রবিবার ১৬ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

ঝুঁকির মুখে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা

আদম মালেক   |   রবিবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২১   |   প্রিন্ট   |   3247 বার পঠিত

ঝুঁকির মুখে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতার অভাব। আয় কম করে কোনো খাতে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রদর্শন আবার আয় বেশি করেও কম দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এরকম প্রতারণার পাশাপাশি নানা অনিয়ম দুর্নীতির উপসর্গ রয়েছে ব্যাংকটিতে। যেমন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানতের ওপর জোর না দিয়ে ক্রমেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ বেড়েছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের। এতে বেড়েছে তহবিল খরচ, গুনতে হবে ভর্তুকি। ব্যাংকটির কিছু আমানত আটকে আছে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। এ আমানত সেখান থেকে ফিরে আসবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ অনেকের। ক্রমবর্ধমান কুঋণ উদ্ধারের কোনো পরিকল্পনা নেই ব্যাংকটির। খেলাপির দায় এড়াতে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে মন্দ ঋণ অশ্রেণিকৃত করলেও সে ঋণের কোনো মানোন্নয়ন হয়নি। ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিশোধিত মুলধন প্লেসমেন্টে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এজন্য প্রিমিয়াম নেয়া হলেও তা হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি। এজন্য আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন অনেক শেয়ারহোল্ডার।

বিনিয়োগকারী গোলাম ফারুক বলেন, ব্যাংকটির অবস্থা দুর্বল। আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করেনি। বার্ষিক প্রতিবেদনে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে। ব্যংকটিতে বাড়ছে খেলাপিসহ অবলোপনকৃত ঋণের বোঝা। নিয়মিত কর পরিশোধ না করে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে আয় হিসেবে প্রদর্শন করছে। আবার প্রতিষ্ঠানটির সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে বিশাল বিনিয়োগের বিপরীতে অল্প আয় দেখায়, যা সন্দেহজনক। এজন্য আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এজন্য তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

শেয়ারহোল্ডারদের অভিযোগ, ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরিতে মানা হয়নি ইন্টারন্যাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোটিং স্ট্যান্ডার্ড। যেততেনভাবে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে ক্ষুণ্ন হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ। এড়িয়ে যাওয়া হয় উদ্যোক্তা পরিচালকসহ ব্যাংকটির শীর্ষ ব্যবস্থপনা কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অনিয়মদুষ্ট লেনদেন। উল্লেখ করা হয়নি বিনিয়োগকারীদে স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা প্রশ্নের জবাব।

ব্যাংকটির ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিনিয়োগকারীরা বলেন, বার্ষিক প্রতিবেদনে ৮৫৩ কোটি টাকার মার্জিন ঋণ দেখানো হলেও শেয়ারের ক্রয় মূল্য বিক্রয় মূল্য আন-রিয়ালাইজড লস ও ক্যাপিটাল ইরোশন রহস্যজনক কারণেই গোপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ট্যাক্স প্রভিশনের ক্রমবর্ধমান ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। অথচ এ পুঞ্জীভূত ঘাটতির পরিমাণ শেয়ারহোল্ডারদের অজানা।

শেয়ারহোল্ডারা বলেন, ২০১৯ সালে ব্যাংকটিতে আমানত বেড়েছে ৩ হাজার ১০৪ কোটি টাকা আর বিনিয়োগ বেড়েছে ২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগ আমানতের ৮৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এরপরও অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণ ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৬০২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গ্রাহকের কাছ থেকে আমানতে জোর না দিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধারের প্রবণতায় প্রশ্ন তুলছেন বিনিয়োগকারীরা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিনিয়োগের বিপরীতে আয় ৩৯০ কোটি টাকা, যার প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির তুলনায় আয়ের প্রবৃদ্ধি সন্দেহজনক বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রদর্শিত আয়ে ব্যাংকটির সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখা দাবি করেন বিনিয়োগকারীরা। এখানে তহবিল ব্যায় ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর ওপর কঠোরতা আরোপ করে সেখানে এ বাড়তি তহবিল খরচ ব্যাংকটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যাংকটির ১৬ কোটি ২১ লাখ টাকা আমানত আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে। এ আমানত কখনো ফেরত আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শেয়ারহোল্ডাররা। ২০১৯ সালে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সময় নতুন করে অবলোপন হয়েছে ৫৯ কোটি টাকা। এতো অবলোপকৃত ঋণের বোঝা বেড়ে ৮৪৬ কোটি টাকা হয়েছে। তবে অবলোপনকৃত ৮৪৬ কোটি টাকাসহ মোট ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার খেলাপি উদ্ধারে কোনো তৎপরতা না থাকায় হতাশ বিনিয়োগকারীরা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের আনুকূল্যে মন্দ ৯৭৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে অশ্রেণিকৃত করে স্পেশাল মানি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এ ঋণের কোনো মানোন্নয়ন হয়নি। বরং এ ঋণ ভালো ঋণকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর এতে সংখ্যা লঘু শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ হানি হবে বলে তারা মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেসের পরিশোধিত মূলধন ৪শ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫৮ কোটি টাকা ৫৮ জনের মধ্যে আইপিওতে আসার প্রলোভনে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এমনকি এখানে প্রিমিয়াম নেয়া হলেও তা অ্যাকাউন্টে উল্লেখ করা হয়নি।

তাছাড়া এই সাবসিডিয়ারি কোম্পানিটির ব্যাংক ঋণ রয়েছে ৪৯২ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ও ব্যাংকঋণ মিলে ৮৯২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আয় প্রদর্শন করেছে মাত্র ৯৪ লাখ টাকা যা খুবই অসঙ্গত। এখানে মুনাফায় কারচুপি রয়েছে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। এখানে মার্জিন ঋণ ৮৫৩ কোটি টাকা। এ অর্থে শেয়ার কত টাকা মূল্যে ক্রয় করা হলো কত টাকায় বিক্রি করা হলো তা উল্লেখ করা হয়নি। আন রিয়েলাইজড লস ও ক্যাপিটাল ইরোশনের তথ্যও গোপন করা হয়েছে বার্ষিক প্রতিবেদনে।

ব্যাংকটিতে অনিয়মের ফিরিস্তি ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ভাড়া ব্যয় হিসেবে না দেখিয়ে সম্পদ হিসেবে দেখাতে হবে। অথচ আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ভাড়া সম্পদের পরিবর্তে ব্যয় হিসেবে প্রদর্শন করেছে অ্যাকাউন্টিংয়ের আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘন করেছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকটিতে ভাড়াবাবদ খরচ হয়েছে ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে এ ভাড়া ৩ কোটি ৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। এ ভাড়া সম্পদের পরিবর্তে ব্যয় হিসেবে সমন্বয় করা হয়েছে।

যথাযথ কর পরিশোধে আগ্রহ নেই ব্যাংকটির। এ জন্য বছরের পর বাড়ছে করের বোঝা। ৩৭.৫০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধের নিয়ম থাকলেও ২০১৯ সালে ব্যাংকটি পরিশোধ করেছে ২৫.৪৪ শতাংশ। এতে ৭৫ কোটি টাকার কর ঘাটতি রেখে মুনাফা প্রদর্শন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৪.৩০ শতাংশ কর ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। এভাবে ক্রমেই বেড়ে চলছে করের ঘাটতি। অথচ এ করের পরিমাণ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

Facebook Comments Box
top-1

Posted ১১:০১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।