বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০১৯ | প্রিন্ট | 520 বার পঠিত
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু প্রতিষ্ঠানকে মানবপাচারকারী চক্রের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ চক্রে ৮৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের ২৮, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ৯, ইমিগ্রেশন পুলিশের (এভসেক) ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। আরও রয়েছেন বেসরকারি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ১১ সদস্য। এ ছাড়াও এই চক্রে রয়েছে ৯ ট্রাভেলস এজেন্সিসহ বহিরাগত ৯ দালাল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তালিকাভুক্তির কথা বলা হয়।
শাহজালাল বিমানবন্দরে সক্রিয় এ মানব পাচারকারী ও তাদের এজেন্টদের কার্যক্রম প্রসঙ্গে গত ১৮ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে মানব পাচারে অভিযুক্তদের নামসংবলিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এই প্রতিবেদনের আলোকে গত ১১ জুলাই মন্ত্রণালয় অভিযুক্ত ৮৬ জনের অনুকূলে বিমানবন্দরে প্রবেশের নিরাপত্তা পাস ইস্যু থাকলে তা বাতিল করতে বলে। এ ছাড়া তাদের বিমানবন্দরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) নির্দেশ দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বাস্তবায়ন করেনি বেবিচক কর্তৃপক্ষ।
শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে মানবপাচারে এ সিন্ডিকেটে রয়েছে পুরানা পল্টন, মতিঝিল ও সিলেটের ৯ ট্রাভেল এজেন্সি। সেগুলো হলো মাহবুব এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি (দুই ব্রাঞ্চ- দালাল আহমেদুর রহমান), বিএমএস ট্রাভেলস (দালাল বেলাল খান), স্কাই ভিউ ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইয়াহিয়া ওভারসিজ, জিএসএ অব ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স (দালাল সোহাগ) এজেন্সিজ, আহমেদুর রহমান বিএমএস ট্রাভেলস, ইয়াহিয়া ওভারসিজ (মালিক এনামুল হক) ও ট্রাস্ট ট্রাভেলস (মালিক হাসান)।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদন বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটে জড়িত। মূলত পাচারকারীদের প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করেন সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত এ কর্মকর্তা-কর্মচারী। অভিযুক্তরা হলেন অফিস সহকারী হাসান পারভেজ, এএসজি সাইফুল ইসলাম, ইউনুস মিয়ার ছেলে এএসজি কবীর, জাহেদুল কবিরের ছেলে এএসজি কবির, নিরাপত্তাপ্রহরী আসাদুজ্জামান খোকন, শাহজালাল সরকার, মনিরুজ্জামান খান, জিল্লুর, বাবুল চন্দ্র দাস, গাজী তোফায়েল, তানভীর হোসেন মিয়া, সোহেল রানা (বর্তমানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কর্মরত), কাজী মাসুদ, আব্দুল মতিন, ইদ্রিস মোল্লা, শাখাওয়াত হোসেন তুহিন (বর্তমানে ইয়াবাপাচার মামলায় পলাতক), আইনুদ্দীন, ফরিদউদ্দিন, রফিক ও নিরাপত্তাকর্মী মিজানুর রহমান খান (ফায়ার অপারেটর)। এ ছাড়াও স্ক্যানিং অপারেটর মনিরুজ্জামান খান, দীপক, ফজলু, শাহজাহান ও শাহাদাত এ চক্রে জড়িত।
মানবপাচারের এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্সের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা হলেন ট্রাফিক সুপারভাইজার সুমন চন্দ্র দাস, ট্রাফিক হেলপার আমির ও মো. আকরাম হোসেন, ট্রাফিক অফিসার মামুন, কাউন্টার সুপারভাইজার শাকিল ও জাহাঙ্গীর হোসেন, গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার শওকত, মাহবুব ও আনিস।
মানবপাচারের শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছেন বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ৮ জন। তারা হলেন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের শাহ মখদুম উদ্দিন আহমেদ অনন, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এসএম কামাল হোসেন, এমিরেটস এয়ারলাইন্সের মামুন ও নুরুল হুদা, শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের ডেপুটি ম্যানেজার এহসান ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সুমন, কাতার এয়ারলাইন্সের সিকিউরিটি অফিসার তানিয়া, টার্কিশ এয়ারলাইন্সের সিকিউরিটি অফিসার অভি ও মবিন।
শাহজালাল বিমানবন্দর ব্যবহার করে মানবপাচারের এই সিন্ডিকেটে জড়িত ইমিগ্রেশন পুলিশ ও এভসেকের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীও। তারা হলেন ইমিগ্রেশন পুলিশের এসআই বাচ্চু ও এসএ কামাল এবং এএসআই জুনাব খান, এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্য সার্জেন্ট এসএম জসিম, গেটম্যান কনস্টেবল শহীদুল, আনসার সিপাহি মো. রাসেল মিয়া, মাসুদ পারভেজ ও মাহতাব ছাড়াও সাধারণ আনসার সদস্য পাপিয়া সুলতানা।
শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে মানবপাচারকারী চক্রে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন ২০ জন। তারা হলেন ঢাকার গাজী মিয়া, জিহান, আমিনুল, ইব্রাহিম খলিল, আলম ও ওয়াহিদ হোসেন কাজল; মাদারীপুরের ডুবলু ফকির, কালাম মাতবর, জামাল ও মো. আছাদ; শরীয়তপুরের আলমগীর হাওলাদার; সিলেটের শাহিন আহমেদ ও আলমগীর শাহপরান; সুনামগঞ্জের আনোয়ার, বদরুল, গাজী ও হারুন; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বপন, কামাল ও হোসেন। এই তালিকায় অভিযুক্তদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। চাকরি ছেড়ে একজন বিদেশে পালিয়েছে বলে বিমানবন্দর সূত্র জানায়।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী এ চক্রটি অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। আইন প্রয়োগে অস্বচ্ছতা ও অদক্ষতা ছাড়াও দরিদ্রতার সুযোগ নেওয়া হয়। সম্প্রতি সাগরপথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি বাড়ায় আন্তঃদেশীয় মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট আকাশপথকে এখন নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। পাসপোর্টে জাল ভিসা লাগিয়ে বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট বিমানের বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন পুলিশের একশ্রেণির সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশে মানবপাচার করা হচ্ছে।
সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (প্রশাসন) অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো মানবপাচারে জড়িত শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মরত বেশ কয়েকজন ও কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির নামসংবলিত একটি প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
অভিন্ন মন্তব্য করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের ডিজিএম তাহেরা খন্দকার জানান, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেবে না বিমান কর্তৃপক্ষ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, মানবপাচারকারী ভিকটিমের কোডনেম দিয়েছে ‘টানা’। বাংলাদেশের পাচারকারী সিন্ডিকেট মূলত তুরস্ক, স্পেন এবং ইতালি পাচারের টার্গেট করে কাজ করে থাকে। পাসপোর্টে জাল ভিসা লাগিয়ে বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট বিমানের বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন ম্যানেজ করে এ পাচার হয়। নির্বিঘ্নে পাচারের জন্য জনপ্রতি পাচারকারীদের বিমানবন্দর ম্যানেজ করতে গুনতে হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা।
জাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের সীমানা পার হওয়ার পর পাচারের শিকার মানুষ কাঙ্ক্ষিত বিমানবন্দরে অবতরণ করলে সেখানে তাদের গ্রহণ করে বিমানবন্দর পার করে সেই দেশে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য রয়েছে আলাদা সক্রিয় গ্রুপ। তুরস্ক পাচারের ক্ষেত্রে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব বিমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ট্রানজিট করে সেসব বিমানে জাল ভিসার মাধ্যমে পাচারকারী ভিকটিমদের বিমানে ওঠায়। ট্রানজিটের পর সেখানে অবস্থানরত মানবপাচারকারী চক্র বিমানবন্দর ম্যানেজ করে তুরস্কে প্রবেশ করায়। অন্যদিকে জাল ভিসা দিয়ে বিমানে মরক্কো অথবা আলজেরিয়া নেওয়ার পরে জিব্রালটা প্রণালি দিয়ে স্পেনে প্রবেশ করায়। এ পদ্ধতিতে সমুদ্রে অনেক সময় দীর্ঘদিন থাকতে হয়। সে সময় খাবারের অভাবে অনেকে মারাও যায়।
ইতালি পাচারের জন্য পাচারকারীরা জাল ভিসার মাধ্যমে প্রথমে সুদানে নেয়। সেখান থেকে মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে লিবিয়ার বনগাজি নামক স্থানে নেয়। সেখান থেকে জাহাজে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পাচার করে। এই যাত্রা অনেক ভয়ঙ্কর এবং অনেকে মারা যায় পথেই। আবার অনেকে এক দেশ থেকে আরেক দেশের সীমান্ত পার হওয়ার সময়ও সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যায়। ইতালির ক্ষেত্রে লিবিয়ার বনগাজীতে নিয়ে ভিকটিমদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা হয়। যে পথেই মানবপাচার হোক না কেন পাচারকারীদের ট্রানজিট পয়েন্টে নির্ধারণের চেয়ে বেশি টাকা আদায় করার পরই পরবর্তী গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু হয়। এর মধ্যে কোনো কারণে যদি কারও টাকা দিতে দেরি হয়, তাকে আটক রাখা হয় যতদিন টাকা না পরিশোধ হয়। বেশি দেরি হলে মারধর করা হয়। মানবপাচারে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তুরস্ক ৬ লাখ, লিবিয়া সাড়ে ৪ লাখ, ইতালি ৭ লাখ এবং স্পেনের জন্য ১২ লাখ টাকা আদায় করে তবেই ভিকটিমদের ছাড়া হয়।
Posted ১:৪৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed