আবুল কাশেম | সোমবার, ৩১ অক্টোবর ২০২২ | প্রিন্ট | 135 বার পঠিত
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকাশিত নতুন গেজেটের শর্তানুযায়ী নকশা ও প্ল্যান মোতাবেক নতুন ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট জমির মালিক এবং ডেভেলপার কোম্পানিগুলো বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ পাচ্ছেন না। ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট ড্যাপের নতুন অনুমোদিত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
ড্যাপের নতুন প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে রাজউকে এ পর্যন্ত ভবন নির্মাণের জন্য নকশা প্ল্যান অনুমোদনের আবেদন অনেক কম জমা পড়েছে। রাজউকের ৮টি জোনাল অফিসের তথ্য মতে গত ২৪ আগস্ট থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত মোট আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৮২১টি। এরমধ্যে ১ হাজার ১০১টি আবেদনের নিস্পত্তি ( অনুমোদন) হয়েছে। তবে নতুন গেজেট প্রকাশের আগে ২০২১ সালে ১০ হাজার ৩২টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৫৬টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। অনুমোদন পাওয়া বেশিরভাগই ছিল আবাসিক ভবনের নকশা ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ড্যাপের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের জারির আগের অনুমোদন প্রাপ্ত নকশা ও প্ল্যান অনুযায়ী শর্তে উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মালিকগণ নতুন ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। কিন্তু নকশা ও প্ল্যান অনুমোদনের পর নির্ধারিত সময়ে ভবন নির্মাণ না করলে অনুমোদনের কার্যকারিত থাকবে না। এদিকে ড্যাপের নতুন গেজেট প্রকাশের পর রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ভবনের ব্যবহারযোগ্য স্পেসের পরিমাণ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আগে যেখানে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া যেত। বর্তমানে সেখানে অনুমোদন পাওয়া যাবে ৪/৫ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের। এ কারণে স্বল্প প্রস্থের রাস্তার পাশের জমির মালিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
ড্যাপের গেজেটের শর্তে বলা হয়েছে, ঢাকায় ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক সুবিধা ও সড়কের প্রশস্ততা অনুযায়ী। যেসব এলাকায় প্রশস্ত রাস্তা ও নাগরিক সুবিধা যেমন-পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা বেশি থাকবে সেসব এলাকায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে। সেক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা নিয়ে বাধা থাকবে না। আগে যেখানে জায়গার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সুউচ্চ ভবনের অনুমোদন নেওয়া যেত, এখন প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে সুউচ্চ ভবন নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
ড্যাপের গেজেটের আলোকে উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়; যে খানে ১২ থেকে ১৬ ফুট রাস্তার পাশে ৫ কাঠার একটি প্লট থাকবে। প্রতি কাঠার আয়তন ৭২০ বর্গফুট। ৫ কাঠার আয়তন ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুট হয়। এ ধরনের রাস্তার পাশে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৭৫। এই ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটকে ১ দশমিক ৭৫ দিয়ে গুণ করলে হয় ৬ হাজার ৩০০ বর্গফুট হয়। ব্যবহারযোগ্য ফ্লোর এটুকুও। এর বেশি আয়তনে বাস করা যাবে না। শুধু তাইনয়, এ ধরনের প্লটে নিচতলায় কার পার্কিং রাখলেও ৪টি তলার বেশি উঁচু করার সুযোগ থাকবে না। প্রতিটি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট তৈরি করলে কমন স্পেস ছাড়া প্রতি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে ৭৮৭ দশমিক ৫ বর্গফুট। একইভাবে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী ৬ ফুট থেকে ৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৫। একক বা দুই পরিবারের জন্য এ রকম বাড়ি হবে। ৮ থেকে ১২ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৫। ১৬ থেকে ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ধরা হয়েছে ২।
রাজউকের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আবাসন যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, একইভাবে স্বাস্থ্য সেইসঙ্গে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা ও বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশও কি মানুষের মৌলিক অধিকার নয়? শুধুমাত্র বড় ইমারত নির্মাণ কি মানুষের সেই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে পারবে বা পারছে? ২০০৮ সালের আগে ধানমন্ডি এলাকায় প্রতি বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ কার্যকরের পর একই জমিতে দেড় থেকে দ্বিগুণ ইমারত নির্মাণের পরও বর্তমানে ফ্ল্যাটের মূল্য বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বরং বর্তমান ড্যাপে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সুলভ আবাসনের ব্যবস্থার জন্য এই প্রথম ০.৭৫ প্রণোদনা এফএআর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেন মানুষ ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে একটি ফ্ল্যাট কেনার সক্ষমতা অর্জন করে।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকাকে বলেন, ড্যাপের নতুন গেজেট প্রকাশের আগের অনুমোদন প্রাপ্ত ভবনগুলো ওই সময়ের আইন ও শর্তমোতাবেক নির্মাণ করা যাবে। এ বিষয়টি গেজেটে উল্লেখ করা আছে।
তিনি গেজেট প্রকাশের পর এখন নতুন নিয়ম, শর্ত এবং নির্দেশনা মোতাবেক আবেদনকারীকে নকশা ও প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অনুমোদনের শর্ত এবং নির্দেশনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে।
ঢাকা শহরে নাগরিক সুবিধাগুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে ড্যাপকে সাজানো হয়েছে। কোন এলাকায় কতটুকু সুবিধা আছে, সেসব বিবেচনা করে সেই এলাকায় উন্নয়নের অনুমোদন দেওয়া হবে। এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণ করে জনঘনত্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
এদিকে রিয়েল অ্যাস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নতুন ড্যাপ অনুযায়ী,সামনে যতটুকু প্রশস্ত রাস্তা আছে তার ওপর নির্ভর করে প্ল্যান পাওয়া যাবে। আগে যদি একটি প্ল্যানে ৮তলা পেতেন, এখন নতুন ড্যাপের বিধি অনুযায়ী পাবেন ৩/৪তলা পাবেন। ফলে ফ্ল্যাটের কোয়ান্টিটি কমে যাচ্ছে। এ কারণে দাম বাড়বে এবং তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যাবে। যারা স্বল্প বেতনে বেসরকারি চাকরি করেন তাদের বেতনের ৬০ শতাংশ টাকা বাড়িভাড়া পরিশোধে চলে যায়। এমন সব মানুষের স্বপ্ন থাকে একটা ফ্ল্যাট কিনবেন সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে। নতুন ড্যাপের কারণে দাম বেড়ে গেলে সাধারণ এসব মানুষের পক্ষে আর ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হবে না।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, বাস্তবিক অর্থে ড্যাপে প্রস্তাবিত সব পরিকল্পনা কৌশলের সফলতা নির্ভর করবে তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ওপর। অতীতে ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কিংবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবে ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
Posted ১:৪১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ৩১ অক্টোবর ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy