বিবিএনিউজ.নেট | শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 881 বার পঠিত
ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িত থাকায় এখন বহাল তবিয়তে আছেন ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর নাজিম উদ্দিন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র সার্ভিল্যান্স টিমের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ১০টি অনিয়মের প্রমাণ মেলে। এরই প্রেক্ষিতে নাজিম উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণসহ প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা ও সিটি সেন্টারের কার্যালয় বন্ধের সুপারিশ করেছে তদন্তকারী দল। এমনটাই জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
সূত্র জানায়, মীর নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বীমা আইন লঙ্ঘন, অনিয়ম, জালিয়াতি, অর্থআত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে পরিচয় গোপন করে মোটা অঙ্কের বেতনে নিজের ছেলেকে নিয়োগ, অবলিখন কর্মকর্তাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ, অনভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিয়ে অবৈধভাবে বেতন উত্তোলন, বীমা আইন ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং প্রিমিয়াম হিসাবে গরমিল তথ্য প্রদান উল্লেখযোগ্য।
ছেলের নিয়োগ সম্পর্কে জানা যায়, বীমা কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করা মীর তাসীন ইসমাম আহমেদ রেদোয়ানকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে উন্নয়ন বিভাগের জিএম পদে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি দিয়েছেন। তবে নিয়োগপত্রে একাডেমিক সার্টিফিকেট প্রদানের শর্ত থাকলেও তার ব্যক্তিগত ফাইলে কোনো সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মীর নাজিম জানান, ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে তাকে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা প্রদান করলে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।
অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়নি এমনটা দাবি করলেও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাসীন ইসমাম রেদওয়ানের নামে অতিরিক্ত ব্যবসা সংগ্রহ দেখানো হয়েছে। নথিতে দেখা যায়, তিনি ওই মাসে ১১০টি পলিসির মাধ্যমে মোট প্রিমিয়ামের ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করেছেন। অথচ আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালকের (প্রশাসক) সাথে সাক্ষাতে তিনি ৭-৮টি ইন্স্যুরেন্স পলিসি সংগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তাছাড়া যেখানে হাজারও শিক্ষিত যুবক চাকরি পাচ্ছে না, সেখানে অনার্স করেই মাসে পৌনে চার লাখ টাকা বেতন দেওয়া- সিইও’র বক্তব্যের সাথে অসামঞ্জস্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
এদিকে সার্ভিলেন্স টিম অনুসন্ধানে উচ্চ বেতনে অনভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিয়ে কারসাজির মাধ্যমে টাকা উত্তোলন ও কমিশন প্রদানের প্রমাণ পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানা যায়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত সকল সার্কুলারের নির্দেশনা পরিপালন না করে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স বিভিন্ন কৌশলে অপেশাদার এবং অনভিজ্ঞ লোককে কোম্পানির উচ্চপদে অধিক বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক সুবিধা দিয়ে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। অন্যদিকে গ্রাহককে নির্ধারিত রেটের চেয়ে কম প্রিমিয়াম অফার করে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে নামে-বেনামে উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ করে।
পরবর্তীতে সেলারিশিট পরীক্ষায় দেখা যায়, স্বাক্ষর ছাড়াই এসব কর্মকর্তা বেতন উত্তোলন করেছেন। এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা দেয়ায় সিইও নাজিম উদ্দিনকে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের অফিসে হাজির হতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সকলকে হাজির করতে পারেননি। আবার যাদের উপস্থিত করেছেন তাদের মধ্যে ইন্স্যুরেন্সের ন্যূনতম জ্ঞান তো নেই-ই, এমনকি ইংরেজিতে ইন্স্যুরেন্স বানান পর্যন্ত অনেকে করতে পারেননি। অনেকেই ওই বছরের জুলাইয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কোম্পানির এক কর্মকর্তার স্ত্রীও রয়েছেন। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রতীয়মান হয়, উপস্থিত ব্যক্তিরা ইন্স্যুরেন্সের সার্টিফিকেট এবং বীমা-সংক্রান্ত কাগজপত্র বোঝেন না। তাছাড়া ইন্স্যুরেন্সের বাজার সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। পলিসি গ্রাহককে অবৈধ কমিশন দিতে এবং নিজেরা অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে এ অপকৌশল নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নাজিম উদ্দিন জানান, কোম্পানির ব্যবসা উন্নয়নের লক্ষ্যেই বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদের বেতন-ভাতা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব কর্মকর্তারা অনেকে বেতনশিটে স্বাক্ষর করেন, আবার অনেকে স্বাক্ষর না করেই নগদে টাকা নিয়েছেন। তাছাড়া ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যথাক্রমে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের বৈদেশিক শাখার এসটিডি নং-৪০৩ এর চেক নং- ১৪৪৭১০৯ এর মাধ্যমে মোট ৮ লাখ ১৩ হাজার ১৩৯ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকের হিসাব নং- ১০৭০৬ এর চেক নং- ৩৭০৫২৮৫ এর মাধ্যমে মোট ৬ লাখ ৬১ হাজার ১৯০ টাকা নগদ উত্তোলন করে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের নামে বিতরণ দেখানো হয়েছে। অথচ কর্মকর্তাদের বেতন অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশ রয়েছে। যেহেতু কোম্পানির শাখায় কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি চেকের মাধ্যমে দেয়া হয়নি, ফলে তা কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং- নন-লাইফ ৬৪/২০১৯ এর ৭নং নির্দেশনার লঙ্ঘন। আইন অমান্যের এ দায় এড়াতে পারেন না প্রতিষ্ঠানটির সিইও মীর নাজিম।
অন্যদিকে অবৈধ কমিশন প্রদানসহ অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ভিজিল্যান্স টিম। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ২০১৯ সালে প্রথম প্রান্তিকে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৫৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিটি সেন্টার শাখা আগস্ট ২০১৯ মাসে নিট প্রিমিয়াম আয় করে ২০ লাখ ৪০ হাজার ৯৮৯ টাকা। তবে এ আয় করতে ব্যয় হয়েছে আয়কৃত প্রিমিয়ামের ৪৭.৯০ শতাংশ, যা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্মকর্তা ও এজেন্টদের বেতন ও কমিশন বাবদ দেখানো হয়েছে। পরে ওইসব এজেন্ট ও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের হাজির করতে বলা হলে তাতে ব্যর্থ হন সিইও মীর নাজিম। এক্ষেত্রে সিটি সেন্টার শাখা উক্ত প্রিমিয়াম সংগ্রহের লক্ষ্যে নিট প্রিমিয়ামের ৪৭.৯০ শতাংশ উত্তোলন করে অধিকাংশ পরিমাণ অর্থ পলিসিহোল্ডারকে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় সার্ভিল্যান্স টিমের কাছে। যা বীমা আইন ২০১০-এর ৬০ ধারার বিধানের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তকারী দলটি। কোম্পানির অনুমোদিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের প্রবণতার ফলে কোম্পানির বিনিয়োগ কম হয় এবং দাবি পরিশোধের সক্ষমতা কমে যায়। ফলে গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। একইসঙ্গে আইন ভেঙে কমিশনের নামে গ্রাহককে সুবিধা প্রদান এবং বীমাকারী কর্তৃক অর্থ আত্মসাতের সত্যতাও প্রমাণ করে অতিরিক্ত ব্যয়। অনুমোদিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করে বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ৬৩-এর লঙ্ঘন করা হয়েছে।
আবার কোম্পানির প্রিমিয়াম হিসাবের তথ্যে গোঁজামিলের আশ্রয় নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে এ সিইও’র বিরুদ্ধে। তদন্তকারী দলের রিপোর্টে যার উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যায়, কোম্পানির নিরীক্ষিত রাজস্ব হিসাবের সাথে কোম্পানি প্রদত্ত তথ্যে ২০১৭ সালে ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬১৪ টাকা এবং ২০১৮ সালে ৬৮ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৭ টাকার পার্থক্য বা গরমিল রয়েছে। কোম্পানির ব্যালেন্সশিটেও এ ধরনের গরমিলের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ফলে সার্ভিলেন্স টিমের ধারণা- উক্ত টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং এর সাথে কোম্পানির সিইও জড়িত রয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এরূপ ভুল তথ্য প্রদান বা গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে বিভ্রান্ত করা বীমা আইন, ২০১০-এর ১৩১ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এদিকে উন্নয়ন কর্মকর্তা নামে নতুন পদবি সৃষ্টি করে তাদের একইসাথে নির্দিষ্ট মাসিক বেতন ও ব্যবসা সংগ্রহের ওপর কমিশন প্রদান করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে গ্রাহককে বিধিবহিভর্‚তভাবে কমিশন প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি ছাড়াই তাদের নিয়োগ করার প্রমাণ পেয়েছে আইডিআরএ টিম। এসব উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে গত বছরের আগস্ট মাসে সিটি সেন্টার শাখায় নিট প্রিমিয়ামের ৪৭.৯০ শতাংশ অর্থ বেতন ও কমিশন বাবদ প্রদান করে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, যা মূলত গ্রাহককে অবৈধ কমিশন প্রদানের নিমিত্তে বলেই মনে করছেন তদন্তকারী দল। যাহা বীমা আইন ২০১০-এর ৫৮(১), ৬০ ধারার বিধান এবং কর্তৃপক্ষের সার্কুলার নং- নন-লাইফ৩২/২০১২, নন-লাইফ ৩২(ক)/২০১২ এবং ৩৪/২০১২-এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছেন।
মোহাম্মদ সোলায়মান নামে সিনিয়ম ম্যানেজার পদবির একজন অবলিখন কর্মকর্তাকে লাইসেন্সধারী এজেন্ট হিসেবে দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি যার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কোম্পানির শাখা থেকে প্রদত্ত হিসাব মোতাবেক তিনি এজেন্ট হিসেবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৩১ লাখ ৪৫ হাজার ১৩৫ টাকা ব্যবসার বিপরীতে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৭০ টাকা কমিশন নিয়েছেন। একইসঙ্গে উক্ত মাসে স্থায়ী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপত্রের নির্ধারিত মাসিক বেতন-ভাতাদিও গ্রহণ করেছেন।
তদন্তকালে সিইও মীর নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, সিনিয়র কর্মকর্তা সোলায়মান বীমা এজেন্ট হিসেবে প্রাপ্ত ১৫ শতাংশ কমিশনের মধ্যে ১৪.২৫ শতাংশ হারে অর্থ পলিসি গ্রাহককে বুঝিয়ে দেন। গত বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে কমিশনের প্রাপ্ত টাকা পলিসি গ্রাহককে প্রদান করে ব্যবসা সংগ্রহ করেছেন। এটি যে অনিয়ম তা স্বীকার করেন সিইও। কোম্পানির অধিকাংশ শাখাতে একই ব্যক্তি কর্মকর্তা এবং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি, যা বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ৬৬(১)(গ)-এর পরিপন্থী।
এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাসহ সিইও’র অপসারণ এবং সিটি সেন্টার শাখা কার্যালয় বন্ধের সুপারিশ করেছে সার্ভিলেন্স টিম। সুপারিশের ভিত্তিতে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বীমা কোম্পানিটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এরই প্রেক্ষিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন সিইও মীর নাজিম উদ্দিন। এ বিষয়ে এখনো কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায়, করোনাকালীন পরিস্থিতিকে দায়ী করেন আইডিআরএ সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন।
Posted ২:০১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed