
নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 351 বার পঠিত
ভোট ছাড়াই বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতৃত্ব দখলের কুশীলবদের অপতৎপরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একটি মহল অতীতের মতো এবারও অনুগতদের নিয়ে বিআইএ’র নির্বাহী কমিটি গঠন করতে চায়।
আর এর অংশ হিসেবে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী এমন অনেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে সমঝোতার কমিটি গঠনের পায়তারা চালাচ্ছে তারা। এর নেপথ্যে রয়েছেন পতিত শেখ হাসিনা সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বিতর্কিত একজন প্রবীণ ব্যবসায়ী। যিনি একটি বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান। যার নিজের প্রতিষ্ঠানই ভুড়ি ভুড়ি অনিয়মে ডুবে আছে। স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে যার বিচারের দাবিতে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে পোস্টারিং করেছে ব্যবসায়ী সমাজ।
অথচ এই বিতর্কিত ব্যক্তিই একজন উপদেষ্টার দোহাই দিয়ে ‘সমঝোতার’ আড়ালে কমিটি করতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে সংগঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ভোট ছাড়া ভিন্ন কোনো ফর্মুলায় বিআইএ’তে কোনো নেতৃত্ব মেনে নিতে নারাজ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিতর্কিত ওই ব্যবসায়ীর ফর্মুলায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন এমন অনেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। যাতে কমিটিতে তার সিন্ডিকেটের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা ভোটার হলেও তারা মূলত কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করেন। যে সমস্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা বিআইএতে ভোটার হয়েছেন তাদেরকে মূলত পরিচালনা পর্ষদই মনোনয়ন দিয়েছেন। কেউ একক সিদ্ধান্তে যেমন ভোটার হননি, তেমনি নির্বাচনেও একক সিদ্ধান্তে প্রার্থী হননি। পরিচালনা পর্ষদের ইচ্ছার আলোকেই তারা প্রার্থিতা করছেন। সুতরাং কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রার্থিতায় নিরুৎসাহিত করার অর্থ মূলত ওই কোম্পানিকেই বিআইএতে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা।
ইতিমধ্যে বিনা ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে গত ২৩ জানুয়ারি এক পত্রের মাধ্যেমে বিআইএ হলরুমে প্রার্থীদের নিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক পরামর্শমূলক মতবিনিময় সভা ডাকেন বিআইএ’র প্রথম সহসভাপতি ও সিটি ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান হোসেন আখতার। ওই দিনই ব্যাংক বীমা অর্থনীতি পত্রিকাতে ‘ফের বিনা ভোটে বিআইএর’র নির্বাচনের তোড়জোড়’ শীর্ষক খবর প্রকাশিত হলে তড়িঘড়ি করে সভার স্থান পরিবর্তন করে সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের নিজস্ব অডিটরিয়ামে সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভাতেও একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রার্থীতায় নিরুৎসাহিত করে বক্তৃতা দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটি আরো জানায়, সভায় ওই চেয়ারম্যান বলেন, ‘মুখ্য নির্বাহীরা কেন ইলেকশন করবেন? তাদেরকে যদি কোম্পানি থেকে বাদ দেয়া হয় তাহলে কী করবেন?’ তার ওই বক্তৃতায় সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন অনেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাই পরবর্তীতে নিজস্ব পরিমন্ডলে বিরুপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।
বিআইএ সুত্রে জানা যায়, ১৯৮৯-৯০ মেয়াদে বিআইএ’র প্রথম প্রেসিডেন্ট ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এম. মাইদুল ইসলামের কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন সাফাত আহমেদ চৌধুরী। যিনি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। মাইদুল ইসলামের পর ১৯৯৯-২০০০ মেয়াদে বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এম .এ সামাদ, যিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি-(বিজিআইসির) চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে আজিজুল হক চৌধুরীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে তিনি চেয়ারম্যান হন।
এরপর ২০০১-২০০২ মেয়াদে বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট হন গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির এ চৌধুরী। তিনি দুই মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৫-২০০৬ মেয়াদে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হন এম. শামসুল আলম, তিনি রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। এরপরের মেয়াদে ২০০৭-২০১০ সাল পর্যন্ত বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন একেএম রফিকুল ইসলাম, এফসিএ তিনিও প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। সুতরাং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা মুখ্য নির্বাহীরা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংগঠনটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটি ঐতিহ্যগতভাবেই চলে আসছে। এতে কখনোই কেউ আপত্তি তোলেননি। সুতরাং এবারও মুখ্য নির্বাহীরা বিআইএ’র নির্বাচনে প্রার্থী হলে কিংবা নেতৃত্বে আসলে সংগঠনের মর্যাদা বা ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হবে না বলে অংশীজনরা মনে করছেন।
২৩ জানুয়ারির সভায় উপস্থিত ছিলেন না এমন প্রার্থীদের নিয়ে ‘বিনা ভোটে কমিটি’ গঠনে তৎপর মহলটি ৩ ফেব্রুয়ারি আাবারও একটি সভা ডাকতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। যেখানে মূলত সমঝোতার কমিটির ফর্মুলা নিয়েই কথা বার্তা হতে পারে। সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের অফিসে এই সভারও নেপথ্যে রয়েছেন বিতর্কিত সেই চেয়ারম্যান।
এর আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের সঙ্গে পরামর্শমূলক সভা করতে গত ২২ জানুয়ারি সংশ্লিষ্টদের কাছে একটি চিঠি পাঠান বিআইএ’র প্রথম সহসভাপতি ও সিটি ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান হোসেন আখতার। চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রিয় সম্মানীত মনোনয়ন জমাদানকারী (বিআইএ)। বিআইএ-এর ইসি নির্বাচনে লাইফের ক্ষেত্রে ১০টি শূন্য পদে ১৪ জন এবং নন-লাইফের ক্ষেত্রে ১০টি শূন্য পদে ২১ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে আপনিও একজন। বিআইএ-এর সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন ও সম্প্রীতি সুসংহত ও বজায় রাখার লক্ষ্যে নির্বাচন প্রাক্কালে মনোনয়ন জমাদানকারীবৃন্দের মধ্যে একটি পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ পরামর্শমূলক মতামত বিনিময় ও প্রদানের জন্য এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অনুষ্ঠান আগামী ২৩/০১/২০২৫ইং, বেলা ১২ টায় বিআইএ হলরুমে আয়োজন করা হয়েছে। এসোসিয়েশনের সম্মানীত সভাপতি সাহেবও উপস্থিত থাকবেন। উক্ত অনুষ্ঠানে আপনি নিমন্ত্রিত। আপনাকে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। আশা করি, আপনি উপস্থিত হয়ে মত বিনিময় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করবেন।’ হোসেন আখতার নিজেও একজন প্রার্থী। তবে পরবর্তীতে বিতর্কের মুখে বিআইএ হলরুমে ওই সভা না করে স্থানান্তর করা হয়। এমনকি হোসেন আখতার একজন প্রার্থী হয়ে অন্য প্রার্থীদের চিঠির মাধ্যমে এভাবে ডেকে এনে পরোক্ষভাবে সমঝোতার নামে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের দিকে উৎসাহিত করার বিষয়টি ভোটার এবং অন্যান্য প্রার্থীরা ভালোভাবে নেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রার্থী জানান, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মাহিনও তার কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে অনেক প্রার্থীকে এই অনুষ্ঠানে ডাকেন। আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ নিজেও এই নির্বাচনে একজন প্রার্থী।
এ ধরনের সভা ডাকায় ফের ১৪ বছর আগ থেকে শুরু হওয়া সমঝোতার নামে বিনা ভোটে নেতৃত্ব বেছে নেয়ার ফর্মুলা প্রয়োগের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ ১৪ বছর পর উৎসবের আমেজ ফিরে এসেছে বীমা কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিআইএ’র নির্বাচনে। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এরইমধ্যে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রার্থী হয়েছেন ৩৫ টি কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে লাইফ বীমার প্রার্থী রয়েছেন ১৪ জন এবং নন-লাইফে ২১ জন। উভয় খাতে ১০ জন করে মোট ২০ জন কার্য নির্বাহী সদস্য নির্বাচন করা হবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ দিন পর এই নির্বাচনের মাধ্যমে আরো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিআইএ’র নতুন কমিটিতে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি দেশের বীমা খাতের জন্য খুবই ভালো। যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিআইএ’র দায়িত্বে আসলে তাদের নতুন চিন্তার সংমিশ্রণ বীমার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে গঠনতন্ত্র বহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট পদ আকড়ে ছিলেন শেখ কবির হোসেন। ৮২ বছর বয়সী শেখ কবির হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি ভাই। সে হিসেবে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্ঞাতি চাচা। এসব পরিচয়েই তিনি বিআইএ’সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদ আকড়ে ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিআইএ’র চেয়ারম্যান পদ আকড়ে থাকা শেখ কবির বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এটিকে মালিকদের সংগঠনে পরিণত করেন। অথচ এটি মূলত বীমা কোম্পানিগুলোর সংগঠন।
তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পলায়ন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২১ অক্টোবর বিআইএ’র প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ কবির হোসেন।
বিআইএ’র বর্তমান নির্বাহী কমিটির (২০২৩-২০২৪) মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল। তবে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন পদত্যাগ করায় প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ (পাভেল) অবশিষ্ট সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গত ২৮ অক্টোবর সংগঠনে ২১৮তম নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি এ দায়িত্ব পান।
২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর বিআইএ’র ২০২৫-২০২৬ সালের নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দেয়া হয়। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী সদস্য নির্বাচনের পর ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট। এ বছর সংগঠনটির ৮০ জন সদস্যের মধ্যে ৭৬ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বলে জানা গেছে।#
Posted ৯:০৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy