নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১ | প্রিন্ট | 368 বার পঠিত
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের ৩ ব্যাংকের ১৯০ কোটি টাকা লাপাত্তার পথে। ব্যাংকগুলো হলো- ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড এবং এবি ব্যাংক লিমিটেড । এসব ব্যাংক ঋণ নিয়ে প্রায় দেওলিয়া হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন এক ব্যবসায়ী। কারণ পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় আগে থেকেই উচ্চ আদালত তার উপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
তার নাম শামসুল আলম। তিনি চট্টগ্রাম শহরের প্রথম সারির গুঁড়ো কাঠের ব্যবসায়ীদের একজন। এক সময় ভালো ব্যবসা ও মুনাফা করেছেন। এখন প্রায় সব ব্যবসাই গুটিয়ে গেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও নিখোঁজের পথে।
জানা যায়, শামসুল আলম অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসায় ভালো সুনাম অর্জন করেছিলেন। ব্যবসায় সম্প্রসারণও করেছিলেন। ব্যবসায়িক সুনাম ও সামাজিক পরিচিতি কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ সুবিধা নেন। কিন্তু যোগ্যতা ও সক্ষমতা না থাকায় ঋণ করে বিপুল পরিমাণ টাকা নেয়ার পর এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। ফলে ছিটকে পড়েন ব্যবসা থেকে। পাশাপাশি বেশিরভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আর তিন ব্যাংকে খেলাপি হয়েছেন প্রায় ১৯০ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখায় শামসুল আলমের শামসু স’মিল ও এসএ এন্টারপ্রাইজের দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৫৯ কোটি ৪১ লাখ ৪৪ হাজার ২০১ টাকা। আর ঋণের বিপরীতে শামসুল ইসলাম নগরের চান্দগাঁও এলাকার ৯৩ শতক ভূমি বন্ধক রাখেন। এ জমি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে।
একইভাবে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা থেকে শামসুল আলমের মালিকানাধীন এমএম সিন্ডিকেট ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ সুবিধা নেয়। কাঠ ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য এ ঋণ সুবিধা নেয়া হলেও তিনি সময় মতো ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থ হন। আর এ ব্যর্থতার দায়ে গত ৩১ ডিসেম্বর তিনি ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখায় খেলাপি হয়ে পড়েন। এ সময় শামসুল আলমের মালিকানাধীন এমএম সিন্ডিকেটের কাছে সুদাসলসহ মোট পাওনা হয়েছে ৮৬ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার ১৯১ টাকা। এর বিপরীতে বন্ধকিতে রয়েছে চাদগাঁও ও মোহরা মৌজায় ১০৭ ডিসিমেল জমি। আর এ পাওনা আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত ৩০ মার্চ নিলামে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয়ের চেষ্টাও করেছিল।
অন্যদিকে তার মালিকানাধীন এমএম ট্রেডিং ও শামসু স’মিলের নামে এবি ব্যাংক লিমিটেড চকবাজার শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নেয়া হয়। চলতি বছর তিন ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকটির চকবাজার শাখার সুদাসলে মোট পাওনা ৪২ কোটি ৭৯ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৮ টাকা। এর বিপরীতে জমি বন্ধকিতে দেয়া হয় ৫৮ ডিসিমেল। আর এ পাওনা আদায়ে গত ৯ মার্চ নিলামের মাধ্যমে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলেও বিক্রি হয়নি।
ইউসিবিএলের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৯ ও ২০১২ সালে নিজের দুই প্রতিষ্ঠানের নামে মো. শামসুল ইসলাম ঋণ নেন, যা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে সুদাসলে ঋণের পরিমাণ ৫৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্যাংকে জামানত রাখা জমি দুটি হেবা দলিলমূলে ছেলে মো. মিজানুর রহমানকে দান করেন। পরে ভূমি অফিসে ছেলের নামে নামজারি করে খাজনাও পরিশোধ করেন।
ইউসিবিএলের কর্মকর্তারা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা একটি মামলা করেছিলাম। এ মামলায় ব্যবসায়ী বাবা ও ছেলের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি জেবিএম হাসানের ভার্চুয়াল আদালত এ আদেশ দেন।’
এ বিষয়ে ব্যাংকের আইনজীবী মানস কুমার দাশ বলেন, মহানগর দায়রা আদালত ও সিএমএম আদালত শামসুল আলম ও তার ছেলের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। আসামিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জুন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষে উচ্চ আদালতে আবেদন করি। শুনানি শেষে উচ্চ আদালত গত মঙ্গলবার নিম্ন আদালতের আদেশ বাতিল করেন। আদালত বাবা ও ছেলের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। পাশাপাশি দুদিনের মধ্যে পাসপোর্ট আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় গিয়ে এমএম সিন্ডিকেট নামের প্রতিষ্ঠানটির হদিস নেই। স্থানীয় লোকজনরা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। ৫৭ নাম্বর হোল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক ব্যক্তি বলেন, ৭৯ হোল্ডিং তো চিনি না। আর এমএম সিন্ডিকেট নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নামও শুনিনি। এমন কি শামসুল আলমের নাম শুনিনি। আপনি ভালো করে খোঁজ নিন।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখার কর্মকর্তারা বলেন, ‘শামসুল আলমের মালিকানাধীন এমএম সিন্ডিকেট নামে নেয়া ঋণ এখন পুরোপুরি খেলাপি। আমরা পাওনা আদায়ে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাওনা আদায় হয়নি। আর এটি এখন মামলাধীন বিষয়।’
এবি ব্যাংক লিমিটেড চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘শামসুল আলমের কাছ থেকে আমরা খেলাপি পাওনা আদায় করতে পারিনি। তার বিরুদ্ধে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলাও চলমান আছে। আর খেলাপি পাওনা আদায়ে আমরা ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তিও নিলামে বিক্রয়ের চেষ্টা করেছি। শুনেছি ব্যবসা আছে। তবে একই সম্পত্তি দিয়ে তিনি আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।এখন সব ব্যাংকেই খেলাপি।’
Posted ১:৪৪ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১
bankbimaarthonity.com | saed khan