বিবিএনিউজ.নেট | সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 1030 বার পঠিত
একের পর এক অনিয়ম হওয়ার পরও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় বেড়েই চলেছে পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সিইও সুকুমার চন্দ্র রায়ের অপকর্ম। একদিকে দক্ষতার অভাব, অন্যদিকে নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ফলে একসময়ের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এতে যেমনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগকারীরা, তেমনিভাবে ভোগান্তিতে পড়েছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাও। এরপরও নির্বিঘ্নে চলছে অনিয়মের মহোৎসব। যার নেপথ্যে রয়েছে সিইও’র ভূমিকা। এমনটাই জানা গেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে।
সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যমে পূরবী জেনারেলের পরিচালকদের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পরিচালকদের সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এরপরই এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে ব্যাংক বীমা অর্থনীতি। এরপর নিয়মবহির্ভূত হওয়ায় তড়িঘড়ি করে পাঁচ পরিচালক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে অন্যান্য পরিচালকদের শেয়ার ধারণে ব্যর্থতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্যাংক বীমা অর্থনীতি। এরপর বিষয়টি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়। বিএসইসি’র অনুসন্ধানেও ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসে। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ ইকবাল নামে আরেক পরিচালকের পদ শূন্য ঘোষণা করে বিএসইসি। এরপরও নিয়মবহির্র্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধ করেনি পূরবী জেনারেল। সর্বশেষ তথ্যমতে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদের ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেখানে ২৯.১৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করেছেন কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুল ইসলাম পান্না। উল্লেখ্য, এ সকল অনিয়মের নেপথ্যে সিইও সুকুমার চন্দ্র রায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানা যায়। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ২য় পর্ব :
আন্ডার পেইড সুকুমার রায় পরিণত হয়েছে ব্রিফকেস সিইওতে:
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সুকুমার চন্দ্র রায়। একজন সিইও’র আসল যোগ্যতা হলো, আইন পরিপালনের মাধ্যমে কোম্পানি পরিচালনা করা এবং প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জনের ধারা বজায় রাখা। এরূপ করতে কেউ যদি সমর্থ না হন, তবে তাকে ব্যর্থই বলা যায়। সেক্ষেত্রে কোম্পানি পরিচালনায় সুকুমার চন্দ্র রায়ের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
তিনি সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকা বেতন গ্রহণ করে করপোরেট কালচার নষ্টসহ সিইও’র মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ পদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন, যা প্রথম প্রজন্মের অনেক বীমা প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকদের পারিতোষিকের সমতুল্য। মাত্র ৪০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে পূরবী জেনারেলের সিইও হতে সম্মতি জানানোয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক সদস্যই বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৬ মে আইডিআরএ সদস্য গোকুল চাঁদ দাসের অতি উৎসাহে সুকুমার চন্দ্র রায়কে সিইও’র অনুমোদন দেয়া হয়। এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় গুঞ্জনসহ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এ অনুমোদনের মাধ্যমে পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ঘাড়ে চেপে বসে সিইও নামক এক ভাঁড়। প্রতিষ্ঠানে ১৬টি গাড়িবহর থাকলেও সিইও’র ভাগ্যে জোটেনি একটি গাড়িও। আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, সিইও’র অনুমোদন পাওয়ার জন্য দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। সে সময় তার বিভিন্ন অযোগ্যতাকে কারণ দেখিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত হলফনামার কৌশল অবলম্বন করে তাকে অনুমোদন পেতে হয়। প্রতিদিনই বাসে বা ট্রেনে করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে অফিস করতে হয় সিইওকে। অনেক সময় গাড়িভাড়ার জন্য পিয়নদের দ্বারস্থ হতে হয়। এ বিষয়ে সিইও জানান, অধিকাংশ গাড়ি চেয়ারম্যানের ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যামিকোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিইও’র জন্য গাড়ি নির্দিষ্ট থাকার বিধান থাকলেও তা পাচ্ছেন না, যা মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা- ২০১২-এর ৮(২)(গ) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান মুজিবুল ইসলাম পান্নার সাথে যোগাযোগ করা হলে জানান, অনেক পুরোনো হওয়ায় গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও সিইও’র বিপরীতমুখী বক্তব্যে ধাঁধায় পড়েছে এ প্রতিবেদক। উল্লেখ্য, শুরু থেকেই সিইও সুকুমার রায় তার অন্যান্য কাজের পাশাপাশি সিএফও’র অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। যে কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন ও কোম্পানির প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে তাকে দু’তিন রাত পর্যন্ত কার্যালয়ে অবস্থান করে কর্মসম্পাদন করতে হয় বলে অফিস সূত্রে জানা গেছে। এক্ষেত্রে যাকে প্রতিষ্ঠানটিতে সিএফও দেখানো হচ্ছে তা শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তিনি সহযোগী প্রতিষ্ঠান সন্ধানী লাইফে কাজ করেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্বয়ং সিইও সুকুমার চন্দ্র রায়।
একই ব্যক্তির সহযোগী একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা:
যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ব্যতিরেকেই পূরবীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন সহযোগী প্রতিষ্ঠান সন্ধানী লাইফের কর্মকর্তারা। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড ৩ জুন ২০১৮-এর নোটিফিকেশন BSEC/CMRRCD/2006-158/207/Admin/80 এর ধারা-৩, উপধারা-১ এর (a) এবং (e) অনুচ্ছেদ মোতাবেক একই ব্যক্তি একই সাথে দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা আইনের ব্যত্যয়। পূরবী জেনারেলের কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান যিনি একাধারে সন্ধানী লাইফেরও কোম্পানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও কোম্পানি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোম্পানির অতি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে অনৈতিকভাবে স্বাক্ষর করছেন। এক্ষেত্রে সন্ধানী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের ছাড়পত্র ব্যতীত তিনি পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। নিয়োগপত্র ছাড়াই মিজানুর রহমান এ দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে পূরবী জেনারেল থেকে সেক্রেটারি হিসেবে তার স্বাক্ষরযুক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া সুকুমার চন্দ্র রায় স্বাক্ষরিত চিঠিতে কোম্পানি সচিব হিসেবে মিজানুর রহমান দায়িত্ব পালনের কথা আইডিআরএকে অবহিত করা হয়। অথচ সন্ধানী লাইফ থেকেই পদত্যাগ না করে বেতনভাতা ও গাড়ি ব্যবহার করেছেন মিজানুর রহমান। এর ফলে আইডিআরএকে আবারো বোকা বানিয়েছেন সুকুমার চন্দ্র রায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক বীমা অর্থনীতি অনুসন্ধানে নামলে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে পূরবীর পরিচালনা পর্ষদ মিজানুর রহমানের পরিবর্তে পূরবী জেনারেলের সেক্রেটারি হিসেবে রিয়াজুল ইসলাম চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন। তিনি আবার সন্ধানী লাইফের জিএম হিসেবে কর্মরত। তিনিও মিজানুর রহমানের মতো একইভাবে সন্ধানী লাইফ থেকে পদত্যাগ না করে বেতনভাতা ও গাড়ি ব্যবহার করে পাশাপাশি পূরবীর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বিএসইসির আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলেছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, সন্ধানী ও পূরবীতে ড্যামি কর্মকর্তা কত জন? এ বিষয়ে সন্ধানী লাইফের সিইও নিমাই কুমার সাহার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এর সত্যতা স্বীকার করেন যে, এটা আইন বিরুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করা উচিত হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এ ধরনের বেআইনি কাজের জন্য সম্পূর্ণ দায় নিমাই চন্দ্র সাহা ও সুকুমার চন্দ্র রায়কে বহন করতে হবে। এ বিষয়ে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাথে যোগাযোগ করা হলে জানান, এই দুটি কোম্পানি আমাদের নজরে রয়েছে। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমতাবস্থায় বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিচালনা পর্ষদকে ওয়াকিফহাল না করায় এর দায়-দায়িত্ব সুকুমারের ওপরই বর্তায়। পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের নিয়োগ প্রস্তাব করানোর মাধ্যমে সিইও’র অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়। সিইও’র মূল দায়িত্ব কমপ্লায়েন্স পরিপালন করা হচ্ছে কিনা তা দেখভাল এবং নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করা। সম্পূর্ণ কোম্পানি পরিচালিত হয় সিইও’র নির্দেশে। তাছাড়া পরিচালকদের গৃহীত পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত যেন কমিশনের কমপ্লায়েন্সের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, সে বিষয়ে বোর্ডকে ওয়াকিবহাল রাখাও সিইও’র দায়িত্ব। তাকে জানাতে হবে, আইনের লঙ্ঘন হয় এমন কাজ করা উচিত হবে না। এতে কোম্পানির ক্ষতি হবে। তিনি যদি আইন পরিপালনের বিষয়ে পরিচালকদের সময়মতো ইনফর্ম না করেন, তবে সমস্ত দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ভার তিনি এড়াতে পারেন না বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়াও ওই সিইও’র বিরুদ্ধে বাকিতে ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে, এসব বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত প্রকাশের অপেক্ষায় রইলো।
Posted ৩:৫৫ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed