মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতীয় চা দিবস আজ

দেশের চা শিল্পে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন

এইচ. এস.এম জিয়াউল আহসান   |   রবিবার, ০৬ জুন ২০২১   |   প্রিন্ট   |   259 বার পঠিত

দেশের চা শিল্পে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। উন্নয়নের কোনো কোনো সূচকে অনেক দেশকে পিছনে ফেলে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশ ও জাতি পালন করছে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবর্ষ। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে আজ ৪ জুন দেশব্যাপী প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় চা দিবস।’

দিনটি বাঙালি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৫৭ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের চা শিল্প একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। চা বাংলাদেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অর্থকরি ফসল, যাকে ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ও বলা হয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের যথাযথ নীতি-সহায়তা ও সহযোগিতা পেলে চা শিল্প হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাত। প্রথম জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে দেশের চা-শিল্পের সার্বিক দিক নিয়ে নিবন্ধটি লিখেছেন ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ.এস.এম জিয়াউল আহসান।

বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস : অষ্টাদশ প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা আবাদ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। বিভিন্ন কারণে কালক্ষেপণের পর ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কুন্ডদের বাগান বলে পরিচিত ছিল। একসময় এই চা বাগানটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৫৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডে দেশের সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান ‘মালনিছড়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত শুধু সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলায় চা আবাদ করা হতো, যা যথাক্রমে- সুরমা ভ্যালি এবং হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধায়নের সুবিধার্থে সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে লস্করপুর, বালিশিরা, মনু, দলই, লংলা এবং নর্থ সিলেট নামে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে। হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি নামকরণ করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চা শিল্প : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালিন চা বোর্ডের (বর্তমান বাংলাদেশ চা বোর্ডের) চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন।

বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ১১১-১১৩, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ০.৩৭১২ একর ভূমির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলস্থ ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু টি অ্যাক্ট-১৯৫০ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ প্রায় বিধ্বস্ত হযে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত এবং টেকসই করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করে যুদ্ধ-উত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের নিকট পুনরায় হস্তান্তর করেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ঋণ গ্রহণপূর্বক চা-শিল্পে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা করেন। চা-শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধু সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন, যা এখনো চলমান রয়েছে। তিনি চা শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন ব্যবস্থা চালু করেন, যা এখনো চলমান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন, যা বর্তমানে ‘বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)’ নামে পরিচিত।

চায়ের প্রকারভেদ, গ্রেড এবং তাদের উপকারিতা : বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, বিশ্বে প্রায় ৩০টি দেশ চা উৎপদনের সঙ্গে জড়িত, যাদের মোট উৎপদিত চায়ের শতকরা ৭০ শতাংশ ব্ল্যাক টি, ২৫ শতাংশ গ্রিন টি এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য চা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চা পানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ক্যানসার এবং হৃদরোগের মতো জটিল রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন প্রকার চায়ের উপকারিতা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ক্রমিক নং চায়ের প্রকার বর্ণনা উপকারিতা
১ ব্লø্যাক টি (কালো চা)

ব্লø্যাক টি ক্যামেলিয়া সিনেনসিস গাছের পাতা থেকে তৈরি করা হয়, একই গাছ যা গ্রিন টি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চা পাতার আর্দ্রতা ঝরিয়ে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকিয়ে এ চা তৈরি করা হয় যার ফলে কালো রঙ এবং অধিক স্বাদযুক্ত হয়ে থাকে।

অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের থেকে এটি পৃথক, ব্ল্যাক টি ক্যাফিনেটেড, তাই এই চা পান করলে প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং স্বাস্থ্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে।

তবে এর স্বাস্থ্যকর বৈশিষ্ট্য থেকে উপকার পেতে আপনাকে কেবল চা পান করতে হবে না। এটিকে বাষ্প করা, ঠান্ডা করা এবং তারপর ব্যথা উপশম করতে এবং ফোলা ভাব কমাতে ছোটখাটো কাটা, স্ক্র্যাপ এবং ঘায়ে চাপানো যেতে পারে। কালো চা স্নান ত্বকের ফুসকুড়ি এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

২ গ্রিন টি (সবুজ চা) গ্রিন টি উদ্ভূত হয়েছে চীন থেকে, যেখানে প্যান-ফায়ারিং বা রোস্টিং পদ্ধতিতে এ চা তৈরি করা হয়। জাপানে এ চা তৈরি করতে চা পাতাকে সিদ্ধ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।

গ্রিন টিতে ফ্ল্যাভোনইডসের মাত্রা বেশি থাকে, যা খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে এবং রক্ত জমাট বাঁধা কমিয়ে আপনার হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায্য করে। গবেষণায় দেখা যায় যে, এই ধরনের চা রক্তচাপ, ট্রাইগ্লিসারিড এবং মোট কোলেস্টেরল হ্রাস করতে সহায়তা করে।

গ্রিন টি লিভার, স্তন, প্রোস্টেট এবং কলোরেক্টাল ক্যানসার প্রতিরোধে ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই চায়ের জাতটি অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি হিসেবেও প্রদর্শিত হয়েছে, যা আপনার ত্বককে পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল রাখতে সহায়তা করে।

৩ হোয়াইট টি (সাদা চা) একটি সুস্বাদু স্বাদ হিসেবে পরিচিত, সাদা চা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস উদ্ভিদ থেকে আসে যা চীন এবং ভারতের নিজস্ব একটি জাত। এটি স্বল্পতম প্রক্রিয়াজাতকরণ চা।

গবেষণা দেখা যায় যে এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলি উচ্চমাত্রার একটি পানীয়, যা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর চা হতে পারে। হোয়াইট টি আপনার দাঁতগুলির জন্যও ভালো হতে পারে, যেহেতু এটিতে ফ্লোরাইড, ক্যাটচিন এবং ট্যানিনের একটি উচ্চ উৎস রয়েছে, যা দাঁতকে শক্তিশালী করতে, ফলকের সাথে লড়াই করতে এবং এসিড ও চিনির সাথে আরো প্রতিরোধী করে তুলতে পারে।

৪ ওলং চা ওলং চা একটি ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ চা বৈচিত্র্য, যা সবুজ এবং কালো চা তৈরি করতে ব্যবহৃত একই গাছ থেকে তৈরি। পার্থক্যটি হলো চা তৈরির প্রক্রিয়ায়- গ্রিন টি বেশি পরিমাণে অক্সিডাইজ করার অনুমতি নেই, তবে কালো চা কালো হওয়া পর্যন্ত অক্সিডাইজ করার অনুমতি রয়েছে। ওলং চা এ দুই প্রকারের মাঝে কোথাও রয়েছে, তাই এটি আংশিকভাবে অক্সিডাইজড। এই আংশিক অক্সিডাইজড হওয়াটাই ওলং চায়ের রঙ এবং বৈশিষ্ট্যগত স্বাদের মূল কারণ। ওলং চা প্রচুর এল-থানাইন রয়েছে, যা একটি অ্যামিনো অ্যাসিড, যা উদ্বেগ হ্রাস করে এবং সতর্কতা এবং মনোযোগ বাড়ায়। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে এল-থানাইন পার্কিনসনস এবং আলঝাইমার রোগের মতো জটিল রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।

ওলং চায়ে পলিফেনলও বেশি থাকে, যা প্রদাহ হ্রাস, ক্যানসারের বৃদ্ধি রোধ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাসের সাথে যুক্ত।

উপরোক্ত চা ছাড়াও হারবাল চা এবং ইনস্ট্যান্ট চা পাওয়া যায়, যা পান করলে বিবিধ উপকার রয়েছে।

চায়ের মাণ অনুসারে তাদেরকে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়, যা নিম্নরূপ:
ক্রমিক নং চায়ের ধরন মান

A Broken
A.1. FP Flowery Pekoe
A.2. FBOP Flowery Broken Orange Pekoe
A.3. BOP Broken Orange Pekoe
A.4. GBOP Golden Broken Orange Pekoe
B Fannings
B.1. OF Orange Fannings
B.2. FOF Flowery Orange Fannings
B.3. PF Pekoe Fannings
C Dust
C.1. RD Red Dust
C.2. PD Pekoe Dust
C.3. CD Churamoni Dust

বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন ও ভোগ : বিশ্বে চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। চীন ও ভারত চা উৎপাদনে যথাক্রমে ১ ও ২য় স্থান দখল করে রয়েছে। দেশের চায়ের উৎপাদন বিগত ১০ বছরে প্রায় ৬০.০১ শতাংশ বা ৩৬.০৩ মিলিয়ন কেজি বৃদ্ধি পেলেও তার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬৫.১৯ শতাংশ বা ৩৭.৫৭ মিলিয়ন কেজি। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে চায়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা পূরণের জন্য চা বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। দেশে প্রায় ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে চা আবাদ হয়। এই শিল্পে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার স্থায়ী শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চা শিল্পে প্রায় ৪ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের উৎপাদিত কিছু জনপ্রিয় চা বহির্বিশ্বে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হচ্ছে। কিন্তু দেশে যে হারে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বাড়ছে চাহিদা। চাহিদা মেটাতে দেশের বাইরে থেকে সীমিত পরিসরে চা আমদানি করতে হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপের কারণে চা-শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি, ২০১৬ সালে ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি এবং ২০২০ সালে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২.১৭ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না, বরং রফতানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০ টি, বর্তমানে চা বাগানরে সংখ্যা ১৬৭টি। এছাড়াও ২০০২ সাল থেকে চা বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনরিহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ শুরু হয়েছে এবং ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। এছাড়াও বর্তমান সরকার চা-শিল্পের উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদশে চা শিল্প’ শিরোনামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, যা আগামীতে দেশের চা-শিল্পকে আরো এগেিয় নিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের চা বাগানসমূহ ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ডসমূহ : বাংলাদেশের চা বাগানসমূহের দুই ধরনের নাম রয়েছে যথাÑ ১) টি এস্টেট অর্থাৎ চা গাছ থেকে আহরণকৃত পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং শ্রমিক/কর্মচারীর মৌলিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত চা বাগান এবং ২) চা বাগান অর্থাৎ ২৫ একরের অধিক ভূখণ্ড সংবলিত চা বাগান, যা টি এস্টেট নয়। বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধনকৃত দেশে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে, যার আঞ্চলিক বিভাজন নিম্নরূপ:

সূত্র : বাংলাদেশ চা বোর্ড ও ন্যাশনাল ব্রোকারস লি.

দেশে চা বোর্ডের নিবন্ধিত উক্ত ১৬৭টি চা বাগানসহ ছোটখাটো কিছু অনিবন্ধিত চা বাগান চা উৎপাদন করলেও বাজারে সচরাচর যে ব্র্যান্ডগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলোÑ
১. ইস্পাহানি টি ২. কাজি অ্যান্ড কাজি টি
৩. ফিনলে টি ৪. হালদা ভ্যালি
৫. সিলন টি ৬. বেঙ্গল টি
৭. ন্যাশনাল টি ৮. ড্যানিশ টি

বাংলাদেশে চায়ের ক্রয়-বিক্রয় : দেশে চা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত নিয়ম-নীতি পরিপালন করা অত্যাবশ্যকীয়। চা বাগান মালিকরা তাদের উৎপাদিত অধিকাংশ চা চট্টগ্রামে ও শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত নিলাম বাজারের মাধ্যমে বিক্রয় করে থাকে। উক্ত নিলাম থেকে চা ক্রয় করে অনেক নামীদামি ব্র্যান্ড পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে তাদের নিজস্ব প্যাকেটে বাজারজাত করে থাকে। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে চা ক্রয়-বিক্রয় করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স, বিডিং লাইসেন্স ও ব্লেন্ডিং লাইসেন্স গ্রহণসহ চা বোর্ড কর্তৃক অনুসৃত নির্দেশনা পালন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

চায়ের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ : বাংলাদেশের চা-শিল্পের উন্নয়নে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ চা বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে। চা বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে চা-শিল্পের উন্নয়ন তথা, চায়ের উৎপাদন, বিপণন ও রফতানি বৃদ্ধির জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নতুন চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন, বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের ওপর উপ-করারোপ এবং তার সহায়ক অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সামগ্রিকভাবে চা-শিল্পের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা। চা-শিল্পের গবেষণা কাজের জন্য বাংলাদেশ টি রিসার্চ ইনস্টিটিউট কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাগানে উৎপাদিত চা নিলাম বাজারে বিক্রয়ে সহায়তার জন্য ১১টি ব্রোকার প্রতিষ্ঠান, ক্রয়-বিক্রয়ের সহযোগিতার জন্য টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ, শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন, কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ টি এস্টেট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনসহ অর্থ জোগানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক উক্ত শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে।

দেশের চা-শিল্পকে এগিয়ে নিতে যা প্রয়োজন : চা-শিল্প একটি প্রকৃতিনির্ভর ও শ্রমঘন শিল্প। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে মুহূর্তের মধ্যেই অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতিতে পড়তে পারে এ শিল্পটি। তাছাড়া শ্রমিকদের পরবর্তী প্রজন্ম উচ্চশিক্ষিত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে না, যা চা-শিল্পের জন্য আরেকটি সম্ভাব্য সমস্যা। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক মজুরি ও অন্যান্য চাষাবাদ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় চা চাষাবাদ করে অর্জিত অর্থ দিয়ে এই ব্যাপক শ্রমগোষ্ঠীর বিনামূল্যে বাসস্থান, চিকিৎসা, খাদ্যসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে চা বাগান কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে উক্ত শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নোল্লিখিত সহযোগিতা অত্যাবশ্যক।

১. চা-শিল্পের জন্য সার ও খাদ্যপণ্যের ন্যায় ভর্তুকি মূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ, কীটনাশক ও জ্বালানিদ্রব্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. প্রকৃতির বিরূপ আচরণের ফলে সংঘটিত ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য জাতীয়ভাবে চা বীমা চালু করতে হবে।

৩. চা-শিল্পের শ্রম-নির্ভরশীলতা হ্রাসকরণের এবং পণ্যের বহুমুখী বাণিজ্যিককরণের লক্ষ্যে আধুনিক চাষাবাদ, প্রক্রিয়াকরণ ও যন্ত্রপাতির ব্যয় মেটানোর জন্য বিনাসুদে একটি আলাদা উন্নয়ন স্কিমের আওতায় চা উন্নয়ন তহবিল বরাদ্দ করতে হবে।

৪. চা-শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও তার অংশ বিশেষ আমদানিতে শূন্যহার শুল্ক প্রদান করতে হবে।

৫. এখন থেকে উপরোক্ত প্রস্তাবিত উন্নয়ন স্কিমের আওতায় চা-শিল্প আধুনিকায়ন হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত কর অবকাশ প্রদান করতে হবে।

৬. চা-শিল্পের উৎপাদন ও উন্নয়ন ঋণের সুদের হার বর্তমানের ৯.০০ শতাংশের পরিবর্তে ২.০০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:২৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৬ জুন ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।