আদম মালেক | শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 230 বার পঠিত
গুটিকয়েক আমদানিকারকের দখলে দেশীয় চিনির বাজার। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মার খেয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনকে কোনো কোনো সময় উৎপাদন খরচের ৭০ শতাংশেরও কমমূল্যে চিনি বিক্রি করতে হয়। তবুও অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে চিনি। যুগ যুগ ধরে লোকসান গুনতে গুনতে খাদের কিনারে চিনিশিল্প। নেই কোনো আশার আলো। লোকসান এড়াতে চিনিকল বন্ধের সুপারিশ করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় বাজারে তেমন কোনো প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে না সরকারি চিনিকল। তাই লোকসান কমাতে সরকারি চিনিকলগুলো তিন-চারটির মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। বাকিগুলো ধাপে ধাপে বন্ধ করে দিয়ে মিলের জমি বেজা ও বেপজার কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। তারা সেখানে অন্যান্য শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। তাতে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
সূত্রমতে, চিনির বাজারে দেশি আমদানিকারদের আধিপত্য। সরকার চিনি কারখানা বন্ধ করে দিলে এ বাজার সম্পূর্ণ আমদানিকারকদের দখলে চলে যাবে। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। ইচ্ছেমতো দাম বাড়াবে। তাই যুগ যুগ ধরে ভর্তুকি দিয়ে চিনি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে সরকার।
বেসরকারি খাতের সিটি, দেশবন্ধু, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম ও আবদুল মোনেম গ্রুপের মতো পাঁচ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর দখলে দেশীয় চিনির বাজার। বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ লাখ মেট্রিক টন চিনি চাহিদা। এসব কোম্পানির বার্ষিক চিনি পরিশোধনের সক্ষমতা ৩৩ লাখ মেট্রিক টন, যা দেশের মোট চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি। আর সরকারি চিনিকলের উৎপাদন ক্ষমতা অতীতে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি থাকলে ও ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে তা ৮২ হাজার মেট্রিক টনে নেমে আসে।
এদিকে চিনি উৎপাদন করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়া বিএসএফআইসিকে নতুন করে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না সরকার। তাতে অর্থসংকটে পড়েছে করপোরেশন। সে কারণে চলতি মৌসুমে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসছে মৌসুমে আখ উৎপাদন কমে যেতে পারে। সেটি হলে লোকসানের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশি আখের চিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্যসম্মত। অথচ এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কোনো সূচকেই উন্নতি নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের ১৪টিই লোকসানের ভরে ন্যুব্জ। গত ৫ বছরে করপোরেশন লোকসান দিয়েছে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের বোঝা নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে করপোরেশনকে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
বেশি দামে উৎপাদন করে কমদামে চিনি বিক্রির যে রেওয়াজ করপোরেশনে গড়ে উঠেছে, সেটিও তিন দশক আগের। রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গত মৌসুমে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এ চিনিকলের আবার ১৫৮ কোটি টাকার ব্যাংকঋণও আছে। সেই ঋণের সুদ হিসাবে নিলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। সেই চিনি মাত্র ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সা কেজিতে বিক্রি করতে পেরেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। কেবল রংপুর নয়, বাকি ১৪টি সরকারি চিনিকলেই বর্তমান বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে উৎপাদিত হচ্ছে চিনি।
১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মাড়াই মৌসুমে রংপুর চিনিকলের প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের গড় খরচ ছিল সাড়ে ২২ টাকা। আর বিক্রি করা হয়েছিল ১৭ টাকা ২২ পয়সা কেজি দরে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত পাঁচ মাড়াই মৌসুমে রংপুর চিনিকলের প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে গড় খরচ ৩১৯ টাকা ২৫ পয়সা। আর এক কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৪৯ টাকা ৯৫ পয়সায়।
রংপুরের মতোই পঞ্চগড় চিনিকলে গত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ব্যাংকঋণের সুদসহ ৩০২ টাকা। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে ২৯৮, কুষ্টিয়ায় ২৭৩, জয়পুরহাটে ২৬৫, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯, কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে ২০৯, ফরিদপুরে ২০৩, মোবারকগঞ্জে ১৯৩, জিলবাংলায় ১৮০, পাবনায় ১৭৮, রাজশাহীতে ১৬৩, নাটোরে ১৫৯ এবং নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৩১ টাকা ৫৯ পয়সা। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ফরিদপুর চিনিকল গড়ে প্রতি কেজি ৫৭ টাকা ৫৪ পয়সায় বিক্রি করেছে।
সরকারি চিনিকলের মধ্যে তিনটি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে, তিনটি পঞ্চাশের দশকে, সাতটি ষাটের দশকে এবং দুটি স্বাধীনতার পর স্থাপিত হয়েছে। যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।
Posted ৩:২৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed