| রবিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1635 বার পঠিত
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এছাড়া আমাদের আছে ফুল চাষ, পরিচর্যা, গ্রেডিং ও প্যাকেজিং কাজের জন্য সস্তা সহজলভ্য শ্রমিক এবং ফুল চাষের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী। ফুলের পাপড়িবিন্যাস, আকর্ষণীয় রং ও গন্ধের মাধুর্য মানুষের মনকে বিমোহিত করে তোলে। ফুল শুধু মুগ্ধতা ও ভালোবাসারই প্রতীকই নয়, ফুল একটি লাভজন রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য। মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ ও শিল্পিত রুচিবোধের পরিবর্তনের সাথে সাথে সারা বিশ্বে বাড়ছে ফুলের চাহিদা , উৎপাদন, রপ্তানি ও ব্যবসাবাণিজ্য। দারিদ্র্য বিমোচন , কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ফুল চাষের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশ ফুল উৎপাদন ও রপ্তানি করে উপার্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। আফ্রিকার কেনিয়া ও ইথিওপিয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেনিয়া ফুল রপ্তানি করে বছরে আয় করে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এ কাজে এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয় দেশটিতে।
ফুল চাষের সুবিধা অনেক। দানা শস্য , শাক-সবজি ও ফলমূলের তুলনায় ফুল চাষ অধিক লাভজনক। অল্প সময়ে অল্প জমি থেকে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায় এটি চাষ করে। ফুল চাষে পারিবারিক শ্রম ব্যবহারের রয়েছে অফুরন্ত সুযোগ। মাঠের জমি ছাড়াও বসতবাড়ির আশেপাশে, স্কুল-কলেজ, অফিস -আদালত, কল-কারখানার খালি জায়গা, রাস্তার দু’পাশ, সড়ক দ্বীপ, বসতবাড়ির ছাদ, মাটির টব, প্লাষ্টিকের পাত্র, পলিহাউজ ও গ্রীনহাউজে ফুলের চাষ করা যায়। হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াও ফুল চাষ করা হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ও বিদেশে কর্তিত তাজা ফুলের রয়েছে বিপুল চাহিদা।
চুয়াডাঙ্গার কৃষকদের কাছে থেকে জানা যায়, লিংকন জাতের গোলাপের চারা লাগালে ৭ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত ফুল পাওয়া যায়। এতে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর মাসে ফুল বিক্রি করে আয় করা যায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। অপরদিকে হাইব্রিড জাতের গাঁদা ফুলের চাষ করে খরচ বাদে প্রতি বিঘা জমি থেকে তিন চার মাসে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব । গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা ও জারবেরা ফুলের চাষ করে আরো অধিক অর্থ আয় করা যায় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সেখানে থাকে বেশি। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকার নিশিন্দা গ্রামে নিউ এশিয়া গ্রুপ পলিনেট হাউজে উৎপাদন করছে বিশ্বমানের জারবেরা ফুল। উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি অনুুসরণে সেখানে পলিনেট হাউজে ফুল উৎপাদন কার্যকক্রমের কারগরী সহায়তা করছে ভারতের একটি আধুনিক কৃষি সহায়ক কোম্পানি। নিশিন্দা গ্রমের পলিহাউজ থেকে এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার জারবেরা ফুল উৎপাদিত হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর শাহবাগের পাইকারী ফুলের বাজারে, যার প্রতিটির দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ফুল তোলার পাশাপাশি প্যাকেজিং কাজে যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় নারী শ্রমিকেরা, তাদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় কর্মসংস্থান।
ঢাকার সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা ও ময়মনসিংহ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হলেও যশোর জেলার ঝিকরগাছা, শার্শা ও মনিরামপুর উপজেলাতেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রচুর উৎকৃষ্ট মানের ফুল উৎপাদিত হয়। এসব এলাকায় বর্তমানে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাঁচটি ও পরীক্ষামূলকভাবে আরও ছয় থেকে সাতটি জাতের ফুল চাষ হচ্ছে। গত বছর বসন্তবরণ উৎসব, বিশ্বভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের রাজধানী গদখালীতে ৬০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। কারো কারো মতে ওইসব এলাকায় বছরে ২৫০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদিত হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা ও সতেজ রাখতে সহায়তা করে। স্বাভাবিক সময়ে গদখালী ফুলের হাটে দিনে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হলেও বসন্তবরণ উৎসব, বিশ্বভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ফুল বেচাকেনার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৮৩ সালে ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের শের আলী মাত্র ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষের মাধ্যমে দেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন ও বিপণন শুরু করেন। গদখালীকেন্দ্রিক ৭৫ টি গ্রামে এখন ৫ হাজার চাষিসহ ৫ লাখ মানুষ ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ফুল উৎপাদন ও বিপণনের সাথে জড়িত। দেশের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ ফুল আসে এই এলাকা থেকে । বর্তমানে দেশের ২৩টি জেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ৫০ জাতের ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ফুল চাষ ছাড়াও বিক্রয়, বিপণন, প্যাকেজিং, গ্রেডিং, পরিবহন ও ডিজাইনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশের ২০ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফুল শুধু কৃষি পণ্যই নয়, এটি রপ্তানিযোগ্য একটি অর্থকরী ফসল। ফুল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় রাজধানী ঢাকা শহরে একটি আধুনিক ফুলের মার্কেট গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন ফুল বিশেষজ্ঞগণ।
ফুলকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে বিশাল বাণিজ্য ও শত শত কোটি ডলারের বাজার। নেদারল্যান্ডসের আলসামিরে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ফুলের বাজার অবস্থিত।এটি মূলত নিলাম ভিত্তিক একটি ফুলের বাজার। প্রায় ৫লাখ ১৮ হাজার বর্গফুটের এ বাজারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ফুল আসে।প্রতিদিন প্রায় দুই কোটিরও বেশি ফুল বিক্রি হয় এই বাজারে। চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ফুল এই বাজারে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে থাকে। আর বিশ্বের চাহিদার ৪০ শতাংশ ফুল নেদারল্যান্ডস রপ্তানি করে। প্রতি বছর প্রায় ৩২০ কোটি মার্কিন ডলারের ফুল রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুলের বাজার হংহংয়ের মংকক রোডে অবস্থিত। তবে এ ফুলের বেশিরভাগই স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করা হয়ে থাকে। মূলত চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া এখান থেকে ফুল আমদানি করে থাকে। ফুলের বাজার হিসেবে বিখ্যাত হলো লন্ডনে অবিস্থিত কলম্বিয়া রোড। বিশ্বের তৃতীয় এ বৃহত্তম বাজারটি ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । স্পেন, ইসরায়েল, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে থেকে এখানে ফুল আসে। ফুল বিক্রির চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতায় মানিকঘাট। প্রায় ১২৫ বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ বাজারে ফুল বিক্রি করা হচ্ছে।বিশ্ব চাহিদার প্রায় অর্ধেক গাঁদাফুল এ বাজার থেকে সরবরাহ করা হয়। ফুল বিক্রির বাজার হিসেবে পঞ্চম স্থানে ইকুয়েডরের কুয়েনচাবাজার। প্রতিবছর ইকুয়েডর থেকে যে ৮২ কোটি মার্কিন ডলারের ফুল বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্যের শতকরা ৫০ ভাগ ফুলের যোগানদাতা নেদারল্যান্ডস বিশ্বের শীর্ষতম ফুল রপ্তানিকারক দেশ হলেও বর্তমানে ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর ,কেনিয়া ও কলম্বিয়া- এই চারটি দেশ বিশ্বের ৪৪ শতাংশ কর্তিত ফুল রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ৫ থেকে ৭ ধরনের ফুল সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে । এগুলো হলো- গ্লাডিওলাস, সিঙ্গেল ও ডবল রজনীগন্ধা এবং সাদা ও রঙিন গোলাপ। এছাড়া আমদানীকৃত কিছু ফুল মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। অপরদিকে বিদেশ থেকে গাঁদা, লিলিয়াম, থাইঅর্কিড, থাই ও চায়না গোলাপ, কার্নেশন, জারবেরা ¯েœাবল আমদানি করে ঢাকা ও চট্ট্গ্রামসহ দেশের অভিজাত মার্কেটগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। সপ্তাহে ২ দিন ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে বিমানে ফুল আমদানি করা হয় বাংলাদেশে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যমতে, প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে ফুলের বাজার শতকরা ১০ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক বাজারে ফুলের রপ্তানি বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ফুল রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৬ হাজার ডলার। সম্ভাবনাময় এ শিল্পের উন্নয়নে এর সঙ্গে জড়িত কৃষক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং উন্নত ও নতুন নতুন জাতের বীজ সরবরাহ করা, ওয়্যারহাউজ ও কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ এবং সর্বোপরি অবকাঠামো উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ। ফুল উৎপাাদন ও রপ্তানির জন্য বাংলাদেশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রযোজন বলে মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ফুল ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকগণ। পদক্ষেপগুলো হলো- ১. বিশ্বের যেসব দেশে ফুলের বড় বড় মার্কেট আছে সেসব দেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় ফুলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২. বিমানের ভাড়া কামনোসহ কার্গো নিশ্চিত করা এবং কোল্ড ভেসেলে ব্যবস্থা করে রপ্তানিতে সহায়তা করা। ৩. ঢাকা শহরের প্যাকেজিং ও গ্রেডিংয়ের জন্য মার্কেট সংলগ্ন শেল্টার তৈরী করা। ৪. ফুল সতেজ ও তরতাজা রাখা এবং বীজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হিমাগার / ওয়্যারহাউউজ তৈরী করা। ৫. ফুল উৎপাদন, বাজারজাত ও রপ্তানিনীতিমালা প্রণয়ন । ৬. রপ্তানিযোগ্য ফুল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরদার করা। ৭. ফুল চাষি, ফুল ব্যবসায়ী ও ডিজাইনারদের পোস্ট হারভেস্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।৮. ফ্লোরিকালচার ফাউন্ডেশন বা বোর্ড গঠন করে তার আওতায় সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং ফুল চাষি, ফুল ব্যবসায়ীদেরকে উৎপাদন, বাজারজাত, প্যাকেজিং, মার্কেট চেইন বাস্তবায়নের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান। ৯. রাজধানী ঢাকায় এবং দেশের ফুলের রাজধানী গদখালীতে আধুনিক কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিববঙ্গ, আফ্রিকার কেনিয়া, উগান্ডা ও ইথিওপিয়া যদি ফুল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে, তা হলে আমরা পারব না কেন? এদেশে গ্লাডিওলাস, গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা ও অর্কিড ফুলের উৎপাদন ও রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে এসব ফুলের চাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে ফুল দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সূচিত হবে এক নব দিগন্ত।
Posted ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed