রবিবার ১৯ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বছরজুড়ে বীমায় আস্থা ফেরানোর লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   122 বার পঠিত

বছরজুড়ে বীমায় আস্থা ফেরানোর লড়াই

বিদায়ী ২০২২ সাল জুড়ে বীমা খাতে ছিল আস্থা আর শৃঙ্খলা ফেরানোর লড়াই। বীমার ইমেজ সংকট দূর করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নানা উদ্যোগ ছিল বছরজুড়েই।

এরইমধ্যে জাতীয় বীমা দিবসকে ‘খ’ শ্রেণি থেকে ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নীত করে সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী দুটি শর্তে পহেলা মার্চ বীমা দিবসকে ‘খ’ শ্রেণি থেকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছেন। এর একটি হলো, কোনো বীমা দাবি বকেয়া থাকতে পারবে না। আরেকটি বীমার ইমেজ সংকট দূরীকরণ বা গ্রাহকের আস্থা ফেরানো।

প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার আলোকে ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের সব লাইফ ও নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে আইডিআরএ। সভায় বীমা শিল্পের বিকাশে এ খাতের সম্ভাব্য উন্নয়ন ও সার্বিক অগ্রগতি এবং সমস্যা নিয়ে মতবিনিময় হয়।
সভায় জীবন বীমা খাতের উন্নয়নে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান। এসব নির্দেশনা পরিপালন হলে বীমা খাতকে শক্তিশালীকরণ ও গ্রাহকের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে বলে মনে করছে আইডিআরএ।

মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওই সভায় গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান। এর অংশ হিসেবে ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যে পলিসিগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে সেসব বীমা দাবি পরিশোধের উপায় সংক্রান্ত বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা অতি দ্রুত আইডিআরএ দাখিল করার নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়া লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর বীমা দাবি পরিশোধের হার বাড়ানো, দ্রুত সকল বকেয়া বীমা দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়া হয়।

ওই সভায়, ২০২৩ সাল থেকে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর সার্বিক পারফর্মেন্সের ওপর গ্রেডিং করা হবে বলেও জানান আইডিআরএ চেয়ারম্যান।

এরপর ধারবাহিকভাবে গ্রাহকস্বার্থ ঝুঁকিতে রয়েছে এমন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালকদের সাথে মতবিনিময় করেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান। সঠিক সময়ে গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ নিশ্চিতকরণ, বীমা খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এই বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হয়।

তবে যে সমস্ত কোম্পানির বকেয়া বীমা দাবি ও গ্রাহকের অভিযোগ তুলনামূলক বেশি, লাইফ ফান্ডের পরিমাণ কম, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে জটিলতা, বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে নানা অনিয়ম দুর্নীতি রয়েছে প্রাথমিকভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

২০২২ সালে নিরীক্ষা ফার্মগুলোর প্রতিনিধিদের সাথেও বৈঠক করে আইডিআরএ। ওই বৈঠকে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোতে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম টার্মস অফ রেফারেন্স বা টিওআর অনুযায়ী বিস্তারিতভাবে পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। একইসঙ্গে প্রতিটি নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ সুনির্দিষ্ট করা, আর্থিক অনিয়ম সংখ্যায় প্রকাশ করা, অনিয়মের প্রমাণক/পরিশিষ্ট সংযুক্ত করাসহ অনিয়মের সাথে কোন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে নিরীক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানায় কর্তৃপক্ষ।

লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ২০১৮-২০২০ সালের ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনার বিষয়ে নিরীক্ষা ফার্মগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সার্বিক কার্যক্রম আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে, বীমা আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে কর্তৃপক্ষ। প্রথম পর্যায়ে ১৩ টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে।

সভায়, টার্মস অফ রেফারেন্সে উল্লেখিত বিষয় অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্ধারিত সীমার মধ্যে আছে কি না তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে নিরীক্ষকদের নির্দেশনা দেয় আইডিআরএ।
এছাড়া বীমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ড, স্থিতিপত্র, বিনিয়োগ, গাড়ির খরচ বিধি বিধানের আলোকে সঠিকভাবে যাচাই করতে নিরীক্ষা ফার্মগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয় আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে। কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাদি/ পারিতোষিক কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত অংকের বেশি নেয়া হচ্ছে কি না তাও যথাযথভাবে নিরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয় সভায়।

সভায় বলা হয়, বীমা কোম্পানি অনেক সময় বাকীতে ব্যবসা করে যা আইনসঙ্গত নয়। এজন্য নিরীক্ষার সময় বাকী ব্যবসার বিষয়টি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও রিইন্স্যুন্সের বিষয়টি যথাযথভাবে নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানায় কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া কোম্পানিগুলো আইন, বিধি-বিধান ও কর্তৃপক্ষের জারিকৃত সার্কুলারসমূহ পরিপালন করছে কি না সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে নিরীক্ষা পরিচালনার জন্য নিরীক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান কর্তৃপক্ষের সদস্য (আইন) মো. দলিল উদ্দিন।

সভায় সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী-ফার্মগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে, টিওআর অনুযায়ী বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, এক্সিট মিটিং দিয়ে নিরীক্ষা কার্য সম্পন্ন করতে হবে, চুক্তি অনুযায়ী সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের আর্থিক প্রাপ্যতা/সুবিধাদি যাচাই করতে হবে, বীমা দাবি পরিশোধ ও সক্ষমতা সম্পর্কে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুনির্দষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে, এজেন্ট লাইসেন্স ও ব্র্যাঞ্চ লাইসেন্স বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণক সংযুক্ত করতে হবে, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কমিশন ও ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য/প্রমাণক সংযুক্ত করতে হবে। এছাড়া সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আউট স্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম ও অর্থ সমন্বয়ের তথ্য প্রমাণক প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খলভাবে বীমা ব্যবসা পরিচালনা এবং গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ধারাবাহিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিদায়ী বছরে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের এসব উদ্যোগ বীমাখাতে যেমন শৃঙ্খলা ফেরাবে, তেমনি দূর করবে গ্রাহক হয়রানি। বছরটিতে বীমা কোম্পানিগুলোতে জনবল নিয়োগ করে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাকচুয়ারিয়াল বিভাগ চালুর নির্দেশনা দিয়ে কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, একটি বীমা কোম্পানি সঠিক ও নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত করতে প্রয়োজন দক্ষ অ্যাকচুয়ারি। ফলে প্রতিটি কোম্পানিতে অ্যাকচুয়ারিয়াল গণিত, পরিসংখ্যান ও সায়েন্স সম্পর্কিত লোকবল নিয়োগ করতে হবে। অপরদিকে কর্তৃপক্ষের জারি করা আরেক প্রজ্ঞাপনে বাংলায় বীমা পলিসি ইস্যুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বীমা পলিসিতে উল্লেখিত শর্তসমূহ এবং পলিসি ইস্যুর সময় প্রয়োজনীয় দলিলাদির তালিকা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় প্রণয়ন ও সরবরাহ করতে হবে। এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও বীমা কোম্পানিগুলোকে পাঠিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

চিঠিতে বলা হয়, বীমা দাবি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত শুনানিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বীমা পলিসিতে বর্ণিত শর্তসমূহ পরিপালন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দলিলাদি বীমাগ্রহীতা কর্তৃক সরবরাহ করতে না পারায় অনেক সময় বীমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে একদিকে যেমন বীমাগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অপরদিকে সংক্ষুব্ধ বীমাগ্রাহক বীমার প্রতি একটি নেতিবাচক বার্তা প্রচার করছে। এতে অন্যরাও বীমা সেবা গ্রহণে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফলে বীমাখাতে কাক্সিক্ষত প্রেনিট্রেশন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক ইস্যুকৃত পলিসি সম্পূর্ণ ইংরেজিতে হওয়ায় অধিকাংশ বীমাগ্রাহক তাদের প্রাপ্যতা এবং প্রযোজ্য শর্তাবলি বুঝতে সক্ষম হন না। বীমা পলিসি বাংলা ভাষায় সহজ-সরল এবং বোধগম্য হওয়া উচিত। এ সকল দিক বিবেচনা করে এবং বীমা খাতের প্রেনিট্রেশন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বীমা পলিসিসমূহ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি ইংরেজির পাশাপাশি সহজবোধ্য বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা প্রয়োজন। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, পলিসি ইস্যু করার সময় দাবি নিষ্পন্নের জন্য প্রয়োজনীয় দলিলাদির তালিকা বীমাগ্রাহককে প্রদান করতে হবে। বীমা পলিসিসমূহ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করে চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

সচেতনতা বাড়িয়ে বীমায় আস্থা সংকট দূর করতে বিদায়ী বছরে দেশের সব বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিক মতবিনিময় সভার উদ্যোগ নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

বিদায়ী বছরে বীমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল বীমা মেলা।

বীমা সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত দাবি পরিশোধ নিশ্চিতকরণ ও বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ২৪-২৫ নভেম্বর বরিশালে আয়োজন করা হয় বীমা মেলা। বীমা মেলাকে সামনে রেখে বরিশাল বিভাগের সব বকেয়া বীমা দাবি পরিশোধের নির্দেশ দেয় আইডিআরএ।

এই বীমা মেলাকে কেন্দ্র করে ৪১ কোটি ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার ২৭৭ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ খাতের বীমা কোম্পানিগুলো। এ উপলক্ষে নতুন বীমা পলিসি ইস্যু হয় ১৪ হাজার ৪২২টি এবং প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয় ৬০ কোটি ১৯ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৪ টাকা।

 

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৬:৫০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।