বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বি.জে জিও টেক্সটাইলের অগ্নি-দুর্ঘটনার তিন বছর, এখনো হয়নি দাবি নিষ্পত্তি

ইস্টার্ন ও নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্সের কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ সামগ্রিক বীমাখাত

এস জেড ইসলাম   |   রবিবার, ২৯ আগস্ট ২০২১   |   প্রিন্ট   |   884 বার পঠিত

ইস্টার্ন ও নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্সের কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ সামগ্রিক বীমাখাত

প্রায় তিন বছর আগের কথা। ৩ জুলাই ২০১৮ তারিখে এক ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাংলাদেশি তৈরি পোশাক কারখানা ব্যাং জিন (বি.জে) জিও টেক্সটাইল লিমিটেড। দুর্ঘটনায় প্রায় সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। উৎপাদিত পণ্য, উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল এবং মেশিনারিজ। এমনকি কংক্রিটের তৈরি স্থাপনাগুলোও এ থেকে রেহাই পায়নি। ফলে হঠাৎই স্থবির হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। মুনাফায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ এমন অবস্থায় পতিত হওয়ায় গভীর হতাশায় ডুবে যায় কারখানার মালিকপক্ষ। কিন্তু হতাশার গহীন অন্ধকারের মাঝে আশার আলো জোগায় দুর্ঘটনার বেশ কিছুকাল আগে করা অগ্নি-বীমা পলিসি। কিন্তু সেই আশার মুখেও যেন ছাই ঢেলে দিলো বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স ও নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। প্রায় তিন বছর অতিক্রম করলেও এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে পাওনা দাবির প্রায় ৮০ শতাংশই বকেয়া। ফলে উৎপাদন না থাকায় এবং ক্রমাগত ব্যাংক লোনের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুব্ধ গ্রাহক দুষছেন সার্বিক বীমাখাতকে। এমনকি এ নিয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় জানিয়েছেন অভিযোগ। এমনটাই জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

জানা যায়, দুর্ঘটনার প্রায় তিন মাসে আগে ৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের সাথে অগ্নি-বীমা চুক্তি করে বি.জে জিও টেক্সটাইল কর্তৃপক্ষ। যার পলিসি নং-EIC/HAT/FP-0013/04/2018, EIC/HAT/FP-0014/04/2018 Ges EIC/HAT/FP-0015/04/2018 অবশ্য এই বীমা পলিসিতে কো-ইন্স্যুরার হিসেবে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সও ছিল। তবে প্রধান ভূমিকায় ছিল ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স।

দুর্ঘটনার পরপরই দুই বীমা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দি ইঞ্জিনিয়ার্স সার্ভেয়ার ও মিডল্যান্ড সার্ভে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দায়িত্ব দেয়। জরিপকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম শেষ করে উভয় প্রতিষ্ঠানকেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রদান করে। এতে দেখা যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও দাবি নিষ্পত্তি করছে না ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স ও নর্দার্ন কোম্পানি। অভিযোগ উঠেছে টালবাহানার। অনেক তাগাদার পর কিছুদিন পূর্বে দুই ধাপে দুই কোটি টাকা দিয়েছে। এ টাকা দিয়ে ব্যাংকের সুদ দিবে, নাকি কারখানা ফের উৎপাদন উপযোগী করবে অথবা বিদেশ থেকে কাঁচামাল কিনবে? ফলে পুরো টাকা না পাওয়া পর্যন্ত ফের পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারছে না গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটি। বেকার হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক। বকেয়া প্রায় ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা কবে পরিশোধ করা হবে তাও নিশ্চিত নয়। এমন প্রেক্ষাপটে পুরো বীমাখাত নিয়েই সমালোচনা তৈরি হচ্ছে দেশের শিল্পখাতে। এমনটা ঘটলে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটা বীমাশিল্পের অগ্রগতির অন্তরায়।

এদিকে বকেয়া না প্রদান না করায় বিষয়ে বীমা কোম্পানি থেকে বলা হচ্ছে- সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) ক্লিয়ারেন্সের কথা। অথচ এসবিসি বলছে ভিন্ন কথা। তারা জানিয়েছে, ‘কোনো গ্রাহক দুর্ঘটনায় পতিত হলে প্রথমে বীমা কোম্পানিকেই এর দায় নিয়ে গ্রাহক দাবি পরিশোধ করতে হয়। পরবর্তীতে এসবিসির অংশ বীমা কোম্পানিকে প্রদান করা হয়। কেননা দায় গ্রহণ করা বীমা কোম্পানি কার সাথে কো-ইন্স্যুরেন্স করছে এটা গ্রাহকের জন্য প্রয়োজন নয়। এটা বীমা কোম্পানির নিজস্ব ব্যাপার। এ জন্য গ্রাহক দুর্ভোগের শিকার হতে পারেন না।’

এ বিষয়ে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বি.জে জিও টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী জানান, ‘আমাদের প্রকৃত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু সার্ভে কোম্পানি বীমা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করায় এই ক্ষতিকে মাত্র ৯ কোটি টাকা দেখিয়েছে। তিন বছরে সেই টাকা দিতে পারেনি কোম্পানি। এমনকি যোগাযোগও করছে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আসলে ইন্স্যুরেন্স মানেই হলো বাটপারি। নেবার বেলায় আছে, কিন্তু দেবার বেলায় নেই।’ নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স দাবি পরিশোধের বিষয়ে কী বলেছে জানতে চাইলে বলেন, “তারা বলছে যেহেতু ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স লিডার, তাই যা করার তারাই পদক্ষেপ নেবে। আর ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স বলছে সাধারণ বীমা ক্লিয়ারেন্স দিলে তারা বাকি টাকা পরিশোধ করবে। আমি বুঝি না সাধারণ বীমার লেনদেনের সাথে আমাদের কেন সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এটা তাদের বিষয় তারা বুঝবে। আমাদের ক্ষতির টাকা আমাদের দিবে, সাধারণ বীমা কথা কেন শুনাবে?”

এমন প্রেক্ষাপটে বীমা সংশ্লিষ্টরা জানান, বীমা আইনে দাবি প্রদানে সকল কাগজপত্র জমা দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে। এটা পরিপালন না করায় বীমাখাত ও বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ ও বীমাগ্রাহকদের অনাস্থা তৈরি হবে। আইনের এমন লঙ্ঘনে জড়িতের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় না আনলে এরাই বীমাখাতকে ডুবানোর জন্য যথেষ্ট। তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করায় আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহককে প্রচলিত ব্যাংক সুদের চেয়েও ৫ শতাংশ বেশি হারে প্রতি মাসে প্রদান করতে হবে। প্রতি মাসে যার পরিমাণ কোটি টাকার ওপরে। সে হিসাবে তিন বছরে সুদই দিতে হবে ৩০ কোটি টাকার বেশি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণসহ প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এতে আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে কোম্পানির। যার সম্পূর্ণ দায় কোম্পানির ওপরেই বর্তাবে। যদি সময়মতো দাবি পরিশোধ করতেন তাহলে এই কন্টিনজেন্ট লায়াবিলিটি অ্যারাইজড হতো না।

এদিকে গত ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের অগ্নিবীমার অনিষ্পত্তিকৃত দাবি নিরীক্ষা করে দেখা যায়, বি.জে জিও টেক্সটাইল অনিষ্পন্ন দাবির তালিকার ৩৯ ক্রমিকে অবস্থান করছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিকে বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে ১৫ কোটি টাকা, যা গ্রাহকের বলার চেয়েও বেশি। ফলে সুদ প্রদানের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪০ কোটি টাকা এবং দাবিসহ যার পরিমাণ হবে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া পলিসিটি দাবি পরিশোধ না করার কারণ হিসেবে চূড়ান্ত সার্ভে রিপোর্ট না পাওয়ার ব্যাপারে জানিয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে জানা যায়। সার্ভে কোম্পানি ও বীমাগ্রাহক জানায় অনেক আগেই চূড়ান্ত সার্ভে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোম্পানির ওয়েবসাইটে উল্লিখিত তথ্য সত্য নয়। এমন মিথ্যা ঘোষণা প্রমাণিত হলে তা বীমা আইন অনুযায়ী, শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও মনে করছেন বীমা বিশ্লেষকরা।

নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্সের সাথে কথা বললে সিইও আবদুল হক জানান, “যেহেতু মাদার পলিসি হয়েছে, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের সাথে তাই এটা তারাই ভালো বলতে পারবে।” কিন্তু কো-ইন্স্যুরার হিসেবে দুর্নামের ভাগি তো আপনাদেরও হতে হচ্ছে, এমনটা বললে- তিনি এখন মিটিংয়ে আছেন, এর বেশি বলতে পারবেন না বলে ফোন কেটে দেন।

অন্যকে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের সিইও হারুন পাটোয়ারির জানান, মূলত সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে রি-ইন্স্যুরেন্সের টাকা না পাওয়ায় গ্রাহককে দাবি প্রদানে বিলম্ব হচ্ছে। ওটা যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি গ্রাহককে প্রদান করা সম্ভব হবে। কিন্তু পুনঃবীমা কর্তৃক টাকা প্রদানে বিলম্ব হলে গ্রাহক দেরিতে দাবি পাবেনÑএমনটা কী আইনে বলা আছে? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা। আবার কোম্পানির ওয়েবসাইটে সার্ভে প্রতিবেদন না পাওয়ায় বিষয়ে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে গ্রাহক ও সার্ভে প্রতিষ্ঠান, এমনটা জানালে তারও কোনো উত্তর দেননি সিইও হারুন পাটোয়ারি। বরং প্রতিবেদকে তার সাথে দেখা করতে বলেন।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৯ আগস্ট ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।