নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ২৪ আগস্ট ২০২২ | প্রিন্ট | 344 বার পঠিত
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দীর্ঘ কর্মবিরতির কারণে বাগানে নেই ব্যস্ততা। স্থবির হয়ে আছে বাগান ও কারখানার পরিবেশ। চায়ের এই ভরা মৌসুমে কুড়ি না তোলার কারণে এক পাতার উপর অন্য পাতা গজিয়ে নষ্ট হচ্ছে কুড়ি। দিনের পর দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাগান মালিকদেও পাশাপাশি শ্রমিকরাও। গলানো সোনার সাথে তুলনা করা হয় সিলেটের চা পাতাকে। বিগত কয়েক দিনের শ্রমিক আন্দোলনের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থকরী ফসলের এ খাতটি। উৎপাদনমুখী হওয়ার পরিবর্তে বর্তমানে চা কারখানাগুলোতে নেই কোন কর্মব্যস্ততা।
দেশের উৎপাদিত চায়ের ৯০ শতাংশই আসে সিলেট অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশ চা সংসদের তথ্য বলছে, বর্তমানে চা এর বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির এক শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন-চা শ্রমিকদের এ আন্দোলনের কারণে শুধুমাত্র সিলেট ও চট্টগ্রামেই প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ২০ কোটি টাকার কাঁচা চা পাতা। মজুরি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ৯ আগস্ট থেকে দুই ঘন্টা ও ১৩ আগস্ট থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি করে যাচ্ছে চা শ্রমিকরা। ৩০০ টাকার মজুরির দাবিতে চা শ্রমিকরা আন্দোলন করলেও চা বাগানের মালিকরা বলছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতি শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪২২ টাকা পেয়ে থাকেন যা মাসিক হিসেবে প্রায় ১১ হাজার টাকা। তবে এ বক্তব্য প্রত্যাখান করেছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। তারা বলেন, চা শ্রমিকরা মজুরি হিসেবে ১২০ টাকা পাচ্ছে সেটাই মুখ্য বিষয়। অন্যান্য যেসব বিষয়ে কথা তুলে মালিকপক্ষ ৩০০ টাকা ৪০০ টাকা উল্লেখ করেন সেটা মজুরির অংশ নয়। শ্রম আইনে মজুরির সংজ্ঞা রয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলো মজুরির সাথে আসে না।
বাংলাদেশ চা সংসদের তথ্য থেকে জানা যায়, ১০ বছরে নিলাম পর্যায়ে চায়ের মূল্য কোনো প্রকার বৃদ্ধি না পেলেও বছরান্তে বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকের মজুরি। উক্ত বছরগুলোতে অন্য সকল দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও চায়ের নিলাম পর্যায়ে মূল্যের বৃদ্ধির পরিমান ছিল শুধুমাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্য দিকে শ্রমিকের কল্যানে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে ৯৪.২০ শতাংশ।
এদিকে বাগান মালিকরা বলছেন, শ্রমিকদের জন্য এ আন্দোলন আত্মঘাতি। বাজারের অস্থিরতার এই সময়ে চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। চা শিল্প টিকে থাকলে তবেই তারা মজুরী পাবে। যদি এ শিল্প অধিক পরিমাণে লোকসান দিয়ে চালানো লাগে তাহলে স্বাভাবিকভাবে এ শিল্পও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন এ শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাদের মতে, দৈনিক যে নগদ ১২০ টাকার মজুরি প্রদান করা হয় তা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ ৬ কর্মদিবসের জন্য ৭ দিনের মজুরি প্রদান করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে দৈনিক মজুরি গিয়ে দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। যেহেতু চা উত্তোলনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, সে ক্ষেত্রে একজন প্লাকার (পাতা উত্তোলনকারী শ্রমিক) দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত পাতা উত্তোলনের জন্য প্লাকিং বোনাস পেয়ে থাকেন যা বাগান ভেদে গড়ে দৈনিক ৬৫ টাকা। এছাড়াও রোববারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্যাশ প্লাকিং এবং মর্নিং ক্যাশ প্লাকিং এর মাধ্যমে আরও অতিরিক্ত আয় করে থাকেন। তারা বলেন, একটি ভালো বাগানে একজন প্লাকার সপ্তাহে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। এছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণও মৌসুমে প্লাকিং কাজে অনায়াসে যোগ দিয়ে পারিবারিক আয় বাড়াতে সাহায্য করেন। এছাড়া, একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা পর্যন্ত নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন। আরও বিবিধ প্রত্যক্ষ সুবিধা যেমন ১৪ দিনের বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ ১৪ দিনের উৎসব ছুটি ভাতা, ২০ দিনের অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা (৪০/৫০ দিনের মজুরির সমান উৎসব ভাতা), ভবিষ্যৎ তহবিলের উপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট দৈনিক গড়ে ২৪৬ টাকা নগদে পেয়ে থাকেন।
টি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যে সকল সুবিধাসমূহ প্রদান করা হয়ে তা অন্যান্য শিল্পখাতে দেয়া হয়না। এই শিল্পে প্রতি শ্রমিককে ২ টাকা কেজি দরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল বা আটা রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১০ টাকা। এছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে চা শিল্পে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এছাড়া, চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকেন অথচ অনন্যা শিল্পে শুধুমাত্র শ্রমিক নিজেই এই সুবিধা পান। শ্রমিকদের মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চা শিল্পে ২ টি বড় আধুনিক হাসপাতাল ও ৮৪ টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫ টি ডিসপেনসারিসহ সর্বমোট ৮৯১ জন মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন।
সূত্র আরো জানায়, চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চ বিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮ টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে যেখানে ১ হাজার ২৩২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন যেখানে বর্তমানে ৪৪ হাজার ১৭১ জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছেন। চা শ্রমিকদের বসত বাড়ির জন্য বিনামূল্যে পরিবার প্রতি ১,৫৫১ স্কয়ার ফিট জায়গার মধ্যে ৩৭০ বর্গফুট বিশিষ্ট সর্বমোট ৬৮ হাাজর ৮০৬ বসতবাড়ি কোম্পানি নির্মাণ করেছেন এগুলোর বছরওয়ারি রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। এছাড়া, শ্রমিকগণ হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন করে থাকেন এবং গবাদিপশু পালনের জন্য চারণভূমি ও রাখালের খরচও কোম্পানি বহন করে থাকে।
এছাড়াও একজন চা শ্রমিক অবসর গ্রহণ করলে তার পরিবর্তে তার পছন্দ অনুযায়ী পরিবারের একজনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা পেনশনের আদলে সাপ্তাহিক ১৫০ টাকা অবসর ভাতা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা এবং ২ টাকা প্রতি কেজি মূল্যে চাল বা আটাও পেয়ে থাকেন। ১৯০ বছরের পুরোনো শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোনো শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই শ্রমিক আইন অনুসরণপূর্বক ৭০ দশকে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এর মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সম কাজ এবং সম মজুরি নিশ্চিত করেছে।
অন্যান্য সুবিধার মধ্যে চা শিল্পে ১৯৩৯ সাল থেকে শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রচলন করে, যা বর্তমানে ১৬ সপ্তাহ মাতৃকালীন ছুটি ও আইন নির্ধারিত মাতৃকালীন ভাতা দিয়ে থাকে। চা বাগানগুলো, গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছে। শ্রমিকের ভাতা, বিভিন্ন রকম শ্রমিক কল্যাণমূলক যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। উপরোক্ত এ সকল সুবিধার জন্য একজন শ্রমিকের পেছনে দৈনিক গড়ে ৪৩ টাকা ব্যয় করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা বিভিন্ন ক্যাটাগরির উপর ভিত্তি করে বেতন কাঠামো ও বোনাস দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে বাগানে নানা শ্রেণির শ্রমিক রয়েছে। কিছু শ্রমিক স্থায়ী। স্থায়ী শ্রমিকদের তিনটি ক্যাটাগরি। ‘এ’ ক্যাটাগরির শ্রমিকরাই ১২০ টাকা দৈনিক বেতন পান। ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির শ্রমিকদের বেতন আরও কম। আর প্রতিটি বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের অর্ধেক অস্থায়ী শ্রমিক থাকেন। তাদের বেতন আরও অনেক কম। তাদের জন্য নেই উৎসব ভাতা ও রেশন।
দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামা শ্রমিকেরা জানান, যে টাকা তারা পান তা দিয়ে সংসার চালান কষ্টের বিষয়। পুষ্টিকর কোন খাদ্যও সে তালিকায় নেই। নিত্যদিন সকালবেলা রুটি আর চা বা আলু ভাজি; দুপুরে রুটির সঙ্গে আলু সেদ্ধ, পেঁয়াজ ও কচি চা পাতার মিশ্রণে ভর্তা এবং ঠান্ডা চা। রাতে ভাতের সঙ্গে চানার ডাল বা অন্যকিছু খেয়ে কোন রকমে জীবনধারণ করেন।
Posted ১২:৫৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৪ আগস্ট ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy