নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট | 170 বার পঠিত
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনুমোদন ছাড়াই বড় ধরনের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধ্যতামূলক অনুমোদন ছাড়া এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদেশি ঋণের ২৮৩ মিলিয়ন ডলার তারা দু’টি কিস্তিতে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টিকে ঋণচুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যা পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আরও সন্দেহ তৈরি করেছে।
বাঁশখালীর গন্ডামারা উপকূলে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের এই প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্কে ঘেরা। সেই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে রূপালী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পাশ কাটিয়েছে যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনাগত দুর্বলতার আরেকটি বড় উদাহরণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগ বলছে, ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৪০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৫ সালের ২৩ জুন ১৪৩ মিলিয়ন ডলার রূপালী ব্যাংক সরাসরি ব্যাংক অব চায়নার সিঙ্গাপুর শাখায় পাঠিয়েছে, এই দুই কিস্তির জন্য কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অথচ প্রথম দুটি কিস্তি (মোট ২৪৩.৭৬ মিলিয়ন ডলার) যথাযথভাবে অনুমোদন নিয়ে পরিশোধ করা হয়েছিল। এতে পরিষ্কার যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিস্তি পরিশোধের চাপ দেখিয়ে রূপালী ব্যাংক নিয়ন্ত্রক নির্দেশনা অমান্য করেছে। প্রকল্পটির জন্য ব্যাংক অব চায়না থেকে মোট ১.৬৯৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন পর্যন্ত ৫৭৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের লেনদেনে রূপালী ব্যাংক কেন অনুমোদন নেয়নি সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রূপালী ব্যাংক শিগগিরই বাকি কিস্তিগুলোর অনুমোদনের জন্য আবেদন করবে। অথচ একই সঙ্গে তারা স্বীকার করেছেন যে পঞ্চম কিস্তির আগে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তিতে যে নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে তা স্পষ্ট।
অন্যদিকে রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজেদের দায় লঘু করার চেষ্টা করেছেন। একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘অর্থ যেখানে যাওয়ার কথা ঠিক সেখানেই গেছে’, এবং তার ভাষায়, ‘টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন মানা হয়নি। তবে এমন অজুহাত প্রকৃত প্রশ্নের উত্তর দেয় না- হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে কি এমন ‘টেকনিক্যাল সমস্যা’ অনিবার্য ছিল নাকি ব্যাংকের সক্ষমতার ঘাটতি আড়াল করতেই এই ব্যাখ্যা- তার উত্তর পেতে সময় লাগবে।
রূপালী ব্যাংক আরও বলেছে, এফসি অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট করার সুযোগ না থাকায় সরাসরি অর্থ পাঠানো হয়েছে। অথচ তারা জানে অফশোর ব্যাংকিং সুবিধা না থাকলে বিশেষত বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক লেনদেনে অতিরিক্ত সতর্কতা এবং নিয়মের প্রতি শতভাগ আনুগত্য প্রয়োজন। তা না করে অনুমোদন এড়িয়ে যাওয়া দায়িত্বহীনতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। আবার ব্যাংকটি দাবি করছে, এসএস পাওয়ার নিজে টাকা দিয়েছে এবং সেই অর্থ দিয়ে ডলার কেনা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প মালিকের সরবরাহকৃত অর্থ ব্যবহার করে রূপালী ব্যাংকের অননুমোদিত বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করেনি। এ ধরনের উচ্চঝুঁকির লেনদেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও অস্পষ্ট করে তোলে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলামও দায়িত্ব এড়িয়ে বলেছেন, তিনি বিষয়টি ‘ভালো বলতে পারবেন না’ এবং লোকাল অফিসে যোগাযোগ করতে বলেছেন যা একটি জাতীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছ থেকে অস্বাভাবিক ও উদ্বেগজনক উত্তর।
পরে ব্যাংকের কমিউনিকেশন বিভাগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা আরও সমস্যাজনক। তারা জানিয়েছে, বিডা অনুমোদিত ঋণের কিস্তি নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া পরিশোধ করা যায়। কিন্তু আগের কিস্তিগুলো যখন অনুমোদন নিয়ে করা হয়েছে, তখন হঠাৎ করে দুই কিস্তিতে অনুমোদন অগ্রাহ্য করা কেন এটির কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ডিএসআরএ ও ডিএসএএ অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা, তহবিল ঘাটতি এবং বিপিডিবির বকেয়ার অজুহাত দেখিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা হলেও তা প্রকৃত নিয়ম লঙ্ঘনকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
পুরো ঘটনাই দেখিয়ে দেয় রূপালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভঙ্গুর, সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রচুর, আর বিদেশি ঋণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে ব্যাংকটি নীতিমালা অনুসরণে ব্যর্থ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অথচ আচরণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো নিয়ম মানা ঐচ্ছিক, জবাবদিহিতা অস্পষ্ট এবং ভুলের দায় কেউ নেয় না।
এই অনিয়ম দেশের ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান শৃঙ্খলা সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে। বিশেষত বিদ্যুৎ খাতের বিতর্কিত প্রকল্প, বিপিডিবির বকেয়া, বিদেশি ঋণ ও ডলার সংকট- সব মিলিয়ে রূপালী ব্যাংকের এই আচরণ আর্থিক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের মত।
Posted ২:৪৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy