বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০১৯ | প্রিন্ট | 490 বার পঠিত
অপরাধ ঠেকাতে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আড়াই থেকে তিন ফুট ইটের গাঁথুুনির উপর এ প্রাচীর নির্মাণ হবে। আলাদা ৭টি ক্যাম্পের চারদিকে ১৫৭ কিলোমিটারজুড়ে কাঁটাতার বসানোর দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
কাজটি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পন্ন করতে আরআরআরসির (শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়) পক্ষ থেকে সরকারকে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এর আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশাসন দেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের যৌথ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্থান চিহ্নিত করে জমি বরাদ্দ দেয়া হবে। ক্যাম্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে দুটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে। এজন্য পুলিশ অধিদফতর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে।
এসব প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করছি, যাতে তারা ক্যাম্প থেকে বের হতে না পারে। ক্যাম্পের ভেতর যেন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্যও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা খুন-ধর্ষণ, চুরি-ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া, মাদক ও মানব পাচারসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
দুই বছরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ৪৩ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানব পাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। এগুলো বন্ধের জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, সর্বশেষ ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়- রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে। নীচের অংশে আড়াই থেকে তিন ফুট ইটের গাঁথুনি দিয়ে উপরের অংশ কাঁটাতারের প্রাচীর দেয়ার ‘ইস্টিমেট’ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য অর্থ বিভাগে চিঠি দেবে জননিরাপত্তা বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জননিরাপত্তা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া হতে পারে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল তুরস্কের শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করে এসেছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হবে এ সংক্রান্ত প্রকল্প প্রস্তাব।
প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেয়ার জন্য আরআরআরসি থেকেও প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র। প্রস্তাবে বলা হয়, সার্বিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে পড়া ও অনুমোদিত যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সেক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল ও পাহাড় ধসে টিকে থাকার উপযোগী উঁচু পাকা দেয়ালসহ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা যেতে পারে। কাঁটাতার সংরক্ষণের জন্য চারপাশে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এবং টহল সড়কও নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে হাতি চলাচলের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।
এ বিষয়ে সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে কিছু কাজ করছে বিধায় সবদিক বিবেচনায় বাস্তব পরিস্থিতি এবং প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্পের ডিজাইন প্রণয়ন ও প্রাক্কলন প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাবে বলা হয়।
এদিকে ৭টি আশ্রয় শিবিরের চারদিকে ১৫৭ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ক্ষেত্রে ছোটখাটো সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)। জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা এলাকায় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে (২৪) গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ফারুক হ্নীলা ইউনিয়ন যুবলীগের ৯নং ওয়ার্ড সভাপতি ও জাদিমুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
রোববার রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ ফারুকের ভাইদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদিনও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া ক্যাম্পের ভেতরে মাদক ও মানব পাচার এবং হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ বিরোধও।
বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষ, খুন, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ। দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ৪৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন আরও ৩২ রোহিঙ্গা। এছাড়া ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানব পাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি।
এর মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১টি। এসব মামলায় আসামি ১ হাজার ৮৮ জন রোহিঙ্গা। এদিকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব বন্ধে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে রোহিঙ্গারা শরণার্থীশিবির থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। এছাড়া খুন, হত্যা, মাদক ও নারী-শিশু পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়েছে। ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকায় প্রতিনিয়ত খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে।
ক্যাম্পগুলোর অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত ৫১৩ জন দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর সময় কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্ধার হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৫৪ জন রোহিঙ্গা।
জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে শিগগিরই ক্যাম্পগুলোয় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হলেও তারা এখন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
দু’দিন আগে এক যুবলীগ নেতাকে তারা হত্যা করেছে। তারা নানাভাবে মূলধারা লোকজনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় দ্রুত কাঁটাতার বা দেয়াল নির্মাণ করে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
আরআরআরসি সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার ক্যাম্পগুলোয় মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বসবাস করছে। উখিয়ায় ২টি এবং টেকনাফে ৫টিসহ ৭টি আশ্রয় শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে আশ্রয় শিবিরগুলোকে ৩২টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
ক্যাম্পগুলোর চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় সামনে এসেছে। যেমন- রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মাঝে স্থানীয় জনসাধারণের বাড়িঘর ও জমিজমা রয়েছে। প্রস্তাবিত বেড়া নির্মাণ হলে সংশ্লিষ্টদের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়, সে দিকটি খতিয়ে দেখার জন্য আরআরআরসি’র চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
ক্যাম্পগুলো যে বনাঞ্চলে অবস্থিত, তা বিরল প্রজাতির হাতির বিচরণক্ষেত্র। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ১২ রোহিঙ্গাসহ ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বেড়া নির্মিত হলে হাতির চলাচলের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। এতে হাতির আক্রমণ ও উপদ্রব বাড়তে পারে।
এটি কীভাবে নিরসন করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়। ক্যাম্পগুলো উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় ৭টি আলাদা স্থানে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি শিবিরে আলাদাভাবে বেড়া দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হলে ক্যাম্পগুলোর ভেতরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
সে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে চিঠি দিয়েছে আরআরআরসি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কারণ ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তারাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’
Posted ১:০৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed