বুধবার ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষুদ্রবীমার একটি বিধি থাকা জরুরি : এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন, এসিআইআই পরিচালক, (বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি)

  |   শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২   |   প্রিন্ট   |   159 বার পঠিত

ক্ষুদ্রবীমার একটি বিধি থাকা জরুরি : এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন, এসিআইআই পরিচালক, (বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি)

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত দেশে কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে? আদতে সর্বাধুনিক মডেলের স্বরূপ কী?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: বীমা আইনে ক্ষুদ্রবীমার সংজ্ঞা দেয়া নেই। বর্তমানে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা মূলত বীমা আইন-২০১০ এর ৬ ধারার আলোকে। বীমা আইনে বলা আছে, সকল বীমা কোম্পানিকে গ্রামীণ বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। প্রবিধান দ্বারা এর হারও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মূলত এই সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্সের আওতায় বীমা কোম্পানিগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বীমা চালু করেছে ‘ক্ষুদ্রবীমা’ নামে।

আমি যদি স্পষ্ট করে বলি, আমাদের দেশে আসলে ক্ষুদ্রবীমার নামে যা হচ্ছে তা আসলে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’-এর মতো।

আমাদের যে প্রচলিত মেয়াদি বীমা আছে ক্ষুদ্রবীমা আসলে একই জিনিস, একই বৈশিষ্ট্য। পার্থক্য শুধু এইটুকু ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক এক লাখ টাকা, যেহেতু আইনে বলা নেই কোনো কোনো কোম্পানি এটিকে দুই লাখ, তিন লাখও করেছে এবং তারা ক্ষুদ্রবীমা বলছে। দেশের প্রথম অ্যাকচুয়ারি সাফাত আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স সর্বপ্রথম বেসরকারিভাবে দেশে গণবীমা নামে ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালু করে। তখন বীমা অঙ্ক এক লাখ টাকা ছিলো। এখন অনেক কোম্পানি এর বেশি বীমা অঙ্ককেও ক্ষুদ্রবীমা বলছে। যেহেতু আইনে বলা নেই, সেহেতু আপাতত এভাবে চলছে। প্রচলিত মেয়াদি বীমার সঙ্গে ক্ষুদ্রবীমার বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই, যেটি কাম্য বা কাক্সিক্ষত নয়।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ক্ষুদ্রবীমার জন্য প্রবিধান করেছে। বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছে। সেখানে ক্ষুদ্রবীমার পরিমাণ কত হবে, কী কী বৈশিষ্ট্য হবে সেগুলো স্পষ্ট বলা আছে।

আমাদের দেশেও ক্ষুদ্রবীমার রেগুলেশন নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কিছু কাজ করছে, আলোচনা চলছে। ক্ষুদ্রবীমা আসলে কী সেটি স্পষ্ট করা দরকার। আমাদের দেশে একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যই কেবল দেখা যাচ্ছে, সেটি হলো মেয়াদি বীমার বীমা অঙ্ক পাঁচ লাখ, ১০ লাখ, ২০ লাখ। ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্কের চেয়ে কম। কিন্তু ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্যগুলো আরো ভিন্নতর হওয়া উচিত। আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে এটির স্পষ্টীকরণ দরকার আছে। যেমন বড় অঙ্কের মেয়াদি বীমার যে অবলিখন হয়, ক্ষুদ্র বীমার অবলিখন একই হলে সমস্যা হবে এবং সেটিই হচ্ছে। মেয়াদি বীমার ক্ষেত্রে যে কমিশন, বিধি না থাকায় ক্ষুদ্রবীমার কমিশনও একই। যার ফলে, যেসব কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প পরিচালনা করছে তারা সমস্যায় পড়ছে, ভবিষ্যতে আরো পড়বে। যেহেতু ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক কম, এই কমিশন বেশি দেয়াতে একটি বড় অঙ্ক বেরিয়ে যাচ্ছে এজেন্টদের হাতে। কোম্পানিগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। অনেক কোম্পানির এসব পরিকল্প মেয়াদপূর্তি হতে চলেছে, বীমাদাবি পরিশোধ তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। মেয়াদি বীমা আর ক্ষুদ্রবীমার অবলিখন, কমিশন একই হওয়া উচিত নয়, এটি সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। যে লোকের বীমা অঙ্ক ১০ লাখ, ২০ লাখ তার যে আন্ডাররাইটিংয়ের গাইডলাইন, ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রেও একই গাইডলাইন হওয়া কাম্য নয়। ক্ষুদ্রবীমার বিশেষ যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার বলে আমি মনে করি, সেগুলো হচ্ছে- স্বল্প আয়ের মানুষদের সমস্যা আমাকে চিন্তা করতে হবে। ক্ষুদ্র আয়ের একজন গ্রাহকের চাহিদা আর ২০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম দানকারী একজন গ্রাহকের চাহিদা এক হবে না। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী, বীমার বৈশিষ্ট্য আলাদা করা উচিত। ক্ষুদ্রবীমা এবং মেয়াদি বীমার বৈশিষ্ট্য এক দেখা যাচ্ছে। মেয়াদি বীমাতে যেমন বীমা অঙ্ক ও বোনাস থাকলে সেটি পায় ক্ষুদ্রবীমাতেও সেটি পাবে। এর বাইরে দু-তিনটি প্রিমিয়াম দিয়ে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সে বীমা অঙ্কটি পাবে। কিন্তু ক্ষুদ্র আয়ের মানুষদের যা দরকার সেটি আমাদের দেশের এই ক্ষুদ্রবীমাতে নেই। দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র আয়ের একজন মানুষ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাভী কিনছে। সেটির দুধ বিক্রি করে তার জীবিকা নির্বাহ হয়। হঠাৎ দেখা গেল গাভীটি মারা গেছে। ফলে তার আয়ের পথ বন্ধ। তখন সে ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামটি আর দিতে পারবে না। সুতরাং ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত জীবনবীমার কাভারেজও থাকবে, আয়ও কাভারেজে থাকবে। যেমন- সে ঋণ নিলে সেটিও বীমার আওতায় আসা উচিত। আয়ের উৎস যাতে চালু থাকে সেই ব্যবস্থাও ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আসবে। অসুস্থ হলেও ক্ষুদ্র হেলথ ইন্স্যুরেন্স থাকা উচিত।

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার দৃষ্টিতে কোন কোন খাত ক্ষুদ্রবীমায় থাকতে পারে বা কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: আমি মনে করি, মাইক্রো-হেলথ, মাইক্রো-ইনকাম জেনারেশন, মাইক্রোক্রেডিট এবং মাইক্রো-ইনডোমেন্ট, মাইক্রো এগ্রিকালচার এগুলো ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।

আবার সবগুলোকে সমন্বয় করে বান্ডেল আকারে ইন্স্যুরেন্স হতে পারে। যদিও এতে প্রিমিয়াম বেড়ে যাবে। প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য কষ্টের হবে। সেক্ষেত্রে অ্যাকচুয়ারিয়াল মতামত নিয়ে একটি গ্রাহক উপযোগী ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প হতে পারে। ভারতে একলাখ রুপি পর্যন্ত বীমা অঙ্ককে ক্ষুদ্রবীমা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশেও কত হবে সেটি ঠিক করে নেয়া উচিত। ক্ষুদ্রবীমার একটি বিধি থাকা জরুরি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: মেয়াদি বীমার যে কমিশন, এখানেও যদি তাই হয় তাহলে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট না হলে অনেক কোম্পানির পলিসিগুলোর মেয়াদপূর্তি হয়ে গেলেও তারা বীমাদাবি পরিশোধ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগালে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কিছুটা কমবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সবার জন্য বীমা নিশ্চিত করতে কোম্পানিগুলোর কী করণীয় রয়েছে বলে আপনি মনে করেন? যেখানে প্রান্তিক আয়ের মানুষদের সামর্থ্য অনুযায়ী বীমা অঙ্ক নির্ধারণ করা উচিত, সেখানে বলা হচ্ছে ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক কমপক্ষে এক লাখ টাকা। কীভাবে এই প্রিমিয়াম কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: আমি মনে করি, ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম মাসিক হতে পারে। মাসে পাঁচশ টাকা প্রিমিয়াম প্রান্তিক আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হবে না। পাক্ষিকও হতে পারে। ক্ষুদ্রবীমাকে পরিচিত করতে, জনপ্রিয় করতে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে হলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

উপমহাদেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান হার্ট সার্জন ডা. দেবী প্রসাদ শেঠি। তিনি দুধ বিক্রি করেন এমন কিছু ব্যক্তিদের বলেছেন তোমরা সমিতির মাধ্যমে এই দুধ বিক্রির কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারো এবং সেই সঞ্চয় ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম বাবদ জমা হলে আমি তোমাদের চিকিৎসা করতে পারবো। এরকমটি আমরাও চিন্তা করতে পারি। আমরাও আমাদের চিকিৎসকদের কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র আয়ের ব্যক্তিদের উৎসাহিত করে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে পারি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোন কোন খাত ক্ষুদ্রবীমার আওতায় পড়ে?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: কৃষিপ্রধান দেশে ক্ষুদ্র কৃষিবীমার কথা বলতে পারি, ডেইরি ফার্ম, পোলট্রি ফার্মগুলোকে ক্ষুদ্র কৃষিবীমার আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। কৃষকদের জন্য সরাসরি কৃষিবীমা। এটি নিয়ে সরকার খুবই আগ্রহী। দাতা সংস্থাগুলোও আগ্রহী। সম্প্রতি সাধারণ বীমা করপোরেশন তিনটি জেলায় তাদের কৃষিবীমার পাইলট প্রকল্প শেষ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্রাথমিকভাবে কৃষিবীমায় ভর্তুকি দেয়। ভারতও ভর্তুকি দিচ্ছে। ভারতে আলাদা একটি এগ্রিকালচার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই আছে। শ্রীলঙ্কা, নেপালে অনেক আগেই এটি শুরু হয়েছে। সরকার কৃষকের সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়। এর একটি ক্ষুদ্র অঙ্ক কৃষিবীমার প্রিমিয়াম বাবদ দেয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সংযুক্ত করে কৃষিবীমার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। দেশের হাওর অঞ্চলে কৃষিবীমা শুরু হয়েছে। কৃষিবীমাকে সফল করতে টেকসই জাতের ফসলের চিন্তা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষরাও বীমার আওতায় আসতে পারে। কারণ ঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোনো সময় তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর আশ্রয়হীন হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। জলবায়ু তহবিল থেকে তাদের জন্য জলবায়ু বীমা হতে পারে। সরকার ও জাতিসংঘের কাছে আমরা এই দাবি তুলতে পারি। বিষয়টি চিন্তা ভাবনার সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শিল্পকারখানারও ক্ষতি হতে পারে। সেখানেও রিক্সপুল গঠন করা যেতে পারে। সরকার আরেক ধরনের বীমা শুরু করেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ বীমা। প্রবাসগামীদের জন্য বাধ্যতামূলক করে জীবনবীমা করপোরেশনকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এটি খুবই অগ্রগামী একটি পরিকল্প। মন্ত্রণালয় এখানে ভর্তুকি দিচ্ছে। আমি মনে করি, এভাবে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা এগিয়ে আসতে পারে। যেভাবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এগিয়ে এসেছে। এভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে। তাহলে সবাইকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন হবে না।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: অবলিখন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে বিবেচনায় নিয়ে ক্ষুদ্রবীমার জন্য আলাদা রেগুলেশন করলে ক্ষুদ্রবীমা সফল হবে। কোম্পানিও লাভবান হবে। যেহেতু বীমা আইনে বলা আছে সকল বীমা কোম্পানিকে গ্রামীণ বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। প্রবিধান দ্বারা এর হারও নির্ধারণও করে দেয়া হয়েছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে যারা পিছিয়ে তাদেরকেই এগিয়ে নেয়া দরকার। দেশের যেহেতু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। মানুষের আয় বা সামর্থ্য বাড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা ধারণার আওতায় প্রান্তিক আয়ের মানুষদেরকে আমরা যদি বীমা সুরক্ষায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে তারা উপকৃত হবে। ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স কনসেপ্টটি যথার্থ। বীমাটা যাদের সামর্থ্য কম তাদেরই বেশি দরকার। তাদেরকেই বেশি বীমার আওতায় আনার দরকার, যার সামর্থ্য আছে তিনি হয়তো আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু যার সামর্থ্য নেই তার জন্য ঝুঁকি মোকাবিলা করতে বীমার দরকার। সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের ভাতা সরাসরি না দিয়ে ভাতাগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে প্রিমিয়াম আকারে দিলে দেশের অর্থনীতিতে বীমা ভূমিকা রাখতে পারবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ক্ষুদ্রবীমার বাজারজাত কৌশল ভিন্নতর হতে হবে। মেয়াদি বীমার মতো নয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে হবে। বিকল্প এজেন্সি চিন্তা করতে হবে। তাহলে কমিশন কমবে। কোম্পানিও লাভবান হবে। করপোরেট এজেন্টদের লাইসেন্স দেয়ার কথা এসেছে। এটি করা যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি চালু হয়েছে। বীমা কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ে কাজ করছে। অন্যান্য অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে যুগপৎভাবে এই কাজটি করা যেতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে সরকারের উদ্দেশ্য, কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যও সফল হবে। দরিদ্রতার হার কমবে। এসডিজির সাথে বীমা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেখানে দারিদ্র্য হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব। ক্ষুদ্রবীমা, কৃষিবীমা, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মানুষকে বের করতে পারে। জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বীমা কয়েকটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হতে পারে ক্ষুদ্র কৃষিবীমা, স্বাস্থ্যবীমা, ঋণবীমা। নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বীমা ভূমিকা রাখতে পারে। নারীদেরকে বীমা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের ন্যূনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: বাধ্যবাধকতা বর্তমান আইনেই আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পলিসির শর্তাবলি গ্রাহককে জানানো বীমা কোম্পানির দায়িত্ব। আলাদা আইন বা বিধির দরকার নেই। কোম্পানিগুলো বাস্তবায়ন করছে কি না সেটি তদারকি করা দরকার।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ক্ষুদ্রবীমার যে উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিলো এবং যে পদ্ধতিতে এটি পরিচালনা করা উচিত ছিলো, সেই জায়গাগুলিকে যথাযথ করা হয়নি বলে বুমেরাং হচ্ছে। ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আমরা দরিদ্রতা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু এখন যে পদ্ধতিতে চলছে, প্রকারান্তরে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আমরা নিপতিত করছি, এটি দুঃখজনক। অবশ্যই বীমা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কাম্য। ক্ষুদ্রবীমা সম্মেলনেও আমি বলেছি, একটি রেগুলেশন দরকার। একটি ডেফিনেশন পর্যন্ত নেই। যদিও নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে সময় লাগে। কর্তৃপক্ষ হয়তো সময় নিচ্ছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্নদেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্পআয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ইউরোপের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যবীমার ক্ষেত্রে সরকার বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনকালেও উন্নততর স্বাস্থ্যবীমার অঙ্গীকার থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়, কিন্তু ট্যাক্স কেটে নেয়া হয়। আয়ের শ্রেণিবিন্যাসও আছে। আয় থেকে ট্যাক্স নেয়। করের একটি অংশ সরকার স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেয়। আমাদের সরকারও চেষ্টা করছে। কিন্তু সকল জনগণকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সরকারের জন্য কঠিন। সুতরাং এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবীমা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। অন্যান্য বীমার চেয়ে স্বাস্থ্যবীমার প্রসার কম। অনেক কোম্পানিতে স্বাস্থ্যবীমা নেই। কারণ প্রিমিয়াম বেশি। সে ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আসলে প্রিমিয়াম কম হবে। বীমাও সফল হবে, কোম্পানি লাভবান হবে, মানুষ উপকৃত হবে।
স্বাস্থ্য বীমার বড় চ্যালেঞ্জ, নৈতিক ঝুঁকি, মিথ্যা চিকিৎসা বিল। এটির সংখ্যা বেশি হলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য তৃতীয়পক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালু করতে হবে। ভারতে এটি রয়েছে। হাসপাতালই বীমা কোম্পানিকে বিল দিবে। কোম্পানির সাথে এগ্রিমেন্ট হবে। বেশিসংখ্যক লোককে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসলে কোম্পানির জন্য লাভজনক উদ্যোগ হবে। সরকার সাপোর্ট দিলে প্রান্তিক আয়ের মানুষ এর আওতায় আসবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৭:৩১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।