বিবিএনিউজ.নেট | সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯ | প্রিন্ট | 444 বার পঠিত
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কমানোর ঘোষণা সত্ত্বেও বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণ। আদায়ে ব্যর্থ হয়ে খেলাপি ঋণ কমাতে বিকল্প কাগুজে পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর অন্যতম পদ্ধতি অবলোপন। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এগুলোও খেলাপি ঋণ; কিন্তু খেলাপির প্রকাশিত হিসাবের মধ্যে নেই। অবলোপনের মাধ্যমে তথ্য লুকানোর এই বৈধ পদ্ধতি ব্যাংকিং খাতকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওই ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা নেই। অর্থাৎ অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণ হবে এক লাখ ৫১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই তিন মাসে নতুন করে অবলোপন করা হয়েছে ৫৫৭ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ে অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১৯৯ কোটি টাকা। আগের অবলোপন করা ঋণ থেকে যে পরিমাণ আদায় হয়েছে, তার প্রায় আড়াইগুণ বেশি খেলাপি ঋণ নতুন করে অবলোপন করা হয়। আলোচ্য তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ২৯০ কোটি টাকা অবলোপন করেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯১ কোটি টাকা অবলোপন করেছে যমুনা ব্যাংক। আগের সরকারি ব্যাংকগুলো অবলোপন বেশি করলেও এখন বেসরকারি ব্যাংক অবলোপন পদ্ধতি ব্যাপকহারে ব্যবহার করছে। অবলোপন করা ৫৫৭ কোটি টাকার মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকাই করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এ অবলোপন সত্ত্বেও জানুয়ারি-মার্চ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ কম দেখানোর এই অ্যাকাউন্টিং পদ্ধতি চালু হয় ২০০৩ সালে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ ব্যাংকগুলো সর্বমোট ৫৩ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা অবলোপন করেছে। অথচ এই ১৬ বছরে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এই আদায়ের মধ্যেও সুদ মওকুফ ও পুনঃতফসিল ছাড় সুবিধা গ্রহণ রয়েছে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে আদায় নয়; খাতা-কলমে আদায়। অবলোপন করা ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার মধ্যে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা করেছে সরকার মালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এককভাবে সবচেয়ে বেশি অবলোপন করা ঋণ স্থিতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের সাত হাজার ৮৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণীর চার হাজার ৫২৩ কোটি, জনতার তিন হাজার ৫৯২ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে যারা টাকা নেন, তারা সময়মতো ফেরত দিলে ব্যাংকগুলোকে অবলোপন করতে হতো না। যেহেতু একশ্রেণির ব্যবসায়ী আছেন, যারা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা নেন ফেরত না-দেওয়ার জন্য, ফলে ব্যাংক সেই ঋণগুলোকে শ্রেণিকরণ করতে বাধ্য হয়। একটা সময় ওই ঋণ মন্দ ঋণে রূপ নেয়। বছরের পর বছর সেই ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো হয়তো অবলোপন করে। তিনি আরও বলেন, মন্দ ঋণ ব্যাংকের জন্য দুঃসংবাদ। এটা গলার কাঁটা। কারণ এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। টাকা ফেরত না দেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে না এলে এর কোনো সমাধান হবে না বলেও জানিয়েছেন সাবেক এ গভর্নর।
এদিকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দেন। তবে আদায় বাড়ানোর কোনো কার্যকর কৌশল তিনি ঘোষণা করেননি। ঋণখেলাপিদের নানা ছাড় সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপন নীতিমালা শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৬ ফেব্রুয়ারি জারি করা নতুন নীতিমালায় বলা হয়, বিদ্যমান বিবিধ ঝুঁকির কারণে অনেক সময় ব্যাংকগুলোর ঋণের একটি অংশের আদায় দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, এসব হিসাব বিরূপ শ্রেণিকৃত বলে গণ্য হয় এবং এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী থাকার পরও ব্যাংকগুলোকে ওই ঋণ স্থি’তিপত্রে প্রদর্শন করতে হয়। ফলে ব্যাংকের স্থি’তিপত্রের আকার অনাবশ্যক স্ফীত হয়। এর জন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসারে অবলোপন করার সুযোগ রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা, আইনি কাঠামো যুগোপযোগী করা হয়েছে।
আগের নীতিমালা অনুসারে কমপক্ষে পাঁচ বছর অনাদায়ী থাকলে অবলোপন করা যেত। এখন তিন বছরেই অবলোপন করা যাবে। মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যাবে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ। আগে যেত ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
Posted ১২:০৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed