বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মরণ

খোদা বকস ছিলেন বীমাশিল্পের পথিকৃৎ

এম. হারুনুর রশিদ   |   সোমবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১   |   প্রিন্ট   |   1807 বার পঠিত

খোদা বকস ছিলেন বীমাশিল্পের পথিকৃৎ

আজ ১ ফেব্রুয়ারি, বীমাশিল্পের পথিকৃৎ খোদা বকসের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী। বাঙালি মুসলমানদের ক্রান্তিলগ্নে খোদা বকস কর্মজীবন শুরু করেন। ওই সময় মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায়, শিল্প-বাণিজ্যে অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগই চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতো। সে সময়ে জমিদারি প্রথা চালু ছিল, কিন্তু দু-চারজন ছাড়া অধিকাংশ জমিদার ছিলেন হিন্দু। শিল্প-বাণিজ্যে হিন্দুরা প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ওইসব প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের স্থান হতো না। ফলে শিক্ষিত মুসলমান যুবকরা বেশিরভাগই সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করতো। অতি সামান্য সংখ্যক লোকই অন্যত্র চাকরি-বাকরির জন্য বা প্রাইভেট তথা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ফার্মে অথবা শিক্ষকতায় চাকরির জন্য চেষ্টা করতো।

খোদা বকস ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়া মুসলমানদের জন্য তখন অত্যন্ত কঠিন ছিল। সে সময়ে অর্থাৎ ত্রিশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজ সমগ্র ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। সেই কলেজে ভর্তি হতে পারা অত্যন্ত কঠিন বিষয় ছিল। খোদা বকস সে কলেজ থেকে লেখাপড়া করে (বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেননি অসুস্থতার কারণে) সেই কলেজেই কিছুকাল গ্রন্থাগারিকের কাজ করেন এবং পরবর্তীতে ওরিয়েন্টাল গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি লাইফ অ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে এজেন্ট হিসেবে যোগ দেন। যদিও তিনি সরকারি ভালো চাকরি পেতে পারতেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু কেন যে তিনি সরকারি চাকরির দিকে মনোনিবেশ না করে প্রাইভেট এবং চ্যালেঞ্জিং পেশা গ্রহণ করলেন সেটা আজও আমি বুঝতে পারি না। সম্ভবত তাঁর চ্যালেঞ্জিং মনোভাব এবং মানসিকতার কারণেই তিনি বীমা পেশা গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৫২ সালে তিনি যখন ঢাকায় ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে (EFU) যোগদান করেন, তখন আমি সেই কোম্পানির একজন সিনিয়র অফিসার ছিলাম। আমাদের সঙ্গে উনি তাঁর অতীত কর্মজীবনের কথা আলাপ করতেন। প্রায়শ তিনি আতাহার আলী নামে জনৈক নামকরা জাদরেল বীমা ব্যবসায়ীর কথা আলোচনা করতেন। আতাহার আলী সাহেব সারা ভারতে একজন নেতৃস্থানীয় বীমাকর্মী ছিলেন। খোদা বকস বলতেন যে, আতাহার আলীর কাছ থেকেই তিনি বীমা পেশায় আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। আতাহার আলী বরিশালের লোক ছিলেন এবং কলকাতায় বীমা ব্যবসা করতেন।

তদুপরি সে সময়ে আরেকজন অত্যন্ত শীর্ষস্থানীয় বীমাবিদ ছিলেন। তাঁর নাম সৈয়দ শমসের আলী। এটা খুব সম্ভব চল্লিশ দশকের এ-প্রান্তে বা ও-প্রান্তের কথা। তখন মুসলমানরা সবে জেগে উঠেছে। তখন মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তদানীন্তন ইউনাইটেড বেঙ্গলে। একসময় ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং কিছুকালের জন্য তিনি শিক্ষা দফতরের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তখন ফজলুল হক মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা এবং চাকরি-বাকরির জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। বাঙালি মুসলমানদের একটা স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সত্যি বলতে গেলে বাঙালি মুসলমানরা আজ যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার জন্য সর্বপ্রথম ফজলুল হকের অবদানের কথা না বললেই নয়।

ঠিক সে যুগেই খোদা বকসের কর্মজীবন শুরু। একথা বলতে দ্বিধা নেই সারা দেশে জীবন বীমা করার মতো বিত্তবান বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা খুব অল্প ছিল। ইন্স্যুরেন্স করার মতো লোক প্রায় পাওয়াই যেতো না। তার প্রথম কারণ হলো আর্থিকভাবে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা। দ্বিতীয় কারণ ছিল মুসলিম মৌলবাদ সবসময় জীবন বীমা বা বীমাপত্র কেনাকে অনৈসলামিক বলে প্রচার করতো। এর ফলে বীমা ব্যবসা করা মুসলমানদের জন্য খুব কঠিন ছিল। এরকম অবস্থায় খোদা বকস জীবন বীমা পেশা গ্রহণ করেছিলেন। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল।

খোদা বকস প্রথমে ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির বীমা কোম্পানি ওরিয়েন্টাল গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি লাইফ অ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে কর্মজীবন শুরু করেন মাঠকর্মী হিসেবে। আগেই বলেছি তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যদিও তাঁর মক্কেল সম্পর্কে আমার জানার কথা নয়, তবু আমি মনে করি হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে হিন্দুদের মধ্য থেকে বেশি ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে তিনি নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠা করেন। এজন মুসলমান হিসেবে এভাবে ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করা অত্যন্ত কুশলী কাজ ছিল বলে আমার ধারণা।

এটা খুব সত্য যে, দেশবিভাগের আগেই খোদা বকস কলকাতায় প্রথম শ্রেণির বীমাকর্মী হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন। এ কথা তদানীন্তন পাকিস্তান বা অন্যত্রও যথেষ্ট প্রচারিত হয়েছিল।

১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে মাত্র তিনটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ছিল মুসলমান মালিকানায় :

১. Eastern Federal Union Insurance Company Limited (EFU), যার প্রতিষ্ঠা ১৯৩২ সালে, কলকাতায়।
২. Muslim Insurance Company, যার প্রতিষ্ঠা ১৯৩৪ সালে লাহোরে এবং
৩. পরবর্তী সময়ে হাবিব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি চল্লিশের দশকে বোম্বাই (বর্তমান মোম্বাই) শহরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

EFU-এর প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতায়। পাকিস্তান হওয়ার আগেই হাবিব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং EFU পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয় কাগজকলমে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত EFU-এর প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতা শহরে। অবশ্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে EFU দুটো শাখা অফিস খুলেছিল ঢাকা এবং চট্টগ্রামে। উল্লেখ্য, ভারত বিভাগের পূর্বভাগে EFU তার রেজিস্টার্ড অফিস চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

হাবিব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পূর্ব পাকিস্তানে নামমাত্র দু-চারজন চিফ এজেন্ট বা কমিশনভিত্তিক বীমাকর্মী রেখেছিল। অন্যদিকে মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দু-তিনটি শাখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, কিন্তু ওই কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। ফলে কর্মীদের পুরোপুরিভাবে চালানোর মতো বেতন শাখা ম্যানেজার দিতে পারতো না।

কিন্তু EFU আর্থিকভাবে অত্যন্ত সচ্ছল ছিল বলে শাখা অফিস এবং কর্মী ধরে রাখতে পেরেছিল। উপরন্তু নামকরা বীমাকর্মীদের বেতনভুক্ত চাকরি দেওয়ার জন্য EFU কর্তৃপক্ষ তৈরি থাকতো। ঠিক সে সময় থেকেই EFU খোদা বকসকে নেবার জন্য সচেষ্ট হয়।

১৯৫২ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত EFU যেহেতু অবাঙালির প্রতিষ্ঠান ছিল ম্যানেজাররাও অবাঙালি ছিলেন। জামাল উদ্দীন নামে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি ভদ্রলোক পূর্ব পাকিস্তানের সিনিয়র লাইফ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকা অফিসে যোগ দেন এবং দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫২ সালের ৮ জানুয়ারি মারা যান। ফলে EFU-এর ঢাকা অফিসে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তেমন অবস্থায় EFU কর্তৃপক্ষ কলকাতায় খোদা বকসের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে করাচি ডেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন চাকরি বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য, তখন তিনি ওরিয়েন্টালের ইন্সপেক্টর পদে দায়িত্বরত। সমস্ত সিদ্ধান্ত করাচিতে হয় এবং ১৯৫২ সালের ২ জুলাই খোদা বকস EFU-এর Life Manager পদে পূর্ব পাকিস্তান শাখায় যোগ দেন। [এই সময়ের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে Wolfram W. Karnowski লিখিত ‘ The EFU Saga’ গ্রন্থের ‘ Khuda Buksh : Life Insurance was his mission’ অধ্যায়ে]।

ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক) দক্ষিণ পাশে জনসন রোডে EFU-এর অফিসে খোদা বকস যেদিন যোগ দেন, আমি অসুস্থ ছিলাম বলে সেদিন অফিসে যেতে পারিনি। কিন্তু জানতে পেরেছিলাম তিনি যেদিন যোগদান করেন, সেদিন থেকে অফিস এবং মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল।

একটা কথা বলতে চাই যে, যেহেতু সে সময়ে বীমা করার লোকের সংখ্যা সীমিত ছিল, মুসলমানদের আর্থিক, সামাজিক অবস্থা খারাপ ছিল, বীমাবিরোধী মৌলবাদী প্রচারণা ছিল, সে কারণে এজেন্ট বা চিফ এজেন্টরা ভালো ব্যবসা আনতে পারতো না এবং তাদের বেতনও ঠিকমতো দেওয়া হতো না। অনেকেই কিছুদিন চাকরি করে নিরাশ হয়ে পেশা ত্যাগ করে চলে যেতো। কিন্তু খোদা বকস EFU-এর লাইফ ম্যানেজার পদে যোগ দিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে এক নতুন ব্যবস্থা চালু করলেন। তিনি শিক্ষিত যুবকদের উৎসাহ দিতে লাগলেন বীমা পেশায় যোগদানের জন্য এবং তাদেরকে রীতিমতো বেতনভিত্তিক নিয়োগপত্র দিলেন। যেহেতু নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থা ছিল, সবাই নিরাপত্তা অনুভব করেছিল। অন্যদিকে তিনি কর্মীদের নিয়ে রীতিমতো ক্লাসের ব্যবস্থা করলেন- কীভাবে বীমা করতে মানুষকে উৎসাহিত করতে হয়, কীভাবে অফিস চালাতে হয় ইত্যাদি। ব্যবসা হোক আর না হোক, সব কর্মীর বেতন পদ্ধতি চালু করেন। এ ব্যবস্থা বীমাশিল্পের পদ্ধতি হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একক ছিল- আর কেউ এটা করতো না। ফলে শিক্ষিতরা বীমা পেশায় উদ্বুদ্ধ হতেন।

জীবন বীমা পেশায় যেসব কর্মীকে তিনি নিয়োগ দান করতেন তারা যেন পেশা ছেড়ে না দেয় বা অন্য কোম্পানিতে চলে না যায়, সেজন্য তিনি সবসময় চেষ্টা করতেন। এ রকম অনেক ঘটনার আমি সাক্ষী। তারই দুটি বলছি : কোম্পানি ছেড়ে কেউ চলে গেলেও তিনি তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। মনে পড়ে ১৯৬১ সালে আমি ইস্টার্ন ফেডারেল ছেড়ে খাইবার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করি। এটা ছিল জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। একসময় আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তাদের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসেবে আমাকে চায়। একসময় আমি খাইবার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে আমার পদত্যাগপত্র দিই।

তখন খোদা বকস করাচি ছিলেন। তিনি বিষয়টা জানতে পেরে সেখান থেকে আমাকে টেলিফোন করে বলেন, “You must not leave Khyber Insurance Company and you must not join ALICO.” Because ALICO was his rival. He did not want me to join ALICO. And I did not join ALICO

একবার EFU-এর একজন সিনিয়র বীমাবিদ অন্য কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন। এ সংবাদ তাঁর কানে যায়। তিনি পরদিন বেলা ওঠার আগেই সেই কর্মীর বাসায় গিয়ে হাজির। কর্মীটি ঘর থেকে বাইরে যাবেন, তাকিয়ে দেখেন খোদা বকস দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তখন খোদা বকস তাকে গাড়িতে করে অফিসে নিয়ে এলেন এবং কোনোমতেই তিনি যেন অন্য কোম্পানিতে যোগদান না করেন, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।

বীমা পলিসি ছোট হোক বা বড় হোক, ক্লায়েন্টের আর্থিক সঙ্গতি কম বা বেশি থাকুক তিনি এজেন্ট বা চিফ এজেন্টের সাথে ক্লায়েন্টের বাড়ি চলে যেতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ রকম অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। প্রসঙ্গত আমি এখানে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি : পঞ্চাশের দশকে ঢাকাতে তিনি গেন্ডারিয়া এলাকায় থাকতেন। একদিন বিকেলে আমি একজন ক্লায়েন্টকে নিয়ে তাঁর বাসার নিকট তাঁর বন্ধু ডা. এম. এ. ওয়াহেদের চেম্বারে (যা ছিল রাস্তা-লাগোয়া) মেডিকেল পরীক্ষার জন্য গেলাম। তিনি স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে করে ওই পথে যাওয়ার সময় দেখলেন আমি একজন ক্লায়েন্টকে নিয়ে ডাক্তারখানায় বসে আছি। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি বাসায় গিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের রেখে আমার ওখানে চলে এলেন। ক্লায়েন্টের ডাক্তারি পরীক্ষা হওয়ার পর তিনি তাকে এবং আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি তাকে ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা-অসুবিধা বিষয়ে বললেন। আমি তাঁর এই ধৈর্য দেখে মনে মনে হাসছিলাম। আমি আমার জীবনে এর পূর্বে আর কাউকে এতো ধৈর্য সহকারে ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে বলতে শুনিনি।

তিনি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন- সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি বলে কোনো জিনিস তাঁর ছিল না। যাকে বলে কাজপাগল মানুষ- তিনি তা-ই ছিলেন। ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একজন সিনিয়র সেক্রেটারির সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। তাঁর মিন্টো রোডের বাসায় খোদা বক্সকে আমার নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তখন রোজার মাস ছিল। সেদিন সকালে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। ভাবতে লাগলাম মেডিকেল পরীক্ষার জন্য ডাক্তার এবং খোদা বকসকে সঙ্গে নিয়ে কি করে ক্লায়েন্টের বাসায় যাবো। হঠাৎ দেখি বৃষ্টির মধ্যেও খোদা বকস গাড়ি নিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির। আমি ভীষণ অবাক হলাম। তারপর তিনি আমাদেরকে নিয়ে মিন্টো রোডের সেই সচিবের বাসায় গেলেন। তাঁর কথায় সচিব মুগ্ধ হলেন এবং বেশ বড় অঙ্কের একটা ব্যবসা হয়েছিল সেদিন।

কর্মীদের প্রতি তিনি যেমন অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, তেমনিভাবে দয়াশীলও ছিলেন। এমনও অনেক ঘটনা ঘটেছে টাকা আত্মসাৎ করার পর কোন কর্মীকে তিনি বরখাস্ত করলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে সহকর্মীরা তাঁর কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে বললো, লোকটার পরিবার না খেয়ে মরবে এটা করলে। তিনি তৎক্ষণাৎ আবার তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনলেন। এগুলো মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার পরিচয় বহন করে। স্টাফদের প্রতি তাঁর যে রকম সহমর্মিতা ছিল এ রকম খুব কমই দেখা যায়।

খোদা বকস ইফুতে আসার পূর্বে করাচি থেকে পলিসি ইস্যু হতো। সঙ্গত কারণেই এতে যথেষ্ট সময় ব্যয় হতো। এটা এড়াবার জন্য খোদা বকস পলিসি রিনিউয়াল, প্রিমিয়াম সংগ্রহ সবকিছু যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হতে পারে সেজন্য লোকবল বৃদ্ধি করলেন এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব ব্যবস্থা করলেন। এটা তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতার পরিচায়ক। কেননা এর ফলে একদিকে বীমা ব্যবসা যেমন বৃদ্ধি পেতে লাগলো, অন্যদিকে চাকরি-বাকরির সুযোগ সৃষ্টি হলো। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় এটা এক নতুন মাত্রা যোগ করলো। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে করাচিতে ডেকে নেওয়া হয় এবং প্রথমে EFU-এর গোটা পাকিস্তানের লাইফ সেকশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এবং পরে জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কাজে তাঁকে গোটা পাকিস্তান ঘুরতে হতো।

১৯৬০ দশকের শেষের দিকে (১৯৬৭ সালে) তিনি ব্যক্তিগত কারণে EFU থেকে অবসর নেন এবং ফেডারেল লাইফ অ্যান্ড জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর স্বভাবতই বীমা ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। সমস্ত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণ করা হয় এবং একটা জাতীয় বীমা করপোরেশন গঠন করা হয়। এর অধীনে চারটি বীমা প্রতিষ্ঠান ছিল- সুরমা, রূপসা, কর্ণফুলী এবং তিস্তা।

১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে জাতীয় নির্বাচনের পর আবু হেনা কামরুজ্জামান বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং কিছুদিনের মধ্যে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করেন। এ সময় একমাত্র জীবন বীমা করপোরেশন এবং একমাত্র সাধারণ বীমা করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার খোদা বক্সকে জীবন বীমা করপোরেশনের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত করেন। তিনি এ কোম্পানি চালু রাখার জন্য এবং সচ্ছল রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং এ পর্যায়ে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

সম্ভবত ২৭ নভেম্বর, ১৯৭৩ সালে তিনি বীমা পেশা থেকে জীবনের জন্য অব্যাহতি নেন। তবে যেভাবে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তা তাঁর জন্য মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর দেশে একটা এলোমেলো অবস্থার সৃষ্টি হয়। বীমা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন তাঁর কাছে নানান অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া পেশ করতে থাকে। একজন নীতিনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে সেসব দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং সঙ্গত কারণেই তিনি নতি স্বীকার করেননি। তেমন অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো। তাঁর অফিসে যাওয়া রীতিমতো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। এ রকম পরিস্থিতিতে মঈদুল ইসলাম করাচি থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং তাঁকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে খোদা বক্সকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখানে একটা কথা বলা দরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল যে হুট করে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমার সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সময় তাড়াহুড়োর পর্যায়ে পড়তো।

তিনি যখন অব্যাহতি নেন, আমি তখন জীবন বীমার জেনারেল ম্যানেজার। আমি প্রথমে জীবন বীমাতে ছিলাম, পরে জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের জেনারেল ম্যানেজার পদে যোগ দিই। জীবন বীমাতে থাকাকালে মাঝখানে আমার সাথে তাঁর সম্পর্কের একটু অবনতি, পরে আবার সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তিনি পছন্দ করে আমাকে জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের জেনারেল ম্যানেজার থেকে এনে জীবন বীমার জেনারেল ম্যানেজার করেছিলেন। যেদিন তিনি অব্যাহতি নেন, সেদিন আমিও ছিলাম। মঈদুল ইসলামকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘সারাজীবন ইন্স্যুরেন্সে কাজ করে আজকে আমাকে এভাবে চলে যেতে হলো।’ আমার কাছে খুব বেদনাদায়ক ছিল বিষয়টা।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খোদা বকসের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই জীবন বীমাশিল্প বাংলাদেশে অকল্পনীয় উন্নতি সাধন করেছে। তিনি ছাড়া জীবন বীমাশিল্প উন্নতির এ পর্যায়ে আসতে পারতো বলে আমি মনে করি না।

Facebook Comments Box
বিষয় :
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:২১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।