বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০১৯ | প্রিন্ট | 395 বার পঠিত
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই শেয়ারদর ও সূচকের পতন শুরু হয়েছে দেশের পুুঁজিবাজারে। থেমে থেমে এ পতন চলছে এখনও। মাঝে মাঝে সূচক কিছুটা ইতিবাচক হলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। এতে লেনদেন কমছে বিনিয়োগকারীদের। শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রিতে আগ্রহী বেশি বিনিয়োগকারীরা। ফলে আয়ের একমাত্র উৎস এই লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। এতে চাকরি হারাচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মীও।
বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সহায়তা ও লেনদেন সম্পন্ন করে থাকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান। নির্দিষ্ট হারে কমিশন ও সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে এ সেবাটি প্রদান করে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এরকম ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আড়াইশ।
গত জানুয়ারিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে। বর্তমানে সেই সূচক চার হাজার ৯৭৫-এর আশেপাশে অবস্থান করছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে শেয়ারদর।
পুঁজিবাজারে লেনদেনের এ করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রান্তিকের এক প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে ডিএসইতে ৬২৬ কোটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। অথচ পূর্ববর্তী প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১২৮ কোটি। পূর্ববর্তী প্রান্তিকের চেয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শেয়ার লেনদেন কম হয়েছে।
যদিও গত বছরের এপ্রিল-জুনে লেনদেন হয়েছিল ৭৭১ কোটি শেয়ার। এ হিসেবে গত বছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে চলতি বছরের এ সময়ে শেয়ার লেনদেন কম হয়েছে ১৮ দশমিক ৮১ শতাংশ।
টাকার অঙ্কে গত এপ্রিল-জুন সময়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২২ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকার, যা জানুয়ারি-মার্চ সময়ের চেয়ে ৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ কম। আর গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অবস্থা বিরাজ করছে দেশের পুঁজিবাজারে।
লেনদেন কমে যাওয়াকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকে ইঙ্গিত করে। শেয়ারদর কমে গেলে অনেকেই বিনিয়োগ সরিয়ে ফেলেন। ফলে লোকসান দিলেও মূলধন নিরাপদে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর পুঁজিবাজারে লেনদেন যত বেশি হবে, সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় তত বৃদ্ধি পায়, নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় এবং বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ে।
কিন্তু বর্তমান চিত্রকে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি খরার হাতছানি হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, পুঁজিবাজার এভাবে চললে বাজার কয়েক বছরের একটি ঘেরাটোপে চলে যাবে। সেখান থেকে বিনিয়োগকারীদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এদিকে লেনদেন আশঙ্কাজনকভাবে কমায় সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ও কমে গেছে। অনেকের দৈনন্দিন খরচ পর্যন্ত উঠছে না। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলছে অনেকে। ছাঁটাই করছে কর্মীদের। নিতান্তই প্রয়োজনীয় জনবল রেখে বাকিদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।
দেশের পুরাতন সিকিউরিটিজগুলোর মধ্যে এক সময়ে ভালো ব্যবসা করা এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারাী জানান, ‘চলতি বছরে এ পর্যন্ত দুই কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি হাউজ পরিচালনা করতে গিয়ে। আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তাই চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকের পক্ষেই এ লোকসান দেওয়া সম্ভব নয়। আমার অফিসের সবাই পুরাতন কর্মচারী, কাকে রেখে কাকে বাদ দেব।’
এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক ও মিডওয়ে সিকিউরিটিজের স্বত্বাধিকারী মো. রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে মন্দাভাব দেখা দিলে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানেও প্রভাব পড়ে। অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাঁটাই করছে, এটি সত্য। তাকে তো টিকতে হবে প্রথমে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চেষ্টা করছে পুঁজিবাজারকে ভালো যায়গায় নিয়ে যেতে। এজন্য যার যার জায়গা থেকেও চেষ্টা করতে হবে। সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চেষ্টা করতে হবে নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আনতে।
কর্মী ছাঁটাই প্রসঙ্গে দেশের প্রথম সারির একটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ তিন লাখ থেকে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা বেতনের জনবল রয়েছে। পূর্বে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় ৫২ কর্মী ছিলেন। এখন তা ১৮তে নেমে এসেছে। ২০ বছর চাকরি করেছেন এমন কর্মীকেও বাদ দিতে হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় আছি। কোনোমতে টিকে আছি। বাজার ভালো না হলে কর্মী আরও ছাঁটাই করতে হবে।’
একই রকম চিত্র দেশের বেশিরভাগ সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান জনবল কমিয়ে কাজ বেশি করে দিচ্ছে অবশিষ্ট কর্মীদের। আবার কেউ কেউ বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে, যাতে দুজনের কাজ একজনে করতে পারেন।
কর্মী ছাঁটাইয়ের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আরেক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর কাজ। তবুও করতে হচ্ছে। সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের কাজটি মূলত একটু টেকনিক্যাল, অর্থাৎ পুরোটাই স্বতন্ত্র। এখানের অভিজ্ঞতা অন্য কোথাও কাজে লাগানো যায় না। ১৫-২০ বছর এ জগতে কাজ করে চাকরি হারানো বড়ই কষ্টের বিষয়। অবশ্য দক্ষতা বৃদ্ধির দিকেও মনোযোগ আকর্ষণ করেন তিনি।
আরো পড়ুন : পুঁজিবাজারে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সাধারণত আমাদের পুঁজিবাজারে ৪০০ কোটি টাকার নিচে লেনদেন হলে অনেক সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের লোকসান হবে। ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হলে সবাই উপকৃত হন। এ সমস্যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারেরও। মন্দার সময় লোকসান হবে, আবার পুঁজিবাজার ভালো থাকলে আয় বেশি করবে।
বেসরকারি খাত হিসেবে পুঁজিবাজার ঘিরে কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নতুন নতুন গ্রাহক সংগ্রহ করতে হবে। নইলে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বাজার ভালো করতে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার নীতিনির্ধারণী সহায়তা দিয়ে পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠান থেকে কারও চাকরি হারাতে হবে না।
Posted ২:৫৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed