বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ক্ষুদ্রবীমা বা ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমন্বিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : কাজী মো. মোরতুজা আলী, বিশিষ্ট ইসলামি বীমা বিশেষজ্ঞ মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি) প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি

  |   শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২   |   প্রিন্ট   |   142 বার পঠিত

ক্ষুদ্রবীমা বা ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমন্বিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : কাজী মো. মোরতুজা আলী, বিশিষ্ট ইসলামি বীমা বিশেষজ্ঞ মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি) প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত দেশে কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে? আদতে সর্বাধুনিক মডেলের স্বরূপ কী?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: যেহেতু আইন বাধা দিচ্ছে না, সেহেতু ক্ষুদ্রবীমা অবৈধ নয়। এখন প্রশ্ন হলো যদি আইন না থাকে, তাহলে এগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? চলছে দু’ভাবে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলো করছে, আরেকটি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো করছে। যখন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো করছে, তখন প্রত্যেকটি পরিকল্প অ্যাকচুয়ারি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। এরপর বীমা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে। অতএব আমরা এটিকে আইনসিদ্ধ বা বিধিসিদ্ধ বলতে পারি। কারণ বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এসব পলিসি বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। সুতরাং কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যা করছে, সেখানে এর কোনো আইনগত বা বিধিগত ব্যত্যয় ঘটেনি। কারণ তারা অনুমোদন নিয়ে করছে। আবার এনজিও বা মাইক্রো-ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলোও (এমএফআই) ক্ষুদ্রবীমা করছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এটি তত্ত্বাবধান করে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন-২০০৬ এর ২৪(২) (জ) ধারায় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও কার্যাদি বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের নিম্নবর্ণিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব থাকিবে। যথা- ‘ঋণগ্রহীতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভন্ন প্রকার বীমা সার্ভিস এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমুখী ঋণ সহায়তা প্রদান করা।’

এই ধারার ব্যাখ্যায় এমআরএ দাবি করছে, এখানে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের বীমাসেবা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বীমা বিক্রি করতে পারবে। অথচ বীমা আইন ২০১০-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, ‘বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে নিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন বীমা ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম পরিচালনা করিতে পারিবে না ।’ যেখানে বীমা আইনে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, কেউ লাইসেন্স না নিয়ে বীমা বিক্রি করতে পারবে না। শুধু কোম্পানিই নয়, এজেন্টদেরও লাইসেন্স নিয়ে বীমা বিক্রি করতে হবে। সেখানে এমআরএ আইনের এই ধারা সাংঘর্ষিক। অথচ দুটোই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এখন সরকারকেই বলতে হবে কোনটি বৈধ।

এখন করপোরেট এজেন্টের কথা বলা হচ্ছে। এনজিওগুলো যদি এটি করতে চায়, তাহলে করতে পারবে। কিন্তু কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে তারা কমিশন গ্রহণ করতে পারবে। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সের যে মডেলকে সবাই সাজেস্ট করে, সেটিকে বলা হয় পার্টনার এজেন্ট মডেল। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির সাথে এনজিওগুলো এজেন্ট বা পার্টনার হিসেবে কাজ করবে। যদিও এখন এনজিওগুলো অনেকে ইন্স্যুরেন্স নাম না দিয়ে ইমার্জেন্সি ফান্ড, সোশ্যাল ফান্ড, এরকম নানা নামে ফান্ড কালেক্ট করছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিও এখন ইন্স্যুরেন্স বলছে না, তারা নাম দিয়েছে ইন্টিগ্রেটেড রিস্ক মিডিগেশন প্ল্যান বা সমন্বিত ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা। জাপান এবং ফিলিপাইনে এই মডেল চালু রয়েছে। সেখানে এটিকে বলা হয়, মিউচ্যুয়াল বেনিফিট অ্যাসোসিয়েশন। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স তারা বলেনা। সুতরাং মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সই অন্য নামে হচ্ছে, অন্য ঢঙে হচ্ছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: ক্ষুদ্রবীমা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সকে বলা যায়, ক্ষুদ্রবীমার সর্বশেষ সংস্করণ বা উন্নততর সংস্করণ। ক্ষুদ্রবীমার লক্ষ্য ছিলো শুধুমাত্র গরিব মানুষ বা অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত নয় এমন জনগোষ্ঠী। কিন্তু ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স যখন বলছি, তখন এর অর্থ হচ্ছে সর্বজনীন বীমা বা সবার জন্য বীমা। সে গরিব হোক, মধ্যবিত্ত হোক অথবা ধনী হোক, সবাইকে বীমার আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ যার বীমা নেই তাকে বীমার আওতায় আনতে হবে। এখানে শুধু গরিব মানুষ নয়। আমরা প্রথমে বলেছি, ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট; তারপর বলেছি, ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স। এরপর এসেছে ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমন্বিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: এটির খুব সহজ উত্তর এভাবে বলা যায়, বীমার যে উদ্দেশ্য সেটি আসলে কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে? ক্ষুদ্রবীমা তো পরে আসবে। সরকার ‘জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪’ প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে জিডিপিতে বীমাখাতের অবদান ৪ শতাংশ করা হবে। কিন্তু ২০২১-এ দাঁড়িয়ে আমরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। জিডিপিতে বীমার অবদান এক শতাংশেরও নিচে। তাহলে আমাদের গতিটি কোন দিকে গেছে? ক্ষুদ্রবীমা যদি এরই অংশ হয়, তাহলে ক্ষুদ্রবীমা যে ভালো করছে এটি সঠিক নয়। পরিসংখ্যানে দেখবেন ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহকসংখ্যা কমছে। ক্ষুদ্রবীমাতে পলিসি তামাদির হারও বেশি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: সরকারের উচিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাপ্রাপ্তির অধিকার যখন মৌলিক, তখন সরকারের উচিত এখানে ভর্তুকি দেয়া। স্বাস্থ্যবীমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নৈতিক বিপত্তি, স্বচ্ছতা থাকে না। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভর্তুকি দিয়ে সোশ্যাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালু করতে পারে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকদের এই ইন্স্যুরেন্স দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরেও সরকারের ভর্তুকিতে একটি স্বাস্থ্যবীমা আছে। এখানে সবার বীমা অঙ্ক, প্রিমিয়াম, ভর্তুকি, সুবিধা সব সমান হবে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে তহবিল নিয়ে সরকার এটি করতে পারে। কৃষিবীমার ক্ষেত্রে ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড, ডিজাস্টার ম্যানেজেমেন্ট ফান্ড থেকে একটি অংশ দিতে পারে। কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। সরকারের তরফ থেকে তত্ত্বাবধায়ন হতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৭:০১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।