রজত রায় | বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫ | প্রিন্ট | 102 বার পঠিত
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ কোনো নতুন ধারণা নয় বরং বিশ্বের অনেক দেশেই এটা হয়ে থাকে। বিশ্ব অর্থনীতি আজ ক্রমশ জটিল ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা দিতে অনেক দেশেই ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের পথে হাঁটছে।
একটি ব্যাংকিং একীভূতকরণ তখন ঘটে যখন দুটি বা ততোধিক ব্যাংক তাদের সম্পদ এবং দায়গুলোকে একটি একক সনদের অধীন একত্রিত করে। সাধারণত একীভূত সত্তা ব্যাংকের নাম ধরে রাখবে এবং অন্যগুলো অধিকারে নিবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো একটি নতুন নামে একটি নতুন চাটার্ড ব্যাংক গঠন করতে পারে। তবে বাংলাদেশে ব্যাংক একীভূত হবার ঘটনা খুব সচরাচর ঘটে না। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দুইবার দৃশ্যমানভাবে ব্যাংক একীভূতকরণ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ১০টি ব্যাংককে একীভূতকরণ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনে ৪টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংকগুলোর পূর্বের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংক। তারপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড গঠন করা হয়। ২০১০ সালে ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
একীভূতকরণ বনাম অধিগ্রহণ আসলে বিষয়টি কি? ব্যবসায়িক জগতে সবচেয়ে ভুল বোঝাবুঝি হওয়া দুটি শব্দ হলো একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণ। দুটি শব্দ প্রায়শই দুটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীর যোগদানকে বুঝায়। তবে কখন এগুলো ব্যবহার করতে হবে তার মধ্যে মূল পার্থক্য রয়েছে। দুটি পৃথক সত্তা যখন একটি নতুন যৌথ সংগঠন তৈরির জন্য শক্তি একত্রিত করে তখন একীভূতকরণ ঘঠে। এদিকে, একটি অধিগ্রহণ বলতে একটি সত্তার অন্য একটি সত্তার দখলকে বোঝায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, সমস্যায় জর্জরিত পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে সরকারও। এই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি ইসলামী ধারার ব্যাংক গঠন করা হবে। সেটির জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিবে সরকার। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলো ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোকে নিয়ে নতুন একটি ব্যাংক অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের মূলধনে গড়ে উঠবে এই ব্যাংক। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এই ব্যাংকের অধীন চলে আসবে। এরপর ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করবে। তাহলে সরকারের কী লাভ? এই ব্যাংক মুনাফা করতে শুরু করলে এর শেয়ার বেসরকারী খাতে ছাড়বে সরকার। এর মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগ ফেরত পাবে। পাশাপাশি পাঁচ ব্যাংকের বড় আমাতকারীদেরও শেয়ার নেয়ার প্রস্তাব করা হবে। ছোট আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে চাইলে তাতে বাঁধা দেয়া হবে না। এতে আমানত নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে থাকবে যা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
অর্থনীতিবিদরা কি ভাবছেন? অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হলে আমানতকারীদের টাকা নিরাপদ থাকে এবং ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বাড়ে। দুর্বল ব্যাংকগুলো একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে তাদের মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হয়, যা ঋণ প্রদানের ক্ষমতা বাড়ায়। একীভূতকরণের ফলে একটি বড় ও শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত গড়ে ওঠে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
প্রশ্ন হচ্ছে ভালো ব্যাংক কেন খারাপের দায়িত্ব নিতে হবে? একীভূতকরাকে শুধু অর্থনীতিবিদরাই ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। ব্যাংকাররাও এটিকে সুনজরে দেখছেন। কোন ব্যাংক একীভূত হবে কি হবে না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সরকারী-বেসরকারী যে কোনও ব্যাংক, ব্যাংক কোম্পানী সংশোধন আইন-২০২৩ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সে ক্ষেত্রে একীভূত করার নিয়ম ও সবার জন্য প্রযোজ্য।
সম্প্রতি এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ যা ২০২১ সালে ৮ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। ভুটানে খেলাপি ঋণের হার ২০২২ সালে ৩ শতাংশ, ভারতে খেলাপি ঋণের হার ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের হার কিরগিজস্তানে যা ২০২২ সালে দেশটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। আর সর্বশেষ জুন ২০২৫ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থ্যাৎ ব্যাংকখাতে বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।
ব্যাংকিং খাতে কোন ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকলে পুরো খাতই ঝুঁকির মাঝে থাকে। এই ঝুঁকি এড়ানোর একটা অপশন হলো মার্জার। তবে এটি কীভাবে হবে? কোন ও দুর্বল ব্যাংক যদি একটা ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়, তাহলে দুই প্রতিষ্টানেরও লাভ হবে। কারণ দু’টো বা একাধিক ব্যাংক এক হওয়ার পর সেটি আরও বড় ও শক্তিশালী হয়। কারণ শুধু দুর্বল ব্যাংকই পাচ্ছে না ভালো ব্যাংকটি, পাশাপাশি মূলধন ও পাচ্ছে এবং ওটার আউটরিচ ও পাচ্ছে। তবে প্রাপ্তির পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকের ডিপোজিট, ঋণ, শাখা ও ভালো ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে। কারণ একটা ভালো ব্যাংক যখন একটা দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিবে, তখন তারা সবদিক বিবেচনা করবে। মার্জ মানে খারাপ ব্যাংক ব্যালেন্স সীট আর ভালো ব্যাংকের ব্যালেন্স সীট এক হওয়া। দায়িত্ব নেয়ার আগে দেখতে হবে যে, ডিপোজিটরদের এগেইনস্টে দুর্বল ব্যাংকের কেমন সম্পদ আছে। সম্ভবত কম সম্পদ থাকারই কথা, কারণ ডিপোজিটের থেকে সম্পদ কম বলেই ওরা দুর্বল।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জে পি মর্গান চেজ যখন বেয়ার স্ট্যারন্সকে অধিগ্রহণ করছিল, তখন বিশাল মূলধনের সমন্বয় ব্যাংকটিকে সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ভারতের স্ট্যাট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ২০১৭ সালে তার পাঁচটি সহযোগী ব্যাংককে একত্র করে একটি বিশাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করে। ফলে এসবিআই এখন আন্তর্জাাতিকমানে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে রয়েছে। এটাও ঠিক যে, যখন বড় বড় ব্যাংক একীভূত হয়, তখন বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যায়। এর ফলে গ্রাহকরা কখনো কখনো বেশি সুদ দিতে বাধ্য হয় বা সেবার মানে অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক অব অ্যামেরিকার একীভূতকরণ অনেক ছোট প্রতিযোগীকে বাজার থেকে সরিয়ে ফেলেছে, ফলে গ্রাহকরা সীমিত বিকল্প পাচ্ছে। আবার বড় ব্যাংক মানেই বড় ঝুঁকি, একটি বিশাল ব্যাংক যদি ভেঙ্গে পড়ে, তবে তার প্রভাব গোটা অর্থনীতিতে পড়ে। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে লেহম্যান ব্রাদার্স এর পতন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। ব্যাংক একীভূতকরণকে অনেক সময় বলা হয় ডাবল-এজড সোর্ড বা দুই ধারাবিশিষ্ট তরবারি। একদিকে এটি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে, মূলধন বাড়ায়, প্রযুক্তি উন্নতি করে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান কমায়, প্রতিযোগিতা হ্রাস করে কখনো কখনো গ্রাহক সেবায় দুর্বলতা আনে।
এটা সত্য যে ব্যাংকগুলো একীভূতকরণে অনেক সুবিধা যেমন আছে এর সাথে সমানভাবে চ্যালেঞ্জও আছে। প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব কর্মসংস্কৃতি, ব্যবস্থাপনা শৈলী এবং পরিচালনা ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ব্যবস্থাগুলো একীভূত করা একটি জটিল এবং সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া একীভূতকরণ প্রায়শই ছাঁটাই, বদলী বা চাকরীর ভূমিকায় পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করে। যা কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করতে পারে, এবং বিক্ষোভ বা ধর্মঘটের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ হলো সরকারের একটি কৌশলগত প্রচেষ্ট যাতে ছোট, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বৃহত্তর, আরোও দক্ষ এবং আর্থিকভাবে স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানে একীভূত করে ব্যাংকিংখাতকে শক্তিশালী করা যায়। একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হলো উচ্চ অ-কার্যকর সম্পদ (এনপিএ) এর মতো সমস্যাগুলো সমাধান করা, পরিচালনাগত দক্ষতা উন্নত করা এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। শক্তিশালী এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক সত্তা তৈরি করে, অর্থনীতির সামগ্রিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করার চেষ্ট করা।
আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাংক একীভূতকরণ এক অনিবার্য বাস্তবতা কোনো দেশই চায় না তার ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকুক। তবে একীভূতকরণ যেন ব্যবসার স্বার্থে শুরু না হয়, বরং গ্রাহক, ব্যাংকার এবং অর্থনীতির সার্বিক স্বার্থ যেন রক্ষা পায় এটা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক নীতি, নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা থাকলে ব্যাংক একীভূতকরণ হতে পারে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক হাতিয়ার।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষ
E-mail : pkroyrajat2016@gmail.com
Posted ২:৪৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy