শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে

সানফ্লাওয়ার লাইফের ১৭৫ কোটি টাকা হাওয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   189 বার পঠিত

সানফ্লাওয়ার লাইফের ১৭৫ কোটি টাকা হাওয়া

ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে ১০ বছরে অতিরিক্ত ১৭৫ কোটি টাকা খরচ করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। যা মোট প্রিমিয়াম আয়ের ১৯ শতাংশ। বিশাল এই খরচের কারণে কোম্পানিটি বর্তমানে বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না।

সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গত ২১ নভেম্বর সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সানফ্লাওয়ার লাইফের প্রকৃত এবং অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৫৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং ৩৮৫ কোটি ৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় করেছে ১৭৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
আইডিআরএ মনে করছে, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ কোম্পানির বিশাল এই খরচ বীমা দাবি পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ।

শুধু অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ই করেনি কোম্পানিটি। ধারাবাহিকভাবে কমেছে প্রিমিয়াম আয়। ২০১৭ সালে কোম্পানির নিট প্রিমিয়াম আয় ছিল ১১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা যা ক্রমাগতভাবে কমে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকায়।

প্রিমিয়াম আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক এবং কোম্পানিটি ব্যবসায়িকভাবে যথাযথ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না বলে মনে করছে আইডিআরএ।

শুধু তাই নয়, উচ্চহারে পলিসি তামাদি হচ্ছে কোম্পানিটির। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির মোট তামাদি পলিসির শতকরা হার ছিল ৬৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে তামাদি পলিসির শতকরা হার ছিল ৭২ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তামাদি পলিসির শতকরা হার ৭৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

উচ্চহারে পলিসি তামাদি হওয়ার কারণে কোম্পানির নিট মুনাফা হচ্ছে না। বিক্রিত পলিসি সাধারণত ৫ থেকে ৬ বছর চলমান থাকার পর কোম্পানি পলিসি হতে মুনাফা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এর পূর্বেই পলিসি তামাদি হলে বীমাগ্রহীতা ও বীমা কোম্পানি উভয়েই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বীমাগ্রহীতারাও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গত ৫ বছর ধরে কোম্পানিটির বিনিয়োগ রির্টানের হারও ক্রমাগত কমেছে। ২০১৭ সালে লাইফ ফান্ডের উপর বিনিয়োগ রির্টানের হার ছিল ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। যা ২০২১ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। অলাভজনক খাতে বিনিয়োগের ফলে কোম্পানির বিনিয়োগ রিটার্ন কম হচ্ছে বলে মনে করে আইডিআরএ।
২০২১ সালে কোম্পানির মোট লাইফ ফান্ডের পরিমাণ ১২৫ কোটি ২১ লাখ টাকা যার বিপরীতে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৪৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। লাইফ ফান্ডের বড় অংশ অর্থাৎ ৫৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বিনিয়োগ না করায় কোম্পানির অপরচিউনিটি কস্ট (opprotunity cost) বা সুযোগ ব্যয় অনেক বেশি।

২০২১ সালে নিরীক্ষিত হিসাব প্রতিবেদনের ক্লাসিফাইড সামারি অব দ্য অ্যাসেটস (Classified Summary of the Assets) পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্যাশ অ্যান্ড কালেকশন ইন হ্যান্ড অ্যান্ড কারেন্ট এসটিডি একাউন্টস ইন ব্যাংকস (Cash and collection in hand and current STD accounts in banks) শিরোনামে ৩৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা রয়েছে। মোট লাইফ ফান্ডের ৩২ দশমিক ৬৩ শতাংশ অর্থ তরল সম্পদ হিসেবে রাখার কারণ বোধগম্য নয় বলেও মনে করছে আইডিআরএ। দুর্বল বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কারণে কোম্পানি মুনাফা হতে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানায় আইডিআরএ।

কার্যবিবরণীতে বলা হয়, কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ১৪৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা advance deposit and sundry debtor খাতে রয়েছে। যার পরিমাণ মোট সম্পদের ২৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বিপুল অংকের এই অর্থ উক্ত খাতে থাকা গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

সানফ্লাওয়ার লাইফের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ‘বাংলালায়ন’র জিরো কুপন বন্ডে ৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও কোনো মুনাফা পায়নি কোম্পানিটি। ২০১৯ সালের ৩০ জুন এই বিনিয়োগের মেয়াদ শেষ হলেও ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত কোনো কোনো মুনাফা পায়নি কোম্পানিটি। বর্তমানে বাংলালায়নের বাণিজ্যক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পিপলস লিজিংয়ে ৩৫ লাখ এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স লিমিটেডে ১১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বিনিয়োগকৃত এই অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে কোম্পানির গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়েছে আইডিআরএ।

কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ২০২২ সালে এসে কোম্পানির অনিষ্পন্ন বীমা দাবি রয়েছে ৬ হাজার ৬৫০টি। দাবি বাবদ পরিশোধ করতে হবে ৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অনিষ্পন্ন সকল বীমা দাবি আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নিদের্শ দিয়েছে আইডিআরএ।

আইডিআরএ বলছে, কোম্পানির লাইফ ফান্ড থাকা সত্ত্বেও অনিষ্পন্ন বীমা দাবি পরিশোধ না করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।

বিভিন্ন ব্যাংকে কোম্পানির বিনিয়োগের রয়েছে ২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বার্ষিক হিসাব প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানি ২০০৬ সালে মতিঝিলে ১১ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ৭০ লাখ টাকা বায়না করেছিল। কিন্তু উক্ত জমি এখনো কোম্পানির নামে দলিল হয়নি। এ বিষয়ে কোম্পানির ব্যাখ্যা চেয়েছে আইডিআরএ।

এসব বিষয়ে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মাদ আবু মুসা সিদ্দিকী বলেন, আমি নতুন এসেছি তাই গত ১০ বছরের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়টি আমার জানা নেই।

আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ৩১ ডিসেম্বর মধ্যে বীমা দাবির ৩১ কোটি টাকা পরিশোধের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টিও আমার জানা নেই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিষয়গুলো জানতে হবে।

তবে ২১ নভেম্বরের সভায় সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) আব্দুল মান্নান বলেন, আগে প্রিমিয়াম আয়ের অনেকটাই কাগুজে প্রিমিয়াম ছিল। বর্তমানে প্রিমিয়ামের প্রকৃত হিসাব রাখা হচ্ছে।

ব্যবস্থাপনা ব্যয় অতিরিক্ত হওয়ার জন্য মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও অত্যধিক গাড়ি ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি।

পরিশোধিত মূলধন বিষয়ে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় মূলধনের আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হবে। জমিতে বিনিয়োগ বিষয়ে তিনি বলেন, জমিটি নিয়ে মামলা চলমান আছে।
বাংলালায়নের জিরো কৃপন বন্ডে বিনিয়োগ সম্পর্কে বলেন, এ বিষয়টি মামলাধীন রয়েছে তবে উক্ত অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে তিনি আশাবাদী। কোম্পানিটি এবছর ৮৪ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বলেও জানিয়েছেন আব্দুল মান্নান।

বিষয়গুলো নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পলিসিহোল্ডারদের অর্থ যৌক্তিকভাবে ব্যয় ও বিনিয়োগ করেনি। কোম্পানির বক্তব্য অস্পষ্ট। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, নবায়ন প্রিমিয়াম আয়, বিনিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনা ও বীমা আইন লঙ্ঘিত হয়েছে।

বীমা দাবি পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, বীমা আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি পরিশোধের বিধান রয়েছে। কোম্পানির অনিষ্পন্ন বীমা দাবি পরিশোধের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং লাইফ ফান্ডের অর্থ কোথায় বিনিয়োগ রয়েছে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রদানের জন্য কোম্পানিকে নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি ব্যবস্থাপনা ব্যয় হ্রাস করে অনুমোদিত সীমার মধ্যে আনার জন্য কোম্পানির পর্ষদকে পরামর্শ প্রদান করেন।

প্রিমিয়াম আয় থেকে বীমা দাবি পরিশোধ করার ধারণা সমর্থনযোগ্য নয় বলেও মনে করেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১:২৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।