বিবিএ নিউজ.নেট | শনিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট | 517 বার পঠিত
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ঐতিহ্যগত দিক হচ্ছে রাজনীতির হাত ধরেই বাংলাদেশের সাংবাদিকতার শুরু। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাংবাদিকতার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের সাহিত্যিক যোগ্যতা অর্থাৎ শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। আমরা যদি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার দিকে তাকাই তবে দেখব, যারা আমাদের সফল সাংবাদিক তাদের প্রায় সবারই একটা রাজনৈতিক অতীত রয়েছে। রাজনৈতিক দল না করলেও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে তারা জড়িত ছিলেন। কিংবা রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। কারণ বাংলাদেশে সাংবাদিকতার শুরুই হয়েছিল রাজনৈতিক একটা উত্তাল সময়ে।
প্রয়াত খন্দকার মুনীরুজ্জামান এমন প্রজন্মের সাংবাদিক, যখন রাজনীতি থেকে প্রায় সবাই সাংবাদিকতায় আসত। আমরা যদি ব্রিটিশ শাসনামলের দিকে তাকাই, তবে দেখি যে ওই সময় প্রায় সবাই নির্দিষ্ট দলীয় মতের পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থানের পরও সাংবাদিকতায় এ ধারা ছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরও আমরা তা দেখেছি। সাংবাদিক মুনীরুজ্জামানও একটি আদর্শিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন। এরপর যখন সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেছেন, তিনি আর দলীয় বৃত্তের ভেতরে আবদ্ধ থাকেননি। পেশাদার, ন্যায়নিষ্ঠ, সুস্থ, সত্য ও একনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। অর্থাৎ তিনি দলের আদর্শ ধারণ করেছেন বটে, কিন্তু সাংবাদিকতাকে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার বানাননি।
সংবাদের ভারপ্রাপ্ত প্রয়াত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, আপসহীন, নীতিবান, আদর্শ সাংবাদিক; নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তার লেখনী ছিল ক্ষুরধার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতিশীল চিন্তা ও গণতন্ত্রের বিকাশে তিনি ছিলেন অবিচল। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখা এ সাংবাদিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ ও রক্ষায় এবং গণমাধ্যমকে গণমানুষের দর্পণে পরিণত করতে খন্দকার মুনীরুজ্জামানের অবদান অনস্বীকার্য।
তিনি সম্পাদকীয় বিভাগে আর আমি বার্তা বিভাগে হলেও কাজের ক্ষেত্রে উভয় বিভাগের মধ্যে আমাদের একটি সমন্বয় ছিল। দেশে যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটত আমরা সবাই মিলে বসতাম। তার বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জায়গা থেকে আমরা মুনীরুজ্জামান ভাই থেকে পরামর্শ চাইতাম।
প্রতিদিন আলোচনার মাধ্যমেই সম্পাদকীয় ও বার্তা দুই বিভাগের তথা গোটা পত্রিকার নীতিনির্ধারণ করতাম। বর্তমানে আমরা কোনো কোনো পত্রিকায় তার বিপরীত চিত্রও দেখি। হয়তো প্রথম পাতায় দেখা গেল মন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলো অথচ সম্পাদকীয় পাতায় রয়েছে সেই মন্ত্রীরই প্রশস্তিগাথা লেখা। অর্থাৎ সম্পাদকীয় নীতির ক্ষেত্রে বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। তিনি কখনো কখনো কোন প্রতিবেদনগুলো কীভাবে করণীয় তা নিয়ে বার্তা বিভাগে আমাদের সহায়তা করেছেন।
আমাদের রিপোর্টারদের করা অনেক নিউজ তিনি উপসম্পাদকীয় বা মন্তব্য কলামে লিখেছেন। তিনি ছিলেন নির্মোহ মানুষ। সাংবাদিকতা করে তিনি অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন, এ ধরনের কোনো মোহ থেকে তিনি সাংবাদিকতা করেননি। তিনি কখনো মনেই করেননি সাংবাদিক হিসেবে বাড়তি একটি সুযোগ তার নেয়া উচিত। এ নিয়ে তিনি কখনো ক্লেদ প্রকাশ করেননি আবার যারা সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেননি। এটি ছিল মুনীর ভাইয়ের মানবিকতার ও সহমর্মিতার একটি বড় দিক।
সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি যেমন শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষদাদের পথ ধরে চলেছেন তেমনি সম্পাদক হিসেবেও বজলুর রহমান, আহমদুল কবীরদের পথে সংবাদকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এমন দৃঢ়, ঋজু ও সাহসী সাংবাদিক আজ কমে যাচ্ছে।
অন্যটি হচ্ছে তার লেখার মধ্যে দেশপ্রেম বোধ। সংবাদের সার্কুলেশন কম হতে পারে, কিন্তু সংবাদের পাঠককুল ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে পত্রিকাটির একটি গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সম্পাদক যেমন আপস করেননি, মুনীরভাই ব্যক্তিগতভাবেও আপস করেননি। তিনি যখন যায়যায়দিন-এ লিখতেন তখনো এটা ছিল। তার লেখার মধ্যে দেশপ্রেম বোধ ছিল প্রবল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র যখন ঝুঁকির মধ্যে পড়ত তিনি সচেতনভাবেই তা উচ্চারণ করতেন যে গণতন্ত্র কী কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে যখন মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বন্ধুত্ব হয়, তিনি তখন তার কলামে লিখেছেন যে বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে যায় না।
যদিও এভাবে লেখার জন্য অনেক সময় তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তার পরও তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশ আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি, সেখানে শুধু ভোটের রাজনীতি করার জন্য কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে যে সমীকরণ তা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি সবসময় স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা। তিনি যা সত্য ও যুক্তিসংগত মনে করেছেন তার দিকে অবস্থান নিয়েছেন।
আমি যখন সংবাদে, তিনি একদিন আমাকে বললেন, একটি গোষ্ঠীর লুটপাটের কিছু কাগজপত্র তার কাছে আছে। যদি এটা নিয়ে নিউজ হয় তাহলে তিনি কলাম লিখতে পারেন। ওই আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি যিনি, তাকে নিয়ে আমরা প্রতিবেদন করি। এরপর মুনীরভাই বিষয়টি নিয়ে কলাম লিখলেন। যদিও কিছুই হয় না। সেই ভদ্রলোক এখন বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একজন হয়ে গেছেন। তবে মুনীরভাই কখনই টেলিভিশন টকশোতে গিয়ে উল্লেখ্য ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে বসেননি।
সাংবাদিকতাকে যারা তাদের সত্তায় লালন করেন, আমার ধারণা মুনীরভাই সেই প্রজন্মের মানুষ। আমরা হয়তো সততার জায়গায় নানা আপস করে ফেলি। নানা লোভ, মোহ বা হুমকির কাছে আপস করে ফেলি, মুনীরভাই কখনো আপস করেননি। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মোহহীন। সংবাদিকতার দীর্ঘ জীবন কাটানোর পরও তিনি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তদবির দূরে থাক, আফসোসও করেননি। এ সময়ের অনেক সাংবাদিকের মধ্যে যে প্রবণতা দেখা যায়। তিনি প্লট, ফ্ল্যাট পাওয়া কিংবা বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য হা-হুতাশ করেননি।
মুনীরভাই খুব সহজ জীবন যাপান করতেন। অপ্রাপ্তিগত কোনো হতাশা যেমন তার মধ্যে ছিল না আবার বিশাল প্রাপ্তির পেছনে ছোটার জন্য আপসও করতেন না। আমি মনে করি মুনীরভাই আমাদের সৎ, স্বচ্ছ, দেশপ্রেম বোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার সাংবাদিকতার একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন। তার চলে যাওয়া আমাদের খুবই দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দিল। আমরা যদি তার গুণগুলোকে অনুসরণ করি তাহলে আমাদের সাংবাদিকতায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আসতে পারে। আমরা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন করি তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছি। তিনি আমাদের বলেছেন, নিজেদের নিরাপদ রেখে কীভাবে সাংবাদিকতা করা যায়। এরশাদের আমলে সাংবাদিকতা করতে কখনো কখনো আমাদের বিপদগ্রস্তও হতে হতো। তিনি আমাদের কৌশলী পরামর্শ দিতেন। আবার কাজটি যাতে হয় সে পরামর্শও দিতেন।
খন্দকার মুনীরুজ্জামান তার আদর্শিক জায়গা থেকেই সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করে গেছেন। টিভি টকশো আলোচনায়ও আমরা তার সেই অবস্থান দেখেছি। আমি মনে করি এটি কেবল মুনীরুজ্জামানেরই শক্তি নয়, বরং সাংবাদিকতারও শক্তি। আপসহীন হিসেবে, সুস্থ সাংবাদিকতা চর্চার উদাহরণ হিসেবে, সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আজকের তরুণ সাংবাদিক ও নতুন প্রজন্মের যারা সাংবাদিকতায় আসতে চান, তাদের জন্য খন্দকার মুনীরুজ্জামান আদর্শ হয়ে থাকবেন।
মুনীরুজ্জামান ভাই অসম্ভব আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতি সব বিষয়ে আলোচনা করতেন। একটা ভালো বই পড়লে আমাদের সে প্রসঙ্গে বলতেন। খুব গান শুনতে পছন্দ করতেন। পুরান ঢাকায় তখন যারা গানের ক্যাসেট বিক্রি করতেন তাদের সঙ্গে মুনীরভাইয়ের সম্পর্ক ছিল। তিনি কার কার গান শুনেছেন তা আমাদেরও মাঝে মধ্যে বলতেন।
খুব কোমল মনের মানুষ হিসেবে আমরা তাকে প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি ছিলেন রুচিশীল ও সংস্কৃতিবান মানুষ। তার সঙ্গে যারাই মিশেছে তার বন্ধু হয়ে গেছে। তিনি অন্যের ওপর রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেননি। তার স্ত্রীও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। সেভাবেই তাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। টিভি টকশোতেও আমি তার সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি কখনই উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন না। যুক্তি দিয়ে দৃঢ়ভাবে কথা বলতেন। সত্যকে অকপটে সত্য বলতেন। বস্তুনিষ্ঠ কথা বলতেন, কাউকে আহত করে কিছু বলতেন না।
তিনি আকৃতিতে ছোট ছিলেন, কণ্ঠের দিক থেকে নিম্নকণ্ঠ ছিলেন, কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। উচ্চকণ্ঠ থাকার সাহসটা তিনি পেয়েছিলেন তার সততার কারণে। আমরা আজ যারা সাংবাদিকতা করি তাদের কাছে সেই প্রজন্ম প্রায় বিলীন, যারা মোহ, প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন না, সততার প্রশ্নে আপস করেন না। এ জায়গায় এখনকার সাংবাদিকদের মধ্যে আমার ধারণা মুনীরভাই বিরলদের মধ্যে একজন।
Posted ৫:৩০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy