শুক্রবার ১৪ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

ব্যয় বহনে অসমর্থ : মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা

  |   বুধবার, ০২ জানুয়ারি ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   880 বার পঠিত

ব্যয় বহনে অসমর্থ : মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা

১৬ বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন গেন্ডারিয়ার ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান (৫৭)। দুই বছর ধরে চলছে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস। ব্যয় নির্বাহে জমানো টাকা আগেই শেষ হয়েছে। অসুস্থতার কারণে ব্যবসাও নেই। গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রির টাকায় এখন স্বামীর চিকিৎসা ব্যয় ও সংসার চালাতে হচ্ছে আবদুল মান্নানের স্ত্রী নার্গিস জাহানকে। শেষ সম্বলটুকু দিয়ে কতদিন স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।

আবদুল মান্নানের চিকিৎসা বন্ধের পথে থাকলেও অর্থাভাবে কিশোরগঞ্জের মিজান উদ্দিনের (৫৫) চিকিৎসা প্রায় থেমেই গেছে। দুটি কিডনিই নষ্ট মিজান উদ্দিন শুরুতে শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে দুদিন ডায়ালিসিস করাতেন। প্রতিবার খরচ হতো ৩ হাজার ৬০০ টাকা। অনেক চেষ্টার পর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে ডায়ালিসিসের সুযোগ পান। যদিও সরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে দুদিন ডায়ালিসিস চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্যও নেই মিজান উদ্দিনের।

তাদের মতোই কিডনি রোগীদের বড় অংশকে ব্যয় বহনে অক্ষমতার কারণে মাঝপথে চিকিৎসা থামিয়ে দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ডায়ালিসিস শুরুর ছয় মাসের মধ্যে অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে ৭৫ শতাংশ রোগী। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ম. মহিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ১২-১৪ শতাংশ রোগী কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভোগে। কিডনি বিকল হয়ে গেলে ডায়ালিসিস অথবা প্রতিস্থাপন করতে হয়। দুটো প্রক্রিয়াই ব্যয়বহুল। বেশকিছু গবেষণা করে আমরা দেখেছি, খুব কমসংখ্যক কিডনি রোগীরই চিকিৎসা ব্যয় বহনের সামর্থ্য আছে। বেসরকারি পর্যায়ে সপ্তাহে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ করে ডায়ালিসিস করাতে পারে না বেশির ভাগই। এমন অনেক রোগীও আছে, যাদের সরকারি পর্যায়ে সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা ব্যয় বহনের সক্ষমতাও নেই। সে কারণে ডায়ালিসিস শুরু করলেও ৭৫ শতাংশ রোগীই মাঝপথে ছেড়ে দেয়। চিকিৎসা না করে দুর্বিষহ জীবন যাপন করে তারা।

তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। বছরে মারা যায় প্রায় ৩০ লাখ কিডনি রোগী। ডায়ালিসিস ও কিডনি সংযোজনের অভাবই এ মৃত্যুর প্রধান কারণ।

জানা গেছে, দেশে কিডনি রোগী বাড়লেও চিকিৎসা সহজলভ্য নয়। গ্রাম পর্যায়ে এ রোগের চিকিৎসা এখনো পৌঁছেনি। আইনি জটিলতার পাশাপাশি কিডনিদাতা না পাওয়ার কারণে দেশে এখনো কিডনি প্রতিস্থাপনের হার খুবই কম। এছাড়া সব প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ও না। হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হয়, তাতে একেকটি কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে ২ লাখ ৬০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার মতো। এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে রয়েছে দাতার কাছ থেকে কিডনি কেনার খরচও। এ কারণে কিডনি বিকল হয়ে পড়লে একমাত্র ভরসা ডায়ালিসিস। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ডায়ালিসিসের ব্যয় অনেক বেশি। এক্ষেত্রে একজন রোগীর প্রতিবার ডায়ালিসিসে ব্যয় হয় ৩ হাজার টাকার বেশি। তিনবার করে ডায়ালিসিস ও ওষুধের ব্যয় মিলিয়ে প্রত্যেক রোগীর পেছনে সপ্তাহে ব্যয় হয় ১২-১৫ হাজার টাকার মতো। সরকারি পর্যায়ে ৪০০ টাকায় ডায়ালিসিসের সুযোগ থাকলেও মেশিন সংকটের কারণে এ সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। ফলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চব্যয়ে ডায়ালিসিস করাতে বাধ্য হচ্ছে তারা। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় সেটিও বন্ধ অথবা অনিয়মিত হয়ে যায় মাঝপথেই।

রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন মনিপুরিপাড়ার বাসিন্দা মমতাজ বেগম (৪৮)। চার বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন তিনি। অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়েছেন। সপ্তাহে তিনদিন রাজধানীর কিডনি ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ডায়ালিসিস করান। প্রতিবার খরচ হয় ২ হাজার ৩৫০ টাকা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হলেও সন্তানদের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ মিটিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন মমতাজ বেগমের স্বামী। অর্থাভাবে কখনো সপ্তাহে একদিন, কখনো আবার দুদিন ডায়ালিসিস করান মমতাজ বেগম। মাঝেমধ্যে আবার দু-তিন সপ্তাহ ধরেও ডায়ালিসিস বন্ধ রাখতে হয়।

মমতাজ বেগম বলেন, টানা কয়েক সপ্তাহ ডায়ালিসিস করাতে না পারলে শরীরে পানি জমে যায়। চলাফেরা করতে পারি না। তখন ধারদেনা করে আবার ডায়ালিসিস করাই। এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না।

ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনিতে প্রদাহ, ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, খুব বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, কবিরাজি ওষুধ সেবন, দূষিত পানি পান ও খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে কিডনি রোগ হয়। কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, কিডনি রোগের সঙ্গে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং দুই কোটি মানুষ উচ্চরক্তচাপে ভুগছে। তাই ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা ও সচেতনতা জরুরি। দেশে কিডনি রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই। তাই চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে অনেকেই। সারা দেশে কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ১৪০ জন। বেশি বেশি কিডনি বিশেষজ্ঞ তৈরি করলে মানুষের দোরগোড়ায় কিডনি চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব।

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দেশের ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, যেগুলোয় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে। এসব লোকের রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে কিনা, প্রস্রাবের সঙ্গে মাইক্রো অ্যালবুমিন বা অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা, এসব তথ্য যদি জানা যায়, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ শনাক্ত করা যায়। এরপর যথাযথ চিকিৎসা দিলে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কিডনির দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি। পাশাপাশি বেশি বেশি নার্স, প্যারামেডিকস ও কিডনি বিশেষজ্ঞ তৈরির উদ্যোগ নেয়াটাও জরুরি।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ম. মহিবুর রহমানের অভিমত, কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকেও কিডনি রোগের চিকিৎসার সুযোগ থাকলে রোগ পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সহজ হবে। পাশাপাশি কম খরচে কিডনি চিকিৎসার সুযোগ তৈরিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Facebook Comments Box
top-1

Posted ৭:০৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০২ জানুয়ারি ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।