রবিবার ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পপুলার লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ'র মৃত্যু

মায়ের সন্দেহই কী সত্যি হলো

  |   সোমবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২২   |   প্রিন্ট   |   262 বার পঠিত

মায়ের সন্দেহই কী সত্যি হলো

পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ বিবাহিত জীবনে সুখী ছিলেন না। বিবাহের শুরু থেকে তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাসান আহমেদের সম্পত্তি দখলের জন্য নানা ফন্দি করে আসছিলন। নানা ছলে হাতিয়ে নেন স্বামীর গাড়ি, বাড়ি ও নগদ অর্থ। অবশিষ্ট সম্পত্তি কুক্ষিগত করার জন্য স্ত্রীর মানুষিক নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে বিছানাশায়ী হন হাসান আহমেদ। কিন্তু সুচিকিৎসা মেলেনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসান আহমেদের মা ও ভাইয়েরা বিদেশে নেয়ার চেষ্টা করলে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। হাসান আহমেদের মা ও ভাইদের সন্দেহ হয় যে, এই স্ত্রীর হাতে নিরাপদ নয় হাসান আহমেদের জীবন। তাই স্ত্রীর কবল থেকে হাসান আহমেদকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে সফল না হওয়ায় পরে মামলাও করেন। কিন্তু হাসান আহমেদকে উদ্ধার সম্ভব হয়নি। শেষমেশ স্ত্রীর হেফাজতে হাসান আহমেদের মৃত্যু হলে মা-ভাইয়ের সন্দেহ আরো তীব্র হয়। তাই স্ত্রী ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়। জনমনে প্রশ্ন তাহলে কী মায়ের সন্দেহই সত্যি হলো।

হাসান আহমেদের মা-ভাইয়ের অভিযোগ, ২০০৪ সালে জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে হাসান আহমেদের বিয়ে হয়। বিবাহিত জীবনে হাসান আহমেদ মোটেও সুখী ছিলেন না। তার প্রতি স্ত্রীর কোনো অনুরাগ ছিল না, স্ত্রীর মোহ ছিল হাসান আহমেদের সম্পদের প্রতি। এজন্য জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার বোন লায়লাসহ সকলে মিলে আমাদের পরিবারে সঙ্গে হাসান আহমেদের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। হাসান আহমেদ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে তার ওপর চলে নির্যাতন।

তাদের অভিযোগ, স্ত্রীর অত্যাচারে হাসান আহমেদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর স্কয়ার হাসাপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে পূর্ণ চিকিৎসা না নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস অর্থের অভাব দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে তাকে বাসায় নিয়ে আসেন। অথচ ওই সময় তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বহন করবে বলে পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদিত হয়। কিন্তু জান্নাতুল ফেরদৌস বোর্ডের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেননি। তিনি হাসান আহমেদকে বাসায় রেখে তার নামে সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এর আগেও লিখে নেন বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। তাই স্ত্রীর কবল থেকে পুত্রকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসান আহমেদের মা মনজুরা আহমেদ একই বছরের ৩ নভেম্বর পল্টন থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন যার নম্বর-১৯১। এতে কোনো সুফল আসেনি। কিন্তু সন্তানের চিকিৎসার জন্য হাল ছাড়েননি হাসানের মা। এবার তিনি আদালতে যাওয়ার মনস্থ করেন। মামলা দায়ের করেন দেওয়ানী আদালতে যার নম্বর-৪০/২০২১। এদিকে হাসান আহমেদের চিকিৎসার প্রতি জান্নাতুল ফেরদৌসের এখনো তেমন মনোযোগ নেই। এবার তার নজর পড়ে হাসান আহমেদের পপুলার লাইফের শেয়ারের প্রতি। ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন এ শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার জন্য। তার কাছে জিম্মি হাসান আহমেদ। পপুলার লাইফের ৪০ লক্ষ ২৮ হাজার ৫৫৪টি শেয়ার স্ত্রীর নামে হস্তান্তরের জন্য ২০২১ সালের ৩ মে বাংলাদেশে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বরাবর আবেদন করতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু তা নিয়মসম্মত না হওয়ায় ওই বছরের ২৫ আগস্ট সমুদয় শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি প্রদান সম্ভব নয় বলে বিএসইসি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী নন জান্নাতুল ফেরদৌস। কিছু না কিছুতো আদায় করতেই হবে। তাই এবার ১ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার স্ত্রীকে দেয়ার জন্য বিএসইসি বরাবর আবার আবেদন করেন হাসান আহমেদ। কিন্তু স্ত্রীর নামে শেয়ার হস্তান্তরের পুন: আবেদন স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং স্ত্রীর অনুচিত প্রভাবেই তা সংঘটিত বলে দাবি করেন হাসান আহমেদের ভাইয়েরা। স্ত্রীর কাছে শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিবের কাছে হাসান প্রত্যয়নপত্র ও তার স্বাক্ষর যাচাইয়ের জন্য আবেদন করেন।

হাসানের ভাই কবির আহমেদ আরও অভিযোগ করেন, একের পর এক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে চলছেন জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার বোন লায়লাসহ পরিবারের সকলে। কিন্তু নেই কোনো ভীতি বা অপরাধবোধ। বিরতিহীনভাবে চলছে তাদের জঘন্য অপকর্ম। বাসায় মৃত্যু হলে ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় হাসান আহমেদকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসানকে হাসপাতালে নেয়ার পর তার জীবনের কোনো অস্তিত্ব পায়নি এবং তাকে মৃত বলে ওই সময় লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়। তাই ২৫ জানুয়ারি জান্নাতুল ফেরদৌসহ ৮ জনকে আসামি করে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

এ মামলার প্রতিবাদে ২৭ জানুয়ারি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আমার স্বামী হাসান আহমেদের চিকিৎসার জন্য আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আমার বিরুদ্ধে আমার স্বামী কখনো কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এছাড়া আরো বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। এই সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য তার ভাইয়েরা সবসময় ষড়যন্ত্র করে। অতীতেও আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এখন আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে। তারা আমার স্বামীর লাশ দেখতে আসেনি। যেখানে তারা থাকেন সেখানে নিলেও লাশটি দেখেননি। এমনকি জানাযায় অংশ নেননি বলেও জানান তিনি।
জান্নাতুল ফেরদৌস দাবি করেন, মামলার বাদী কবির আহমেদ নিহতের আপন ভাই নয়, তিনি তার পালিত ভাই। তারা কেউ অসুস্থ হাসান আহমেদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়নি। এমনকি মৃত্যুর পর তার লাশ দেখতেও আসেননি। এই মামলার হয়রানি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসান আহমেদ স্ট্রোক করে দীর্ঘদিন স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। উপযুক্ত চিকিৎসা ছাড়াই ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও আপনি বন্ড সই দিয়ে স্কয়ার হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে আসলেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় প্রায় ১০ লাখ টাকা পপুলার লাইফ বহন করলেও পরবর্তীতে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর টাকা দিতে পারবে না। তাই নিজে বন্ড সই দিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসি। টাকার জন্য তার চিকিৎসা করাতে পারিনি। পপুলার লাইফ থেকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার পর আর কোনো টাকা দিবে না- এমন কোনো সত্যতা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে পপুলার লাইফের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করার ঘোষণার পর কেনো তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হলো না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোম্পানির পক্ষ থেকে শুধু হাসান আহমেদকে বিদেশে নিতে চেয়েছেন, আমার পরিবারের কাউকে সাথে নিতে চাননি। তাই বিদেশে পাঠাতে রাজি হইনি। এ বিষয়ে আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।

বিদেশে নিতে না পারলেও ঢাকার এভারকেয়ার, স্কয়ার, ইউনাইটেডের মতো বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হলো না কেন এমন প্রশ্ন করা হলেও তিনি এ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

হাসপাতালে মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। হাসান আহমেদের মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বিব্রতবোধ করেন।

এদিকে কবির আহমেদ নিহতের পালিত ভাই এ দাবির পক্ষে তার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি হাসান আহমেদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।

হাসান আহমেদের ভাইয়ের পরিবার থেকে অভিযোগ, হাসান আহমেদের বায়তুল মোকারমের দোকান বিক্রি করে পাওয়া ৭ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক থেকে ২ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক থেকে ৩ কোটি টাকা, শাকিল রিজভী সিকিউরিটিজ থেকে শেয়ার বিক্রি করে প্রাপ্ত ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, অথচ টাকার অভাবে তার চিকিৎসা হয়নি কেনো বলছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। এর কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন না।

হাসান আহমেদের চিকিৎসায় পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভুমিকা সম্পর্কে জানার জন্য কোম্পানীর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম ইউসুফ আলী ও কোম্পানী সচিব মোস্তফা হেলাল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলেন, পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী হাসান আহমেদের উন্নত চিকিৎসায় যথেষ্ট আন্তরিক ছিল। প্রতিষ্ঠানটি হাসান আহমেদের চিকিৎসার জন্য প্রথমে ১০ লক্ষ টাকা দেয়। পরে তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় বহনের সিদ্ধান্তুও পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করে। পরিচালনা পর্ষদের এই সিদ্ধান্ত আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার স্ত্রীকে অবহিত করি। আমরা ব্যক্তিগতভাবেও তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১২:১৯ অপরাহ্ণ | সোমবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।