বিশেষ প্রতিবেদক: | রবিবার, ১১ অক্টোবর ২০২০ | প্রিন্ট | 844 বার পঠিত
আইন ভেঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা ও আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে পুঁজিবাজারভুক্ত সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। এজন্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) অদূরদর্শিতা ও বেপরোয়া মনোভাবকে দায়ী করেন প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীরা। ‘সেবাই আদর্শ’ শ্লোগান ধারণ করে ১৯৯৯ সালে দেশের বীমা খাতে পথচলা শুরু করে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স। ইতোমধ্যে প্রায় কুঁড়ি বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকের সম্পদ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া প্রতিষ্ঠানটির নিজের নিরাপত্তাই অনিশ্চিত। এতবছর পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা একেবারেই নাজুক। সর্বশেষ ২০১৯ অর্থবছরেও ব্যর্থতার এ গণ্ডি থেকে বেরোতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ঝুঁকি বহনকারী কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স নিজেই রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।
প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃতি করে বিনিয়োগকারীরা জানান, আগের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এ কোম্পানি। কমে গিয়েছে স্থায়ী সম্পদ, অবলিখন মুনাফা, গ্রোস প্রিমিয়াম ও রিটেইন আর্নিংয়ের পরিমাণ। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটিতে অহরহ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্দেশনা ও আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। যার মধ্যে রয়েছে বীমা আইন-২০১০ লঙ্ঘন করে বাকিতে ব্যবসা পরিচালনা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়। ফলে যেকোন সময় কোম্পানি পরিচালকদের জরিমানাসহ পুঁজিবাজারে এর কার্যক্রম সাসপেন্ডসহ ডি-লিস্টিং পর্যন্ত হতে পারে। এতসব অনিয়মের পরও সম্প্রতি পুঁজিবাজারে কোম্পানির শেয়ারের দর হুহু করে বাড়ছে। যার কারণ খুঁজে পায়নি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ফলে এক্ষেত্রেও কারসাজি হয়েছে বলে ধারণা সংস্থাটির। যে কারণে ডিএসই থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে শোকজ করা হতে পারে বলে গুঞ্জন উঠেছে ।
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্টের ক্ষেত্রে বড় রকমের কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে ব্যবসায় গ্রোস প্রিমিয়াম ৪৪ কোটি ৭৪ লাখ ৭৪ হাজার ১১৩ টাকা দেখালেও প্রিমিয়াম এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহিত হয়েছে ৩২ কোটি ৭৯ লাখ ৩৭ হাজার ৭৫৪ টাকা। অর্থাৎ ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৫৯ টাকা আদায় হয়নি বা করতে পারেনি। বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, এই টাকা শুধু প্রদর্শনের জন্যই উত্থাপিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো বাকি ব্যবসার পরিমাণ। যা বীমা আইনে নিষিদ্ধ। কেননা বীমা আইন-২০১০ এর ১৮ (৩) ধারায় বাকি ব্যবসা না করতে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, অর্থ সংগ্রহ না করেও যখন তা আয় হিসেবে দেখানো হয় তখন এর খারাপ প্রভাব (ব্যাড ইমপেক্ট) পড়ে পুঁজিবাজারে। কোন প্রতিষ্ঠান যখন ব্যবসা না করেও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আয় দেখাতে চায় তখন বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা কোন জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেন তারা।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সীমার অনেক বেশি ব্যয় করেছে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮৭ হাজার ৯৮৩ টাকা। যা গ্রোস প্রিমিয়ামের ৪৩.৬১%। আবার ২০১৮ সালে অতিরিক্ত ব্যয় ছিল ৪ কোটি ২৫ লাখ ১১ হাজার ৬০৯ টাকা, যা সে সময়কার গ্রোস প্রিমিয়ামের ৪১.৭৫%। এর ফলে কোম্পানিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে করপোরেট ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ায় কন্টিনজেন্ট লাইবেলিটি হিসেবে ২০১৯ সালের জন্য ১ কোটি ৮৭ লাখ ৪৫ হাজার ৪৯৪ টাকা এবং ২০১৮ সালের জন্য ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪১ হাজার ৮৫৩ টাকা প্রদান করতে হবে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে এমন অস্বচ্ছ তথ্য প্রদান করায় একদিকে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অপরদিকে আয়কর বঞ্চিত হচ্ছে সরকারী রাজস্ব খাত। বিশ্লেষকদের মতে, মূলত কোম্পানির পরিচালকরা নিজেদের স্বার্থেই জেনেশুনে এমন অনিয়মে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে তাদের সহায়তায় করে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী। এজন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মনিটরিং বাড়ানোর প্রতি জোর দেন তারা।
এসব অনিয়মের দায়ে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বীমা আইন-২০১০ এর ধারা ১৩০ অনুযায়ী ৫ লক্ষ টাকা এবং লঙ্ঘন অব্যহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা, ধারা ১৩১ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ৩ বৎসর কারাদণ্ড বা ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত এবং ধারা ১৩৪ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১ (এক) লক্ষ টাকা বা সর্বনিম্ন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা এবং লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে আইডিআরএ। তাছাড়া গতবছর আইডিআরএর সমন্বয় কমিটির বৈঠকেও অনিয়মের সাথে জড়িতদের সংশোধনের জন্য কারাগারে পাঠাতে নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয় এক বিনিয়োগকারী। এরপর প্রায় ১৫ দিন অতিক্রম হলেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সে চিঠির জবাব দেয়া হয়নি। পরে এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য জানতে সিইও নাজিরুল ইসলামের কাছে ফোন দিলে তা রিসিভ করেননি তিনি।
Posted ২:৩৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১১ অক্টোবর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed