নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪ | প্রিন্ট | 60 বার পঠিত
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি ফিরতে শুরু করেছে। কারফিউ শিথিল হওয়ার পর থেকে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে তৈরি পোশাক শিল্পে। তবে গেলো কয়েকদিনের বন্ধে পোশাক খাতের ক্ষতি অন্তত পৌনে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য জানিয়েছে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তবে রপ্তানিকারকরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে আরও বেশি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলছেন, প্রতিদিন রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস খাতে উৎপাদন এর গড় মূল্য প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গেলো পাঁচদিনে এ শিল্পের সহযোগী খাত মিলিয়ে ক্ষতি প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে সব চেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের ভাবমূর্তির।
গার্মেন্টস মালিকরা জানান, সুযোগ বুঝে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চাইতে পারে ডিসকাউন্ট বা মূল্যছাড়, কমাতে পারে ক্রয়াদেশও। অন্যদিকে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে বেশি ভাড়ায় নিতে হবে আকাশ পথের আশ্রয়, কাজও করতে হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময়।
গেলো কয় দিনের সহিংসতা এবং কারফিউতে বন্ধ ছিলো সরকারী ও বেসরকারি অফিসসহ বেশিরভাগ শিল্প কারখানা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাণিজ্যের জন্যও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো বাংলাদেশ। বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পণ্য উঠানামাও ছিলো বন্ধ।
বাঁধন ফ্যাশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান মনির জানান, এগুলোর প্রভাবে কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি সব কিছুই ছিলো স্থবির, ক্ষতির পরিমাণও বড়।
কয়েকবার রপ্তানি ট্রফি পাওয়া রপ্তানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রয়াদেশ গ্রহণ এবং তৈরি পণ্য জাহাজীকরণ করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক শাহজাহান সিদ্দিকী বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগ এবং বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম ইন্টারনেট। সপ্তাহব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি দেশের ইমেজও নষ্ট হয়েছে যা অপূরণীয়।
বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে এ খাত থেকেই, প্রতি মাসে গড় আয় তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি।
দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিসহ টানা পাঁচ দিন ব্যাংক বন্ধ থাকার পর দুই দিন (বুধ ও বৃহস্পতিবার) চার ঘণ্টা করে ব্যাংকের সীমিতসংখ্যক শাখা খোলা ছিল। এ সময় টাকা জমা দেওয়া ও তোলা ছাড়া ব্যাংকে অন্য কার্যক্রম তেমন একটা ছিল না। অনেকেই চেষ্টা করেও এলসি খুলতে পারেননি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তৈরি পোশাক শিল্পের চট্টগ্রামের কিছু কারখানা চালু থাকলেও দেশের বেশিরভাগ কারখানা ছিল বন্ধ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সহিংসতার কারণে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধের পর ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হলে দেশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২৩ জুলাই থেকে চট্টগ্রামের শিল্পকারখানা খোলার অনুমতি দেয় সরকার। পরদিন ২৪ জুলাই ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের ভালুকাসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। একইদিনে সীমিত আকারে ব্যাংকগুলোতে লেনদেনের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ দেওয়া হয়। এতে রফতানিকারকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এলেও সর্বোপরি ব্যবসায়ী মহলে এখনও উদ্বেগ বিরাজ করছে। কারখানা বন্ধ থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের ‘ইমেজ নষ্ট’ করার জের কতদিন টানতে হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন কয়েক হাজার গার্মেন্টস কারখানার মালিক।
ইন্টারনেট-সেবা ব্যাহত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে অর্ডার (ক্রয়াদেশ) ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সাধারণত ডিসেম্বরের দিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে ছুটি ও ভ্রমণের আমেজ থাকায়Ñ তখন বাংলাদেশের রফতানি পণ্য ভালো বিক্রি হয়। ওই সময়ের অর্ডার (ক্রয়াদেশ) পেতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম নমুনা পাঠাচ্ছে ক্রেতা দেশগুলোতে। এ ক্ষেত্রে গত কয়েকদিনের স্থবিরতায় বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট-সেবা না থাকায় অনেকেই নমুনা পাঠাতে সমস্যায় পড়েছেন বা পিছিয়ে পড়েছেন।
অনেকেই বলছেন, ইন্টারনেট ও যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের ‘আস্থার’ যে সংকট হয়েছে, তার মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে। এর জেরে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ২০ শতাংশ রফতানি কমে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
বিজিএমইএ’র একাধিক সদস্য বলেছেন, অনেক ক্রেতা আছেনÑ যারা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজ দেশে বসে দেখেন ও জানতে পারেন। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা এখন আস্থা পাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ‘গার্মেন্টস কারখানা চালু করা সম্ভব হয়েছে। এতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ও নির্ভরতায় ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এই ঘটনার ফলে আমাদের ভাবমূর্তির যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা টাকার অঙ্কে প্রকাশ করা কঠিন। এই সুনামের ক্ষতি হয়তো আমাদের বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে। এর রেশ কাটতে কতদিন সময় লাগবে, তা কেউ বলতে পারবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে (২০২৪) পর্যন্ত বাংলাদেশ আয় করেছে ৩৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবি (রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো) তাদের প্রকাশিত তথ্যে দেখিয়েছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের (২০২২-২৩) একই সময়ে ছিল ৪২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
ইপিবির হিসাবে বাংলাদেশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি থেকে আয় করে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক রফতানি থেকে আসে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ কয়েকদিনের স্থবিরতায় সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সবচেয়ে বড় এই খাতেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারফিউ শিথিল ও ইন্টারনেট ফেরার পর উৎপাদন স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও পরিস্থিতি আগের মতো হতে দুই-তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে।
Posted ১:৫৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy