
নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট | 1328 বার পঠিত
বেসরকারি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রি-ইন্স্যুরেন্স ট্রিটির নবায়ন নিয়ে নয়-ছয় করছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি)। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সোমবার (০৩ মার্চ) পর্যন্ত অন্তত ২৩ টি নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেও ট্রিটি নবায়ন করেনি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে বলা হলেও তাদের দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি বা সমন্বয় না করেই শুধুমাত্র সাধারণ বীমার পাওনার জন্য ট্রিটি আটকে দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় বীমা কর্পোরেশন আইনকে অবজ্ঞা করে ‘শত ভাগ রিইন্স্যুরেন্স বিদেশে নিয়ে যান’ বলেও কোম্পানিগুলোকে সাফ জানিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে। সূত্র বলছে, গত ২৫, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ০১, ০২ ও ০৩ মার্চ দেশের নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়ন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সভা করেছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।
এরমধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি সিটি ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স; ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন ইসলামি ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স; ২৭ ফেব্রুয়ারি পূরবী ইন্স্যুরেন্স, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স; ০১ মার্চ রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি ইন্স্যুরেন্স, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, জনতা ইন্স্যুরেন্স; ০২ মার্চ রূপালী ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ফনিক্স ইন্স্যুরেন্স; এবং ০৩ মার্চ দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স ও মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে সভা করেছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। তবে এখন পর্যন্ত এসব কোম্পানির রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে নন-লাইফ কোম্পানিগুলোর পাঠানো অনিরীক্ষিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে পুনঃবীমা দাবি বাবদ কোম্পানিগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। বিপরীতে পুনঃবীমা প্রিমিয়াম বাবদ কোম্পানিগুলোর কাছে কর্পোরেশনের পাওনা রয়েছে এক হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। এসব পাওনা সমন্বয় করা হলেও সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে কোম্পানিগুলোর পাওনা দাঁড়ায় অন্তত হাজার কোটি টাকা। যদিও বছরটিতে কোম্পানিগুলোর এই পুনঃবীমা দাবির পরিমাণ মাত্র ৫৭৪ কোটি টাকা বলে দাবি করেছে কর্পোরেশন।
এই বিপুল পরিমাণ পুনঃবীমা দাবি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে গত বছরের ২০ মে একটি ত্রিপক্ষীয় সভা করে আইডিআরএ। আইডিআরএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ১০ দফা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার অষ্টম দফায় বলা হয়, কর্পোরেশন ও নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো পুনঃবীমা সংক্রান্ত দেনা পাওনার বকেয়া প্রিমিয়াম ও বকেয়া বীমা দাবির হিসাব ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করবে এবং একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। উল্টো ট্রিটি ক্যান্সেল এবং নবায়ন নিয়ে টালবাহানার মতো ঘটনা ঘটেছে। সভায় ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তি, বীমা আইনের বিধি-বিধানের আলোকে লস এডজাস্টমেন্ট এবং অডিট রিপোর্ট ও ব্যালেন্সশিটের ফিগার দেখে লস এডজাস্টমেন্ট না করার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পুনঃবীমার প্রিমিয়াম আদায়ে যতটা তৎপর; তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ‘অনীহা’ বীমা দাবি পরিশোধে। বিদেশি রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যেখানে শুধুমাত্র সার্ভে রিপোর্ট ও লস ইন্টিমেটেডের ভিত্তিতে পুনঃবীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করে দেয়। সেখানে নানা অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়ে দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে টালবাহানা করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোর এই বিপুল অংকের দেনা-পাওনার বিষয়টি নিষ্পত্তি অথবা সমন্বয়ের জন্য গত বছরের ২৬ ডিসেম্বরেও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতৃবৃন্দ ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা হয়। ওই সভাতেও আইন অনুযায়ী নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যেই পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি এবং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রায়ত্ত পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
কিন্তু তা না করেই এবার রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়ন নিয়ে কর্পোরেশন নয়-ছয় শুরু করেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এসব জটিলতা নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ বা নিষ্পত্তি না করে ট্রিটি নবায়ন আটকে দিয়েছেন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন-অর-রশিদ। শুধু তাই নয় হারুন অর রশিদের পক্ষ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি পুনঃবীমা গ্রহণে অনীহা দেখানো হয়। নির্ধারিত অংশের বাকিটা বিদেশে পুনঃবীমার জন্য বলা হয়। এমন কি এবার ট্রিটি নবায়ন নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সভাকালে শত ভাগ রিইন্স্যুরেন্স বিদেশে করতে বলেছেন তিনি। ওই সভায় অংশ নেয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণ বীমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতো দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে শতভাগ রিইন্স্যুরেন্স বিদেশে দিয়ে দেয়ার কথাও বলেছেন হারুন অর রশিদ। বলেছেন, প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও এনে দেবেন তিনি। হারুন অর রশিদের এই বক্তব্য মূলত বিদেশে অর্থ পাঠানোর দিকেই উৎসাহিত করে। একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবসা না নিয়ে এভাবে বিদেশে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত করতে পারে কি না সেই প্রশ্ন তুলেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। যদিও পরবর্তীতে শতভাগ বিদেশে পাঠানোর এই বক্তব্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন হারুন অর রশিদ।
প্রতি বছর ৩১ মার্চ সাধারণ বীমার সঙ্গে কোম্পানিগুলোর রিইন্স্যুরেন্সের চুক্তি শেষ হয়। ১ এপ্রিলের মধ্যে চুক্তি নবায়ন করে চুক্তিপত্র সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে হস্তান্তর করতে হয়। কোনো কারণে মূল চুক্তিপত্র হস্তান্তরে দেরি হলে সাময়িক একটি চুক্তিপত্র দেয়ার নিয়ম রয়েছে। এই মেয়াদ শেষের আগেই রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়নের জন্য সাধারণ বীমার কাছে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কাছে প্রিমিয়াম বকেয়া থাকায় এর কোনোটিই দেয়নি সাধারণ বীমা করপোরেশন। তবে কোম্পানিগুলো বলছে, বকেয়া প্রিমিয়ামের সঙ্গে রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়নের কোন সম্পর্ক নেই। আর এসবিসি যে পরিমাণ বকেয়া প্রিমিয়ামের কথা বলছে তা সঠিক নয়। হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে প্রিমিয়ামের তুলনায় দাবির পরিমাণও বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দেনা পাওনা সমন্বয় করতে হবে এসবিসিকে। আমাদের বকেয়া পুনঃবীমা দাবি পরিশোধ করলে আমরাও যথা সময়ে সাধারণ বীমার পুনঃবীমা প্রিমিয়াম পরিশোধ করব। কিন্ত তিন মাসের বীমা দাবি ৯ বছর পরে নিষ্পত্তি করলে এটি সম্ভব না। সাধারণ বীমা কর্পোরেশন যথা সময়ে দাবি পরিশোধ না করলেও কোম্পানিগুলোকে আমানত থেকে নির্ধারিত সময়ে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে হয়। কর্পোরেশন যথা সময়ে আমাদের দাবি পরিশোধ না করলে আমরা কীভাবে যথা সময়ে নগদ প্রিমিয়াম পরিশোধ করে রিইন্স্যুরেন্স করব।
খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আইডিআরএ’র ত্রিপাক্ষিক ওই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা সাধারণ বীমা কর্পোরেশন প্রতিপালন করছে না। বীমা কোম্পানিগুলোর পাওনা না দিয়েই উল্টো পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের জন্য চাপ দিচ্ছে। আইনগতভাবে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এটি পারে না। প্রথমত, তাদের কাছে পাওনা বীমা দাবির অর্থ কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করতে হবে। এরপর প্রিমিয়ামের জন্য চাপ দিতে হবে। অথবা দেনা-পাওনা সমন্বয় করতে হবে।
রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়ন নিয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এই জটিলতা নিরসনে কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ সাঈদ কুতুব বলেন, অফিসিয়ালি এখনো এটি নিয়ে কেউ আসেননি। তবে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এসেছে। যা অফিসিয়ালি এখনো দেখা হয়নি। যে কারণে এ বিষয়ে যথার্থ মন্তব্য করতে পারছি না।
Posted ৯:৫০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy