
বিশেষ প্রতিবেদক | বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 248 বার পঠিত
প্রবিধান প্রণয়নের পর এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও গঠিত হয়নি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) উপদেষ্টা পরিষদ। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে পরামর্শ দেয়ার জন্য বীমা আইনে এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের কথা বলা হলেও; রহস্যজনক কারণে আইন প্রণয়নের দেড় দশকে এর বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বীমা খাতকে এগিয়ে নিতে নানামুখী বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও মতামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সংস্থাটি। যদিও ২০১০ সালে বীমা আইন প্রণয়নের পরপরই ২০১১ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রবিধানমালাও প্রণয়ন করা হয়। ওই প্রবিধান প্রণয়ণের তিন বছরের মাথায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে বীমা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনের নাম সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। যদিও প্রবিধানের ধারা (১) এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে ‘ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে’। তবে রহস্যজনক কারণে দেড় দশক ধরে উপেক্ষিত থেকে গেছে বীমা আইনের বাস্তবায়ন। অথচ বীমা আইন ২০১০ এর ১৫৪ ধারায় ‘উপদেষ্টা কমিটি’ গঠনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ, সরকারের সহিত আলোচনা সাপেক্ষে, এই আইনের অধীনে তাহার দায়িত্ব পালনে পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করিবে এবং উহার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করিবে।’
২০১১ সালে আইডিআরএ প্রণীত প্রবিধানে, কর্তৃপক্ষকে সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সর্বোচ্চ ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। যে উপদেষ্টা পরিষদের উদ্দেশ্য হবে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের উপর কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকতর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও বীমা খাত প্রতিষ্ঠায় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা উচিত। দীর্ঘ দিন ধরে পরিষদ গঠনের আইন প্রতিপালন না করে ঝুলিয়ে রাখা; একার্থে আইন অবমাননারই শামিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের দ্য ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (আইআরডিএআই) অনেক আগেই ‘ইন্স্যুরেন্স অ্যাডভাইজারি কমিটি’ করেছে। এই কমিটির কাজ হচ্ছে বীমা শিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, প্রবিধানের সরলীকরণসহ নিয়ম-নীতির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান। যার মাধ্যমে দেশটির বীমা খাত ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে।
আইন প্রণয়নের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের বীমা শিল্পের উন্নয়নে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হতাশাজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
খাত সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশ্লেষক মনে করেন, উপদেষ্টা পরিষদ থাকলে বীমার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে খাত সংশ্লিষ্টরা সুস্পষ্ট মতামত ও পরামর্শ পেতেন। রেফারেন্স পেতেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা খুব সহজেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা পেত। ব্যাংক বীমা অর্থনীতির সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, বীমা শিল্পে না বুঝেই অনেক কাজ হচ্ছে। এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে দেশের বীমা খাতের জন্য বিশেষজ্ঞদের একটি শ্রেণি গড়ে উঠত, খাতকে এগিয়ে নিতে ধারাবাহিকভাবে যারা অবদান রাখতে পারতেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, উপদেষ্টা পরিষদ না থাকায় কর্তৃপক্ষ যেমন অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তেমনি সংস্থাটির দায়িত্বশীলদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার ঘাটতিও দেখা যায়। এ অবস্থায় বীমা খাতে অধিকতর উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে সঠিক পথে চালিত করতে উপদেষ্টা পরিষদ অপরিহার্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বীমা ব্যক্তিত্ব বলেন, বীমা খাতের অনেকটা বিশেষজ্ঞসংশ্লিষ্ট বিষয়। এটি ব্যাংকের মতো নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যেহেতু স্থায়ী জনবল কম, কর্মকর্তারা এলে বীমা বুঝে উঠতে উঠতেই যাওয়ার সময় হয়ে যায়; সেক্ষেত্রে সঠিক পরামর্শ ও দিক নির্দেশনার জন্য উপদেষ্টা পরিষদ খুবই ফলপ্রসু। এটি গঠনে উদ্যোগী হওয়া উচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বীমার উন্নয়নের জন্য, জিডিপিতে বীমার অবদান বাড়াতে, বীমার যে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত পেতে, দিক নির্দেশনা পেতে উপদেষ্টা পরিষদ থাকা উচিত।
জানতে চাইলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নব নিযুক্ত সদস্য (নন-লাইফ) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতিকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিষয়টি যেহেতু আইনে বলা হয়েছে, প্রবিধানও রয়েছে; আমরা এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে কাজ করব।
প্রবিধানে যা আছে: ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রবিধানমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর ৩ ধারায় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন নিয়ে বলা হয়েছে-(১) কর্তৃপক্ষ, সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী, সরকারি গেজেট দ্বারা, অনধিক ১৫ (পনের) জন সদস্য সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করিবে, যাহা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত তারিখ হইতে কার্যকর হইবে। (২) উপদেষ্টা পরিষদের উদ্দেশ্য হইবে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের উপর কর্তৃপক্ষকে পরমর্র্শ প্রদান করা ।
৪। উপদেষ্টা পরিষদের সভার কার্যক্রম। -(১) চেয়ারম্যানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে, এই প্রবিধানমালায় প্রদত্ত শর্তাবলী অনুযায়ী উপদেষ্টা পরিষদ সভা অনুষ্ঠানের জন্য মিলিত হইতে; এবং অন্য কোন ভাবে সভা পরিচালনা করিতে পারিবেন। (২) কর্তৃপক্ষ যখনই প্রয়োজন মনে করিবে তখনই উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদানের জন্য সভায় মিলিত হইবেন।
(৩) চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হইতে
(৪) কাজের সুবিধার্থে, উপদেষ্টা পরিষদের সম্মতিতে চেয়ারম্যান সদস্যদের দ্বারা উপ-কমিটি করতে পারিবেন, যাদের সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদের নিকট উপস্থাপন করা হইবে।
(৫) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক সাধারণতঃ ৭ (সাত) দিন পূর্বে সভার বিবরণীর বিজ্ঞপ্তি প্রচার করিতে হইবে এবং সময়ে সময়ে স্বীকৃত কার্যকর আইনের অধীন, বিজ্ঞপ্তি বিবরণী সদস্যদের নিকট ব্যক্তিগতভাবে প্রাপ্তিস্বীকারের মাধ্যমে বা নিবন্ধিত ডাক বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বা অন্য কোন আধুনিক নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ পদ্ধতির মাধ্যমে হইতে হইবে।
(৬) চেয়ারম্যান ন্যূনতম ৪৮ (আটচল্লিশ) ঘণ্টা পূর্বে বিজ্ঞপ্তি জারীপূর্বক উপদেষ্টা পরিষদের সভা আহ্বান করিতে পারিবেন।
(৭) উপদেষ্টা পরিষদের সভার কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই এইরূপ কোন বিষয় চেয়ারম্যান কর্তৃক অনুমোদিত হইলে আলোচনার জন্য বিবেচনা করা হইবে।
(৮) চেয়ারম্যান ও কর্তৃপক্ষের সদস্যগণ সভায় অংশগ্রহণ করিতে পারিবে। (২) কোন সভায় কোরাম গঠিত না হইলে, উপস্থিত সদস্যগণ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময় হইতে ৩০ (ত্রিশ) মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষান্তে সভাটিকে অনুরূপ বা অন্য কোন দিনের একই সময় পর্যন্ত, যেভাবে উপযুক্ত মনে করিবেন, স্থগিত ঘোষণা করিবে।
(৩) মুলতবি সভাতে যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য উপস্থিত না হন, তাহলে উপস্থিত সদস্যদের সমন্বয়ে কোরাম গঠিত হইবে এবং কার্যক্রম গৃহীত হইবে।
(৪) চেয়ারম্যান বা সভাপতিত্বকারী সদস্যগণ কর্তৃক অনুপস্থিতির ছুটির আবেদন মঞ্জুর না হইলে, একজন সদস্য উপদেষ্টা পরিষদ বা উপ-কমিটির সকল সভায় যোগদান করিবেন।
(৫) উপযুক্ত ও যথাযথ কারণ ব্যতীত কোন সদস্য উপদেষ্টা পরিষদের ধারাবাহিক তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকিলে, কর্তৃপক্ষ উপদেষ্টা পরিষদের তালিকা হইতে তাহার নাম বাদ দিতে পারিবে এবং আইনের বিধান অনুযায়ী শূন্য পদ পূরণ করিবে।
৬। সভার কার্যবিবরণী (১) কমিটি যেরূপ পদ্ধতি উপযুক্ত বিবেচনা করিবে উপদেষ্টা বা উপ-কমিটির সভার কার্যবিবরণী সেইভাবে সংরক্ষণ করিবে। (২) সভায় উপস্থিত সদস্যদের নাম কার্যবিবরণীতে উল্লেখ থাকিবে।
(৩) প্রত্যেক সভার কার্যবিবরণীতে সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের নিরপেক্ষ ও সঠিক সারাংশ উল্লেখ থাকিবে।
(৪) উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক চূড়ান্তকৃত ও অনুমোদিত কার্যবিবরণীর একটি অনুলিপি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করিবেন।
৭। বিবিধ শর্তাবলী। (১) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে প্রযোজ্য শর্তাবলী অনুযায়ী, উপদেষ্টা পরিষদ বা উপ-কমিটির সভায় উপস্থিতির জন্য প্রত্যেক সদস্য খরচ, অধিবেশন ফি, আনুষঙ্গিক খরচাদি ইত্যাদির অর্থ কর্তৃপক্ষ হইতে প্রাপ্য হইবেন। (২) উপদেষ্টা পরিষদ বা উপ-কমিটিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিষদের কোন সদস্য সংবাদ মাধ্যম বা অন্য কোন সরকারি মাধ্যমে কোন প্রকার তথ্য প্রদান করিবেন না।
Posted ৮:৫৭ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy