হেলাল সাজওয়াল | বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 38 বার পঠিত
সরকারের নানামুথী পদক্ষেপেও মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ দিশাহারা। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বিপদে আছে; দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটাতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা।
গত মাসে (অক্টোবর) মূল্যস্ফীতি আবারো দুই অংক ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
দেশে মূল্যস্ফীতি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয় কয়েক বছর আগে থেকেই। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনা এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন চাল, ডাল, তেল ইত্যাদির দাম এতটাই বেড়েছে যে মানুষ তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারছে না। খাবারের আয়োজন করতে যতটুকু অর্থের প্রয়োজন তা আয় করতে পারছে না নিম্নবিত্তরা; অনেকের ঘরে নেই খাবার। এদিকে বাজারে বেশী টাকা খরচের কারণে সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না মধ্যবিত্তরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার অন্যতম কারণ ছিল দ্রব্যমূল্য। তাদের আশা নতুন সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমাবে; কিন্তু হয়েছে উল্টা, দাম বেড়েছে আরও। এতে জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজীকরণ সরকারের সবচে বড় কাজ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিকে গতিশীল করতে কাজ করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত দুইমাস ধরে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেও কোন লাভ হয়নি। সর্বশেষ খাদ্য পন্যের শুল্ক কমানোর পর চাল আলু পেয়াজের দাম যেভাবে বেড়েছে; তাতে সরকারের সামনে এখনও প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ।
সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল(টিআইবি) ১৮ নভেম্বর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১০০ দিনে সংস্কার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের তদন্ত ও বিচার, আর্থিক খাত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু শিল্পখাতের চিন্তা করা হয়নি, বিশেষ করে সুদের হার বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে সমস্যা হতে পারে এবং খেলাপি ঋণও বাড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয় নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অস্থিরতা রয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলোর সমাধানে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন, এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে রাজনীতির সংস্কার না হলে অর্থনীতির সংস্কার টেকসই হবে না বলে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া, চাল, পেঁয়াজ ও আলুর আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাস ও প্রত্যাহার, এবং ডিম উৎপাদক বড় কোম্পানি ও ছোট খামারিরা সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি পাইকারি আড়তে ডিম পাঠাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া। এছাড়া ঋণপত্র বা এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানি করা যাবে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান খাদ্য, নিত্যপণ্য ও সার আমদানি করে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কোনো সীমা থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, মূল্যস্ফীতির হার এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে ঢাকার বাজারে ডিমের দাম কমতে শুরু করা বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। গত ১৮ অক্টোবর কারওয়ান বাজারে এক ডজন ডিম বিক্রি হয় ১৪৫ টাকায়, যা আগের সপ্তাহে ১৮০-১৯০ টাকা ছিল। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে ডিমের দাম এখনও ১৫০ টাকার বেশি। ডিমের দুই পাইকারি বাজার কাপ্তানবাজার এবং তেজগাঁওয়ের আড়তদারেরা অভিযোগ করেছেন যে, বড় কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিম সরবরাহ করছে না। অন্যদিকে, বিভিন্ন পাইকারি বাজারে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ইজারা আদায় ও চাঁদাবাজি বন্ধ ঘোষণা করা হয়, ফলে শাকসবজির দাম কমতে শুরু করে, যার সুফল পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দেখা যায়। তবে সুদের হার ও ডলারের দামের কারণে নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানায় তারা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখনো সম্ভব হয়নি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি।
রাজধানীর ডেমরা রোডে চায়ের দোকানদার মো. বরাত হোসেন এই প্রতিবেদককে জানায়; চা বিক্রি করে সংসার চালাই দীর্ঘদিন। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগে থেকেই টানাপোড়েন চলছে। তবে এখনকার সময়টি পার করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কে জানতে চাইলে বরাত বলেন, আমরা গরীব মানুষ অতসত বুঝি না। সরকার কি করবে সেটা পরে আগে জিনিষ পত্রের দাম কমানো দরকার। এর বাইরে আমরা কিছু চিন্তা করতে পারি না।
সংস্কারের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে লাগাম টানার আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন মানুষ সংস্কার চায়, সুষ্ঠু নির্বাচনও চায়। তবে, মানুষের পেটে আগুন লাগলে, সংস্কার ভালো লাগে না। এই সরকারকে প্রথমে পেটের ক্ষুধা দূর করতে হবে, দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। শনিবার নাগরিক ঐক্য ঢাকা মহানগর উত্তর আয়োজিত এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান এর মতে; মূল্যস্ফীতি একটি জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা। এটি কোনো একক নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্যথায় দেশের সাধারণ মানুষকে আরও দীর্ঘ সময় এই সংকটের মধ্যে দিন কাটাতে হবে।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও ডিম আমদানিতে শুল্ক ছাড়, নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, টিসিবি ও ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিবিষয়ক নীতিমালা যুগোপযোগী করাসহ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।
তারপরও বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে।
এতে নতুন করে দাম বাড়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে আটা, ময়দা, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, মুরগি ও গরুর মাংস। মোটা চাল ও চিনির দাম সামান্য হলেও বেড়েছে। সবজির দাম এতদিন চড়া ছিল। কয়েক দিন ধরে কমছে। সব মিলিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে ভোক্তারা। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাজারে এখনো সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেটের কারণেই বাজার ব্যবস্থা রীতিমতো অসহায়।
বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যেকোনো উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ফলাফলের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ফলাফলের নিরিখে এখনো বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাজার শান্ত করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহে তথ্যগত ঘাটতি রয়েছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ বাড়ানো জরুরি।
Posted ৭:৪২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy