শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খোদা বক্স : এক ইতিহাস, এক কিংবদন্তি (পর্ব-৩)

রিজওয়ান আহমেদ ফরিদ (পাকিস্তান)   |   সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   1643 বার পঠিত

খোদা বক্স : এক ইতিহাস, এক কিংবদন্তি (পর্ব-৩)

দায়িত্ব প্রদান
খোদা বকস সহকর্মীদের নির্ভরতা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন তাঁর সৎ, সহজ, মার্জিত, মধুর, বিশ্বস্ত, খোলামেলা আচরণ দিয়ে, যে আচরণ তিনি করতেন তাঁর অধস্তনদের সঙ্গেও। কাজের ব্যাপারে, সংশ্লিষ্ট সহকর্মীদের ওপর তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাসে সব দায়িত্ব দিয়ে দিতেন। তাদের নিষ্ঠা ও যোগ্যতাকে সবসময় সম্মান দিতেন- এভাবেই তিনি এদের মধ্যে আস্থা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন।

হানফি বলছেন, ‘খোদা বকস এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি সব ক্ষমতা নিজের হাতে আঁকড়ে ধরে রাখা পছন্দ করতেন না। অপরের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতেন এবং তাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিতেন। যখনই কোন কাজ তিনি কাউকে দিয়েছেন, তিনি তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছেন। তিনি অফিসারদের ক্ষমতা অর্পণ করতেন। অফিসার যা করবেন সেটা ঠিকভাবেই করবেন। তিনি কখনো নিজের লোককে সন্দেহ করতেন না।’

মি. চিশতি বলছেন :‘খোদা বকস সবসময়ই অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহারের মানুষ ছিলেন। কোন লোকদেখানো মেকি আচরণ তাঁর ছিল না। তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই ভালো লাগতো। খুবই বিনয়ী, ব্যবহারে কখনোই বোঝাতে চাইতেন না যে তিনি পাকিস্তানের বৃহত্তম বীমা কোম্পানি ‘লাইফ’ বিভাগের প্রধান। অত্যন্ত দক্ষ পরিচালক ও সংগঠক ছিলেন। একজন নয় হাজার জন সাথী-কর্মীকে তিনি তৈরি করে নিতে পারতেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম দিকে ইস্টার্ন ফেডারেল খুব জনপ্রিয় সংস্থা ছিল না। খোদা বকস ফেডারেলে যোগ দেওয়ার পরই কোম্পানির অগ্রগতি হতে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে।

তাঁর সব অধস্তনরাই ওনার কাছে ঠিক সন্তানের মতো ছিল। তারা খোদা বকসের অনুগত ছিল এবং প্রয়োজনে ওনার জন্য প্রাণ সমর্পণও করতে পারতো। যখন তিনি ইস্টার্ন ফেডারেল ছেড়ে যান তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ কর্মীরা কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করে ওনার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এতেই বোঝা যায় তিনি একজন প্রকৃত দলপতি ছিলেন। দল গড়ার কারিগর ছিলেন এবং আক্ষরিক অর্থেই একজন যথার্থ পরিচালক ছিলেন।’

বড় মাপের বিনম্র মানুষ

পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর পদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে একজন দক্ষ লোককে চাইছিলেন। অনেকেই জানেন, আইয়ুব খান সে সময় খোদা বকসকে মন্ত্রীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। খোদা বকস বিনীতভাবে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতিক নই।’ তবে যোগ্য লোক হিসেবে তিনি তাঁর এক বন্ধুর নাম করেছিলেন একজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ মি. ওয়াহিদুজ্জামান। পরে ওনাকেই প্রেসিডেন্ট বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন।

এই ঘটনার কথা প্রসঙ্গক্রমে টেনে এনে কারনোস্কি লিখছেন: ‘এহেন অসাধারণ মানুষটির অনেক মহান গুণাবলীর মধ্যে একটি ছিল তিনি কোনোদিন নিজের ক্ষমতা বা কৃতিত্বের কথা দম্ভভরে প্রকাশ করতেন না। আমরা সে সময়কার তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা পর্যন্ত জানতাম না পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাহেব খোদা বকসের প্রতি কতখানি মনোযোগী হয়েছিলেন। আমরা কেবল লক্ষ করতাম এবং ভেবে অবাক হতাম, কেন বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান প্রায়শই তাঁর পুরোনো দিনের ফরিদপুরের স্কুলবান্ধব সম্পর্কে তারিফ করেন আর ভূয়সী প্রশংসা করেন। … এ কেবল আমার কথা নয়, সে সময় সভা-কনভেনশনে উপস্থিত যে কারোরই এ অভিজ্ঞতা ছিল।

চিশতি সাহেবের মন্তব্য হলো: ‘এই ঘটনাকে আরেকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। খোদা বকস যদি অর্থের জন্য লালায়িত হতেন অথবা তিনি যদি একজন ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হতেন, তাহলে চটপট মন্ত্রী পদে যোগ দিতেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি একজন সৎ ও ঋজু চরিত্রের মানুষ ছিলেন এবং তাঁর বিশ্বস্ততার মান ছিল সাধারণের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি মন্ত্রীসভায় যুক্ত হওয়ার বদলে নিজের পেশাতেই সংযুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’
খোদা বকসের নেতৃত্ব গুণের জন্য তিনি বরাবর তাঁর সমকক্ষদের মধ্যে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘একজন প্রকৃত দলনেতা শ্রদ্ধা আদায় করেন বিনম্রতা দিয়ে, উগ্রতা দিয়ে নয় এবং সাফল্যের চাবিকাঠি হলো তাঁর কর্মীদলের মেধা, বুদ্ধি আর আনুগত্য।’

মন্ত্রিত্বের টুকরো চাকরি
ছোটখাটো গড়নের মানুষ ছিলেন খোদা বকস। কিন্তু বীমাকে পেশা হিসেবে নিয়ে তিনি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন যেটা যে কোনো উদ্যমী কর্মঅন্তপ্রাণ ব্যক্তির আরাধ্য হতে পারে। তাঁর কর্মসাফল্য শিখরস্পর্শী হলেও মানুষ হিসাবে তিনি রয়ে গিয়েছিলেন সরলতা ও আন্তরিকতার প্রতিমূর্তি স্বরূপ। উলফ্রাম ডব¬ু কারনোস্কি অল্প কথায় তাঁর এই বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘একজন হ্রস্ব দৈহিক গড়নের মানুষ হয়েও তিনি উত্থিত হয়েছিলেন ঊর্ধ্বে এবং এক বিরাট নামের অধিকারী হয়েছিলেন জীবন বীমার ক্ষেত্রে, যে পেশাগত ক্ষেত্রটিকে তিনি ভালোবাসতেন প্রবলভাবে, আপন অনমনীয় প্রত্যয়ে। কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে তিনি সেই একই রকম বিনীত মানুষ, বরাবর যেমন ছিলেন। সরলতা আর নিষ্ঠার প্রভায় খোদা বকস-কে তাঁর দৈহিক চেহারার থেকে অনেক বেশি বড় দেখাতো।’
এই সময়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদে খোদা বকস-এর নাম প্রস্তাবিত হয়। রাজনৈতিক গুরুত্বের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের একজন হিসাবে খোদা বকস-এর নাম প্রস্তাব আইয়ুব খানের দৃষ্টিতে মনে হয় ঠিকই ছিল। কেননা একজন শীর্ষস্থানীয় বীমাবিদ হিসাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই প্রান্তেই খোদা বকস-এর পরিচিতি ছিল। সার্বিক বিবেচনায় মন্ত্রীর পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিই বটে। কিন্তু হয় নি! খোদা বকস মন্ত্রিত্বকে বরণ করেননি। যিনিই ভেবেচিন্তে তাঁর নাম প্রস্তাব করে থাকুন না কেন, তিনি মন্ত্রী পদের জন্য ভুল নাম নির্বাচন করেছিলেন। ঘটনা হল, তাঁর নাম প্রস্তাবের সংবাদটি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর খোদা বকস কালবিলম্ব না করে ইসলামাবাদ চলে যান এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের দর্শনপ্রার্থী হন। প্রেসিডেন্টকে তিনি সবিনয়ে বলেন : ‘স্যার, আপনি আমাকে এতো বড় এক সম্মান দিচ্ছেন। আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু আমি সবিনয়ে একটি কথাই শুধু বলতে চাইছি – এই কাজটা আমার জন্য নয়। আমি কোনো রাজনীতির লোক নই। তাছাড়া যদি আপনি কিছু মনে না করেন স্যার, মন্ত্রিত্বের কাজ অস্থায়ী। অস্থায়ী কাজ আমি সারা জীবন অপছন্দ করে এসেছি।’

মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব এভাবে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে তা আজকের দিনে অভাবনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু ঘটনাটি নির্ভেজাল সত্য। আইয়ুব খান মেনে নেন খোদা বকসের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং জানতে চান এই পদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের, বিশেষত ফরিদপুরের, অন্য কোনো উপযুক্ত লোক আছেন কিনা। খোদা বকস কিছুটা ভেবে নিয়ে তাঁর পুরোনো বন্ধু ওয়াহিদুজ্জামানের নাম বলেন। … আইয়ুব খানের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারের সুবাদেই ওয়াহিদুজ্জামান পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত হন। এ প্রসঙ্গে মি. চিশতির মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে ৩২ পৃষ্ঠায়; তিনি লিখেছেন : ‘খোদা বকস ক্ষমতা ও অর্থের জন্য লালায়িত হলে সোৎসাহে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নিতেন এবং বিস্তর অর্থ উপার্জন করতেন। কিন্তু তাঁর সততা, ঋজুতা ও কর্মনিষ্ঠা ছিল সাধারণ মানের ঊর্ধ্বে; মন্ত্রিসভায় যাওয়ার বদলে নিজের পেশাতেই থাকার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন পূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ে।’

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের দরবারে যাওয়া, অত্যন্ত বিনয় ও বিচক্ষণতায় নিজেকে রাজনীতির পরিমণ্ডল থেকে সরিয়ে রাখা, বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে বন্ধু ওয়াহিদুজ্জামানের নাম প্রস্তাব করা- এসব ঘটনা দীর্ঘকাল তিনি কারোর কাছে প্রকাশ করেননি। ইস্টার্ন ফেডারেল কনভেনশনে বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান কেন ইস্টার্ন ফেডারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উপস্থিতিতেই খোদা বকসের ভূয়সী প্রশংসা করতেন সেটা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। খোদা বকস মন্ত্রী পদ গ্রহণ না করে যে খুবই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন তা এক বছরের মাথায় প্রমাণিত হয়েছিল। সত্যি বটে- মন্ত্রিত্ব একটি খণ্ডকালীন টুকরো চাকরিই হতো! কারণ ঘটনার এক বছর মাত্র পরেই গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব খান ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে ডব্লিউ কারনোস্কি তাঁর —বইতে লিখেছেন: ‘নিশ্চিতভাবে, এ জাতীয় রাজনীতির কাজ যে খোদা বকসের জন্য নয় সেটা সাব্যস্ত করার যোগ্যতম লোক ছিলেন খোদা বকস নিজেই। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বৃত্তের লোকজনদের সঙ্গে খোদা বকস রয়েছেন- এটা তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের পক্ষেও কল্পনা করাই কষ্টকর হতো। তাই সে রকম কিছু ঘটতে দেননি তিনি। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন এক চূড়ান্ত মনোবল সম্পন্ন মানুষ।’

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৪:৪৭ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।