নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট | 3038 বার পঠিত
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এক গভীর শাসন সংকটের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ব্যাংকটির সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, নিয়োগ-নীতি নিয়ে প্রশ্ন, বড় অঙ্কের আর্থিক অনিয়ম এবং রেগুলেটরি নির্দেশনা উপেক্ষার মতো বিষয়গুলো ব্যাংকের সামগ্রিক কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায় এক বিপজ্জনক দুর্বলতা তুলে ধরছে। ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেখানে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা সবচেয়ে বড় মূলনীতি সেখানে এরকম বিচ্যুতি ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করছে।
বড় অঙ্কের কমিশন জালিয়াতি:
ব্যাংকের ভেতর ছড়িয়ে থাকা এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় ১০৯ কোটি টাকার একটি জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কর্পোরেট আমানতকে ‘এজেন্ট ব্যাংকিং আমানত’ হিসেবে দেখিয়ে বেআইনিভাবে কমিশন উত্তোলন করা হয়েছে যা বহুদিন ধরে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে অদৃশ্যভাবে চলছিল। সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে, এত বড় মাত্রার জালিয়াতি দীর্ঘসময় টের পাওয়া যায়নি যা প্রমাণ করে অভ্যন্তরীণ অডিট, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও নজরদারি কাঠামো প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সাধারণত ব্যাংকিং খাতে কমিশন, আমানত রূপান্তর, বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন এবং শাখা-লেভেলে ইনসেন্টিভ ব্যবস্থায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু আল-আরাফাহ ব্যাংকের ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থাই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এই ঘটনার আরেকটি অন্ধকার দিক হলো অভিযোগের তালিকায় ব্যাংকের বিভিন্ন অধিদপ্তরের মাঝারি ও উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন। অর্থাৎ এটি শুধুই কয়েকজন নিম্নপদস্থ কর্মচারীর অনিয়ম নয়; বরং এটির পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে অনুমোদন বা প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত রয়েছে।
৫৪৭ কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত: স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক নিয়োগের অভিযোগ:
গত কয়েক বছরে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে যে ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তাকে একযোগে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাতে ব্যাংকের কর্মপরিবেশ, মানবসম্পদ নীতি এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে চাকরির নিশ্চয়তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেক কর্মীর দাবি, চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে এবং যথাযথ কারণ উল্লেখ না করেই। যেসব কর্মী দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন, তাদের অনেকেই ই-মেইল নোটিসের মাধ্যমে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন যা ন্যূনতম মানবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আচরণের পরিপন্থী।
একই সময়ে বিভিন্ন সূত্রে উঠে আসে, ব্যাংকের নতুন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এবং গোষ্ঠীবাদী প্রভাব ছিল প্রবল। বিশেষ যোগ্যতা বা শরীয়াহ্-ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের অভিযোগ কর্মীদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যেকোনো ইসলামী ব্যাংকে এমডি পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীর অন্তত দুই বছরের ইসলামী ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রস্তাবিত এমডি রাফাত উল্লাহ খান পূর্বে কখনোই কোনো ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেননি যার কারণে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়াও ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ার পূর্বে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, লিজিং কোম্পানি থেকে আসার সুবাদে তিনি লঙ্কাবাংলাসহ বিভিন্ন লিজিং প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০০ জনকে এক্সিকিউটিভ পদে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের অনেকেরই ব্যাংকিং খাতে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এসব নিয়োগে বড় ধরনের বাণিজ্য ও অনিয়মের গুঞ্জন ব্যাংকের ভেতরে তীব্র হয়েছে।
রেগুলেটরি নির্দেশনা মানতে অনীহা ও বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপ:
একটি বড় ব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ও নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায়, তারা কখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণে বিলম্ব করেছে, কখনও নির্দেশনা পূরণে যথেষ্ট আন্তরিকতার ঘাটতি দেখিয়েছে। এতে হাইকোর্ট পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে বিশেষত চাকরিচ্যুত কর্মীদের পুনর্বহাল সম্পর্কিত বিষয়ে। একটি ব্যাংকের শাসন কাঠামো এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে আদালতকে সরাসরি নির্দেশ দিতে হয় যা ব্যাংকের প্রশাসনিক সক্ষমতার গভীর সংকেত বহন করে। কর্পোরেট গভর্নেন্স কোনো ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে বোর্ড, অডিট কমিটি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ— সব স্তরেই ঘাটতি ধরা পড়েছে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্বচ্ছতা, ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়নে স্বজনপ্রীতি, এবং আর্থিক ঝুঁকি নিরীক্ষায় দুর্বলতা সব মিলিয়ে ব্যাংকটি বর্তমানে উচ্চ মাত্রার পরিচালন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ অডিট কার্যকর নয়, সেখানে দুর্নীতি, তহবিল অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আল-আরাফাহ ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই ভাঙন এতটাই বিস্তৃত যে এটি শুধু আর্থিক প্রতিবেদন বা বার্ষিক অডিটেই নয় বরং কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়েই প্রতিফলিত হচ্ছে।
ডিজিটাল ও কৃষি খাতে উদ্যোগ— কিন্তু মূল সমস্যার কারণে তা ব্যাহত:
ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল ব্যাংকিং উদ্যোগ, কৃষি খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং নতুন প্রযুক্তিনির্ভর সেবা চালু করেছে। কিন্তু গভীর প্রশাসনিক সংকট, দুর্নীতি, ও কর্মী ব্যবস্থাপনার অস্থিতিশীলতার কারণে এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন তখনই কার্যকর হয় যখন প্রতিষ্ঠানটি অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী ও সুশাসিত থাকে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে মূল ভিত্তিই দুর্বল হওয়ায় এগুলো টেকসই রূপ পাচ্ছে না।
সাবেক এমডি ও ডিএমডির বিরুদ্ধে দুদকের চার মামলা:
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে আর্থিক অনিয়ম, সোর্স ট্যাক্স জালিয়াতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকের সাবেক এমডি ফরমান আর চৌধুরী এবং সাবেক ডিএমডি ও সিএফও মোহাম্মদ নাদিমসহ চারজনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যাদের মধ্যে দু’জন এখনও কর্মরত। গত ৩০ নভেম্বর দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপপরিচালক আজিজুল হক বাদী হয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন। দুদকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দীর্ঘ তদন্তের পর সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
প্রথম মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, ফরমান আর চৌধুরী ও মোহাম্মদ নাদিম ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিয়োগপত্রের নির্ধারিত নিয়ম লঙ্ঘন করে সাত ধাপে মূল বেতনের অতিরিক্ত প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। দুদকের ভাষ্য, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার একটি পরিকল্পিত কৌশল ছিল। দ্বিতীয় মামলায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের জেনারেল লেজার (জিএল) হিসাব থেকে নানা ভাউচারের মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে সাবেক এমডি ও ডিএমডির সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ তদন্তে পাওয়া গেছে। তৃতীয় মামলা সবচেয়ে বড় আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কমিশন থেকে আয় ৩৬১ কোটি টাকার বেশি, যার ওপর ১০% হারে সোর্স ট্যাক্স কাটা হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স সরকারী কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। এই অনিয়মে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে- ফরমান আর চৌধুরী, মোহাম্মদ নাদিম, মোহাম্মদ ফজলুর রহমান চৌধুরী ও আবেদ আহম্মদ খান। দুদকের মতে, এই কর্মকাণ্ডের ফলে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। চতুর্থ মামলায় আবারও ফরমান আর চৌধুরী ও মোহাম্মদ নাদিমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তারা প্রকৃত পাওনার বাইরে বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ টাকা উত্তোলন করেছেন। দুদক মনে করে, এটি প্রতিষ্ঠানের নীতি-বিধি উপেক্ষা করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার একটি ঘটনা। সব মামলায় দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় মামলা করা হয়েছে। দুদক জানিয়েছে, প্রতিটি মামলার জন্য পর্যাপ্ত নথিগত প্রমাণ রয়েছে এবং তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করে চার্জশিট আদালতে দাখিলের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
দূর্বল ব্যবস্থাপনা:
মূলত আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে এক বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে আছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অবিচার, শাসন কাঠামোর দুর্বলতা এবং রেগুলেটর নির্দেশনার অবহেলা- এই সব উপাদান একটি ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। নৈতিকতা ও শরীয়াহর ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার দাবি থাকলেও ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সেই মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতিরই প্রতিচ্ছবি যার জন্য বেসরকারী ব্যাংকের মধ্যে অন্যতম সফল ব্যাংকটি এবার কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি।
এ বিষয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও কেউ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি এবং এমডি ও চেয়ারম্যানের ফোন নম্বরও কেউ দেননি। দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতির প্রতিবেদক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন এন্ড মার্কেটিং বিভাগের প্রধান এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট জালাল আহমেদ-এর সঙ্গে কথা হলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি এবং একই বিভাগের সিনিয়র এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো: মিজানুর রহমানও সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Posted ১০:৪৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy