রবিবার ১৯ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাতুনগঞ্জ ব্যাংক খাতের আতঙ্ক

বিবিএনিউজ.নেট   |   বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল ২০১৯   |   প্রিন্ট   |   1047 বার পঠিত

খাতুনগঞ্জ ব্যাংক খাতের আতঙ্ক

স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-আছাদগঞ্জ-চাক্তাই ছিল দেশের শতাধিক খাদ্যপণ্যের প্রধান ও বড় পাইকারি বাজার। আর এ বাণিজ্যিক এলাকায় পাইকারি ব্যবসা থেকে গড়ে ওঠে দেশের বড় বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপের। কয়েক বছর আগেও এখানকার ব্যাংকগুলোয় দৈনিক লেনদেন ছিল দেড় হাজার কোটি টাকার অধিক। তবে সময়ের পরিবর্তনে এখন এ এলাকায় কমেছে ব্যাংকিং লেনদেন। আর বেড়েছে খেলাপি ঋণ। পাশাপাশি পাওনা পরিশোধ না করে একের পর এক ব্যবসায়ী উধাও হচ্ছেন, কিংবা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে খাতুনগঞ্জ এখন আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতে, বন্দর, আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যসহায়ক কার্যক্রম এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকায় ভোগ্যপণ্য ও শিল্পপণ্যের পাইকারি বাজার হিসেবে গড়ে ওঠে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-আছাদগঞ্জ-চাক্তাই। আর এ এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শিল্পগ্রুপ টিকে, পিএইচপি, কেডিএস, এস আলম, জিপিএইচ, পারটেক্স, মোস্তফা, এমইবি, নুরজাহান, বিএসএম প্রভৃতি।

জানা যায়, বৃহত্তর খাতুনগঞ্জে (চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ) বিভিন্ন পণ্যের প্রায় ১০ হাজার দোকান বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন মালপত্র কিনতে। শুধু বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) প্রথা বা চেকের বিনিময়ে বাকিতে দৈনিক কয়েকশ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন চলে এ বাজারে।

২০০৬-০৭ সালের দিকে এ বাজারে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হতো। এক দশক আগেও এর পরিমাণ ছিল হাজার কোটি টাকা। আস্থা বা বিশ্বাসের এ বিষয়ই দেশের অন্যসব বাজার থেকে আলাদা করে রেখেছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকে। তবে কয়েক বছর ধরে বিশ্বাসের জায়গায় প্রতারণা ও জালিয়াতি, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং অন্যান্য এলাকায় বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠায় কমেছে পাইকারি বাজারে লেনদেন ও ব্যবসা। গত দুই দশকে এ পাইকারি বাজারে প্রতারণা ও জালিয়াতির কারণে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাতুনগঞ্জের বেশ পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শফি ট্রেডার্স। চিনি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন মোহাম্মদ শেখ আহমদ। বাবার অবর্তমানে শাহ জামাল ব্যবসার দেখভাল করতেন। দীর্ঘদিনের ব্যবসার লেনদেনে শাহ জামাল ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ কোটি টাকার মতো দেনাদার হয়ে যান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে তিনি ভারত চলে যান। অনেক বুঝিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন ব্যবসায়ীরা, কিন্তু টাকা না দিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছেন।

একইভাবে বাদশা শিল্পগ্রুপের এমডি ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের পরিচালক ইসা বাদশা মহসিন, ইয়াসিন গ্রুপের এমডি মোজাহের হোসেন, এএম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী দেবু মহাজন, চাক্তাই রাজাখালী এলাকার ‘শাহ জালাল অয়েল মিল ও শাহ জালাল কনজিউমারের প্রডাক্ট’-এর কর্ণধার মোহাম্মদ সেলিম, খাতুনগঞ্জের মেসার্স মাঈনুদ্দিন ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. মাঈনুদ্দিন, হামিদুল্লাহ খাঁ মসজিদ এলাকায় মেসার্স ফোরকান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. ফোরকান, সোনামিয়া মার্কেটে মেসার্স তানজিনা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নাছির উদ্দিন ও একই মার্কেটের ব্যবসায়ী আবুল হাশেম, রাশেদুল আলম, অর্জুন চন্দ্র বণিকসহ আরও ২৫ জনের অধিক ব্যবসায়ী পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধ না করে পালিয়ে বিদেশ চলে গেছেন। তাদের কাছে ব্যাংক ও পাওনাদার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।

খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের বড় বড় আমদানিকারক বলেন, চার বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের বাজার ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এতে ব্যবসায়ীদের পুঁজি শুধু কমেছে। কারণ এক হাজার ২০০ ডলারের মসুর এখন ৪০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এক হাজার ডলারের ছোলা ৫০০ ডলার, দুই হাজার ২০০ টাকার চিনি এখন এক হাজার ৬০০ টাকা এবং তিন হাজার ২০০ টাকার তেল দুই হাজার টাকায় নেমে এসেছে। ফলে এ সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। উচ্চ দরে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করায় বড় লোকসানে পড়েন তারা। ব্যবসায়িক মূলধন সংকটে পড়ে চলমান রাখতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ এখানকার ব্যবসা হচ্ছে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা। টাকা ঘুরতে ঘুরতে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে এসে অনেকটা বাধ্য হয়ে সরে যেতে হচ্ছে। কোনো ব্যবসায়ী চান না, ব্যবসা গুটিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে।

খাতুনগঞ্জ এলাকার একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ীদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। পণ্যের চাহিদার চেয়েও বেশি পণ্য স্টক করেছেন। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারের খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী অবস্থানে। উদ্যোক্তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অসম প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কারণে অধিকাংশ ব্যবসায়ী চাপে আছেন। এতে কেউ খেলাপি হচ্ছেন, কিংবা উধাও হচ্ছেন, যা আমাদের ব্যাংক খাতের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। খুঁজলে দেখবেন খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যাংকের শাখা লোকসানে আছে। আর লেনদেন তো খুবই কম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের দিয়ে একসময় ব্যাংকগুলো অনেক লাভবান হয়। তারাও প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রুপে রূপান্তর হয়। পরে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যায়, কিন্তু ভালো ব্যবসায়ী তেমন বাড়েনি। অথচ কিছু ব্যাংক অতি মুনাফার লোভে এবং নতুন ও অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নিজে শেষ হয়েছে। সঙ্গে ভালো ব্যবসায়ী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতিও ঝুঁকি বাড়িয়েছে, যা কয়েক বছর ধরে আলোচনায় আসছে। এখন ব্যাংকগুলো খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব শুনলে ভয় পায়। তবে ভালো ব্যবসায়ীদের বিষয় আলাদা।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৩:০১ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল ২০১৯

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।