
হেলাল সাজওয়াল | সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট | 51 বার পঠিত
সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে অন্ধকারে রেখে; সহযোগী নন-লিস্টেড কোম্পানির শ্রমিকদের দেখিয়ে কাগজ কলমে বিএসইসিকে হিসাব দেখাচ্ছে বস্ত্র খাতের কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডস্ট্রিজ লিমিটেড। খোঁজখবর রাখেন এমন বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, অলটেক্স এর একাধিক সিস্টার কোম্পানি একই বাউন্ডারিতে থাকায় বন্ধ কারখানাকে চালু বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, অলটেক্স এখন একটি কাগুজে কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ এখন ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। কোম্পানিটি ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ৩০ বছর পর কোম্পানিটি এখন শীর্ষ ঋণখেলাপির তকমা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপি যেসব কোম্পানির তালিকা করা হয়েছে সে তালিকার শীর্ষে রয়েছে অলটেক্স এর নাম। বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় সুদ মওকুফ ও ঋণ পুনঃতফশিল করার সুবিধা নিয়েও কোম্পানিটি লোকসান থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। জানা গেছে, সোনালি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির প্রথম দিকেই রয়েছে অলটেক্স এর নাম। সোনালি ব্যাংকেই কোম্পানিটির ঋণ রয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
সর্বশেষ অর্থবছরে (৩০ জুন’২০২৪) কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা; সম্পদের চেয়ে দায় বা ঋণ বেশি। হিসাব আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। কোম্পানির ব্যবসায় আর্থিক সংকট; সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন সংক্রান্ত সমস্যা, ডেফার্ড ট্যাক্স অ্যাসেট সংক্রান্ত অসঙ্গতি; কর্মচারী কল্যাণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) ও অন্যান্য দায় সংক্রান্ত সমস্যা; আর্থিক দায় ও ব্যয়ের অসঙ্গতি; পণ্য সরবরাহের দায় ও সন্দেহজনক লেনদেন; মজুদ পণ্যের হিসাব ও নিরীক্ষা প্রতিবন্ধকতা; লভ্যাংশ প্রদানের আইন লঙ্ঘন ও পরিচালকরা নগদ লেনদেনের মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করেছে। কোম্পানিটির সমাপ্ত অর্থবছরের (৩০ জুন’২০২৪) অডিট রিপোর্ট বা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাববছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা দিয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন, ২০২৪ হিসাববছরে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ০.০১ টাকা। আগের হিসাববছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২.৭০ টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৯.৯২ টাকা। প্রতিবেদনে, সমাপ্ত বছরে কোম্পানির মোট রেভিনিউ ৩৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ফেব্রিক্স বিক্রি থেকে ৩০ কোটি ৬৫ লাখ এবং প্রিন্টিং চার্জ হিসেবে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে কস্ট অব সোল্ড দেখানো হয়েছে ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এদিকে কোম্পানির ইনভেন্টরিজের অবস্থাও খুব নাজুক। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা ২০২৪ সালে এসে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০২৩-২০২৪ সালে ক্যাশ রিসিভ ছিল ৪৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর বছর শেষে কোম্পানিটির ক্যাশ জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এখন ঋণে জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ না দেওয়ায় লেনদেন হচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বার্ষিক সাধারণ সভা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এছাড়া, সম্পদের চেয়ে দায় বেশি থাকায় এ কোম্পানিকে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়।
জানা গেছে, অতিরিক্ত ঋণে জর্জরিত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এ কোম্পানিকে ২০২১ সালে ১০ বছরের জন্য ভাড়া নেয় চীনা কোম্পানি হুয়াক্সিন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তবে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করেননি। অলটেক্স এর কোম্পানি সচিব মো. জিয়াউল হক বলেন, অলটেক্স গ্রুপের কোন সিস্টার কোম্পানি হয়তো ভাড়া হতে পারে, অলটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ কখনো ভাড়া দেওয়া হয়নি। আমাদের কোম্পানি চলমান আছে। তিনি বলেন, গত ১৫ ডিসেম্বর আমাদের কোম্পানি গ্রাউন্ডে এজিএম অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। সবাই দেখেছে আমাদের কোম্পানি চলছে। এখনও আমাদের কোম্পানি চলমান আছে।
জানা গেছে, কোম্পানিটি একাধিকবার উৎপাদন শুরু করার তথ্য প্রকাশ করলেও পুনরায় তা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফায় ২০২০ সালের ২ নভেম্বর থেকে ৪৫ দিন কোম্পানিটির কারখানা বন্ধ থাকে। এরপর গত ২০ ডিসেম্বর থেকে আরও ১ মাস কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটি পুনরায় উৎপাদনে ফিরে।
প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে থাকলেও ২০১৬ ও ২০২২ সালে এটি যথাক্রমে ৪.০ শতাংশ ও ১.০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩৩৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান দাাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ৪৬৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এতে দেখা যায় কোম্পানিটির সম্পদ অপেক্ষো দায় অনেক বেশি। এদিকে পুঁজিবাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সার্বিক বিষয় তদন্ত করেছে বিএসইসি। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল হক, সহকারী পরিচালক মাহমুদুর রহমান এবং মো. মাহমুদুল হাসানকে নিয়ে একটি কমিটি সম্প্রতি তদন্ত শেষ করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মো. জিয়াউল হক বলেছেন, ‘‘আমরা বিএসইসির তদন্তে সহযোগিতা করেছি, তারা তদন্ত করে গেছেন। তবে কি রিপোর্ট দিয়েছেন তা এখনো আমরা জানি না। খেলাপি ঋণের বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, ব্যাংক থেকে আমরা কোন চিঠি এখনও পাইনি তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।’’
চীনা কোম্পানির নিকট ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, অলটেক্স গ্রুপের অন্যকোন কোম্পানি ভাড়া দেওয়া হতে পারে। সেগুলি নন-লিস্টেড আমি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব। অলটেক্স কখনো ভাড়া দেওয়া হয় না।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ঋণে জর্জরিত কোম্পানিটি ভবিষ্যতে ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবে কি-না তা যাচাই করতে কিছু বিষয় বিশেষ করে সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন তথ্য সমূহ যাচাই করা হয়েছে। তবে তদন্ত শেষে কমিটি কি রিপোর্ট দিয়েছে তা জানা যায়নি। এ ব্যাপারে জানতে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালামকে ফোন করলে তার ফোন বন্ধ ছিল। তদন্ত কমিটির সদস্য মাহহমুদুল হাসানকে ফোন করলে তিনি বলেন, “আমি এখন একটা মিটিংয়ে আছি পরে কথা বলবো।”
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তাদের সম্পদ পুনর্মূল্যায়নের তথ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই-সিএসই) ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছে। নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান এ কাশেম অ্যান্ড কোং অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ভূমি ও ভূমি উন্নয়ন পুনর্মূল্যায়ন করেছে। তাতে কোম্পানিটির জমি সংক্রান্ত সম্পদমূল্য ১৩৭ কোটি ৩৯ লাখ ৭ হাজার ৭৩ টাকা থেকে বেড়ে ২১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ পুনর্মূল্যায়নের পর কোম্পানিটির সম্পদমূল্য বেড়েছে ৮১ কোটি ৪২ লাখ ৯২ হাজার ৯২৭ টাকা। বেড়ে যাওয়া সম্পদমূল্য অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের নিট অ্যাসেট ভ্যালুতে (এনএভি) যুক্ত হবে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অলটেক্স-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দেখিয়ে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধোঁকা দিচ্ছে। অলটেক্স গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছেÑ অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, অলটেক্স স্পিনিং, অলটেক্স ফেব্রিক্স, অলটেক্স ওয়েভিং, অলটেক্স ডাইং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিং লিমিটেড। টেক্সটাইল রিলেটেড প্রতিষ্ঠানগুলো একসাথে হওয়ার কারণে বুঝা কঠিন কোন প্রতিষ্ঠান চালু আছে এবং কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কর্তৃপক্ষ সেই কুমিরের বাচ্চার গল্পের মত কোম্পানি পরিচালনা করছেন।
অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ মূলত রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান ছিল। হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিতে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ বেশ কয়েকবার রপ্তানির জন্য ট্রফি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি মাত্র চার থেকে পাঁচবার নামমাত্র লভ্যাংশ দিয়েছে।
অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ডাইরেক্টর ফাইন্যান্স আব্দুল মান্নান চৌধুরি দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতিকে বলেন, আমাদের কত টাকা ঋণ আছে কিংবা আমাদের কোম্পানির দায় কত? সম্পদ কত? সব কিছুই এজিএম এ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রকাশ করা হয়। সেখানে শেয়ারহোল্ডাররাও উপস্থিত থাকেন। তাছাড়া আমাদের এজিএম কারখানা গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়। আমরা দায়বদ্ধ; আমাদের লুকোচুরি করার কোন সুযোগ নেই।
কারখানার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও বিএসইসির হাই পাওয়ারফুল কমিটি এসে তদন্ত করে গেছে। আমরা বন্ধ কারখানাকে চালু বলবো এটা সম্ভব না। তারা সবাইতো শিশু বাচ্চা না; যে তাদেরকে কলা হাতে দিয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে দিবো।
Posted ৪:১৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy