দ ব্যবহার করতেন। ছিলেন তিনি অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি, তবে পড়াশুনার তেমন সময় ছিল না তার। শয়নে-স্বপনে শুধু বীমার চিন্তা। বাংলাদেশে বীমা সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শীর্ষ ব্যক্তি। কোন রকম বিলম্ব ছাড়া বীমা গ্রহীতার দাবি পরিশোধ করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। একজন বীমা গ্রহীতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেলে তার ডেথ সার্টিফিকেট বের হবার আগে বীমা দাবির চেকটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা নিতেন।
খোদা বক্স বৃহত্তর ফরিদপুরের অন্তর্গত বর্তমান শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যায় ১৯১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ ভাই আর এক বোনের মধ্যে ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তার বাবা মরহুম মৌলভী সোনাবুদ্দিন হাওলাদার এবং মাতা মরহুম আর্জুতা খাতুন। ছোটবেলায় খেলাধুলা ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়ালেও খুব ধর্মভীরু ছিলেন। আজান দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কথা বলতেন দ্রুত এবং তার চলাফেরাও ছিল অত্যন্ত দ্রুত। ছিল তার কেতা দুরস্ত পোষাক পরিচ্ছদ। ছোটবেলায় রসগোল্লা, সন্দেশ, লুচি, আলুর দম, দই খেতে খুব পছন্দ করতেন। গ্রামের স্কুলেই তার শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯২৯ সালে কোনেশ্বর গ্রামের শ্যামচরণ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩১ সালে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েড পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে দু’বছর অধ্যয়ন করেন। স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে ঐ কলেজেই তিনি খন্ডকালীন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে ৬ মাস কাজ করেন।
তিনি ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বৃহৎ বীমা প্রতিষ্ঠান কলকাতার ওরিয়েন্টাল গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বীমাকে পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। চ্যালেঞ্জিং মনোভাব এবং মানসিকতার কারণেই তিনি বীমা পেশাকে গ্রহণ করেছিলেন। জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন; বীমা পেশাকে চাকরি হিসেবে নেন নি। এজন্যই তাঁকে বীমা শিল্পের ‘জায়ান্ট’ বলা হতো। অথচ তখনকার দিনে জীবন বীমাকে মোটেও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো না। সবার ধারণা ছিল,“যার নেই কোনো গতি সেই করে এজেন্সিগিরি”। এই মানসিকতা তিনি দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জীবন বীমার প্রচলন, প্রসারসহ বীমা সম্পর্কে সচেতনতা ও জনগণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির পথিকৃৎ ছিলেন খোদা বক্স। এজন্য তাঁকে এদেশের জীবন বীমার জনক বলা যায়।
মানুষের মন জয় করার ব্যাপারে খোদা বক্স ছিলেন মাস্টার। ছোট খাটো অবয়বের এ মানুষটির অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল। দেখতে বেশ ছোটখাট কিন্তু বেশভূষা এবং চালচলনে অত্যন্ত পরিপাটি, চটপটে ও দৃষ্টি আকর্ষক একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিটি কর্মদিবসের সূচনা হতো ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে। বীমা পেশা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে হিন্দুদের মধ্য থেকে বেশি ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে তিনি নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষকে উৎসাহিত, প্রভাবিত এবং জয় করার প্রকৃতিপ্রদত্ত এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। তাঁর সেন্স অব হিউমার ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং অতুলনীয়। স্বভাবসুলভ অমায়িক ব্যবহার, চমৎকার বাচনভঙ্গি ও সুন্দরভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে অপরের মন জয় করার অব্যর্থ কৌশল গুণটিও তাঁর মধ্যে ছিল। এ মানুষের গুণটি তিনি বীমা পেশায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বীমা ব্যক্তিত্ব। আজীবন বীমা পেশা ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। জীবনের সামগ্রিক কুশলতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন, ‘বীমা একটি পেশা’। ‘বীমা পেশা’ একটি মহৎ ও সেবামূলক পেশা। যে পেশা বেকারত্বের মুক্তির পথ দেখায়। সে পেশায় দক্ষতার স্ফুরণ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার আহ্বান জানান তিনি।
খোদা বক্স ১৯৪৬ সালে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসে ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্সুরেন্স কোম্পানির (ইফু) পূর্ব পাকিস্তান শাখায় লাইফ ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি ‘ইফু’র গোটা পাকিস্তানের লাইফ সেকশনের লাইফ ম্যানেজার, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও জেনারেল ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে ‘ইফু’ থেকে অব্যাহতি নিয়ে নতুন প্রত্যয়ে ফেডারেল লাইফ অ্যান্ড জেনারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তা ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ‘ইফু’র পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের কাছে। আর পরবর্তিতে বীমা পেশা থেকে তাঁর পদত্যাগটাও ছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। ষাটের দশকের শেষ দিকে বিপদের সম্ভাবনা থাকা সত্বেও খোদা বক্স অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ‘ইফু’র পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান কার্যালয় ঢাকা অফিসের বিভিন্ন কাগজপত্র ও ফরম সমূহে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাঙালির পুণর্জাগরণ ও অথনৈতিক উন্নয়নের পটভূমি সৃষ্টিতে তিনি যে পন্থা নির্ধারণ করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নে যে সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সে সাহসের কাহিনী বাঙালির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি এ দেশের জীবন বীমাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে গেছেন। জীবন বীমা ভবনের প্লটটা তাঁরই নির্বাচন। যে জীবন বীমা ভবনটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেটি ইফু অবনের কিছুটা পরিবর্তিত নকশায় খোদা বক্স এর স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তখন হকিতে পাকিস্তানের খুব নাম। তাই ভবনের নকসাটিও করা হয় হকি স্টিক আর বলের অনুকরণে। টাওয়ারটা হলো বল, নিচের দিকটা স্টিক।
বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালে সকল বীমা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করে জীবন বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বীমা শিল্পে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে সরকার খোদা বক্সকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করেন।
নীতিগত কারণে তিনি ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর দীর্ঘ কর্মময় বীমা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার সময় বলেছিলেন, “সারা জীবন ইন্সুরেন্সের কাজ করে আজকে আমাকে এভাবে চলে যেতে হলো।”
প্রকৃতপক্ষে এ দেশে বীমা ব্যবসায় তিনিই ছিলেন প্রাণপুরুষ। দীর্ঘ কর্মজীবনের মধ্যবয়সে এসেও বহুবিধ কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি অতিসাধারণের মাঝে মিশে যেতেন। সাধারণ আয়ের মানুষকেও প্রাত্যাহিক জীবনে সঞ্চয়ী হতে পরামর্শ এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনে উৎসাহ দিতেন।
খোদা বক্স এর জনসংযোগের পরিধি ছিল ব্যাপক এবং বিশাল। সমাজের সকল মহলে ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। সমাজের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য অনেক করেছেন। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিকে কাজে সম্পৃক্ত করেছেন; প্রচুর মানুষকে চাকরি দিয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করে গেছেন। বেকার মানুষকে ধরে এনে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টার্ন ফেডারেল অফিসে কর্মরতদের অধিকাংশই ছিলেন ফরিদপুরের। এভাবে সম্পৃক্ত করা না হলে বহু লোক, বহু সংসার বিলীন হয়ে যেতো। মানুষকে বড় করে তোলা, সামাজিক করার বিষয়ে তিনি ছিলেন অনেক দায়িত্ববান। তাঁর সকল কর্মকান্ড আর চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ। “মানুষ মানুষের জন্য ”- এ মানবিক সত্যের অনুসারী ছিলেন তিনি।
Posted ৩:৩৩ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৩ মে ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy