বিশেষ প্রতিবেদক | বুধবার, ১৮ নভেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 1497 বার পঠিত
একটা সময় সাধারণ বীমা খাতে প্রিমিয়ামের টাকা না নিয়েই পলিসি ইস্যু করে ঝুঁকি বহন করার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। ফলে হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায় গ্রাহক বা কোম্পানি লাভবান হলেও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতো ঝুঁকিবহনকারী বীমা কোম্পানিকে। এরূপ ক্রমাগত ক্ষতির মুখে একসময় নিঃস্ব হয়ে পড়তো বীমা কোম্পানি। একইসাথে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তো কোম্পানির ভালো গ্রাহক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। সে সময়ে এ-ধরনের বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে দেখা যায়, দাবি উত্থাপন করা গ্রাহক বা কোম্পানি ও ঝুঁকিবহনকারী বীমা কোম্পানির মালিকপক্ষের যোগসাজশেই ঘটতো এসব অনিয়ম। অনেক সময় বীমা কোম্পানির পরিচালকদের নেতৃত্বাধীন অন্য কোম্পানি এমন দাবি উত্থাপন করে ঝুঁকিবহনকারী কোম্পানির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এসব অপকর্ম বন্ধসহ বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১০ সালের ১৮ মার্চ ‘বীমা আইন-২০১০’ পাস করে সরকার। যেখানে রয়েছে বাকি ব্যবসা বন্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এরপরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এ আইন ক্রমাগত লঙ্ঘন করে চলেছে। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নানামুখী উদ্যোগ ও তৎপরতার পরও সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়নি অনৈতিক এমন কর্মকাণ্ড। গুটিকয়েক কোম্পানির অসাধু পরিচালকদের প্রচেষ্টায় এখনো চলছে বাকি ব্যবসা। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। যেখানে স্বয়ং চেয়ারম্যানই অবৈধভাবে পদ আঁকড়ে ভোগ করছেন নানামুখী সুবিধা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ কয়েকজন বিনিয়োগকারীর।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আজিজ আহমদ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার শর্তই পূরণ করতে পারেননি, অথচ তিনি এখন কোম্পানির প্রধান ব্যক্তি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের গত ২১ মে ২০১৯ এর প্রজ্ঞাপনে পরিচালকদের স্বতন্ত্রভাবে ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং যৌথভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে মোতাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ আজিজ আহমদের ২ শতাংশ হিসেবে ৮ লাখ ৯০ হাজার শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা ছিল। অথচ তিনি শেয়ারধারণ করেছেন মাত্র একটি! এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ প্রচারিত হলেও তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই বাকি ব্যবসা করে বীমা আইন ও আইডিআরএ’র নির্দেশকে ক্রমাগত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে স্বয়ং প্রতিষ্ঠানটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এতে দেখা যায়, কোম্পানির ২০১৮ সালে বাকি ব্যবসার পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫০ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৩ টাকা। অথচ মাত্র একবছরের ব্যবধানে বাকি ব্যবসার আরো ১ কোটি ১১ লাখ ৪ হাজার ৯৫২ টাকা এর সাথে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাকি ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ ৪ হাজার ৫৭৫ টাকা। এটাও আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি!
মূলত ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির বাকি ব্যবসা ১২ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমনটাই জানিয়েছে স্বনামধন্য কয়েকটি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, ২০১৯ সালে ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রিমিয়াম ও অন্যান্য আয় বাবদ ৩৫ কোটি ৩ লাখ ২ হাজার ৩৯৮ টাকা সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে শুধু অন্যান্য আয়ের ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৬১ টাকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপারেশনাল আয়ের সংগ্রহ ৩১ কোটি ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৭ টাকা। কিন্তু একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা দেখিয়েছে ৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ১ হাজার ৪৫৫ টাকা। এক্ষেত্রে প্রদর্শিত ব্যবসা ও সংগৃহীত আয়ের পার্থক্যই হলো বাকি ব্যবসা, যার পরিমাণ ১২ কোটি ২৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৮ টাকা।
বিশ্লেষণকৃত বাকি ব্যবসার সাথে কোম্পানির স্বীকারোক্তিমূলক বাকি ব্যবসার পরিমাণ যুক্ত করলে মোট বাকির পরিমাণ হয় ১৭ কোটি ৯১ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৩ টাকা। এ বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করতে না পারলেও কোম্পানির আয় খাতে তা প্রদর্শন উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞমহল। তাদের মতে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতেই প্রতিবেদনে এমন অদৃশ্যমান ব্যবসা দেখানো হয়। মূলত একটি কোম্পানি যখন তার পরিচালনা পর্ষদের অনৈতিক ইচ্ছার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে তখনই এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা দৃশ্যমান হয়।
এ অনিয়মের জন্য বীমা আইন-২০১০ এর শাস্তির বিধানও উল্লেখ রয়েছে। বীমা আইনের ধারা ১৩০ অনুযায়ী নির্দেশ লঙ্ঘনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এককালীন ৫ লাখ টাকাসহ অব্যাহত লঙ্ঘনে প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আবার যদি মিথ্য দলিল, বিবরণী, হিসাব, রিটার্ন বা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তবে এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এছাড়া ধারা ১৩৪ অনুযায়ী আইন লঙ্ঘনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১ লাখ বা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা জরিমানাসহ লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা দণ্ড ধার্য করতে পারবে আইডিআরএ।
বিনিয়োগকারীদের মতে, কোম্পানির এমন অনৈতিক কর্মের দায়ে যদি আইডিআরএ বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার শাস্তির মুখে পড়তে হয়, তবে এ শাস্তির আসল ভুক্তভোগী হবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তাই পুঁজিবাজারভুক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে শৃঙ্খলা ফেরাতে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানি সচিব ইমরান হাসানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কোম্পানির চেয়ারম্যানের নামের বানান সঠিক করার পরামর্শ দেন। তবে অন্য কোনো বিষয়ে আপত্তি না তুলে পরোক্ষভাবে অনিয়মগুলোর বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেন।
Posted ১১:০০ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৮ নভেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed