শুক্রবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সম্ভাবনার হাতছানি

ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে জীবন বীমার মাইলফলক

  |   শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২   |   প্রিন্ট   |   489 বার পঠিত

ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে জীবন বীমার মাইলফলক

বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমা বিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো জীবন বীমা কোম্পানি মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের ক্ষুদ্রবীমার আওতায় নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সার্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। ক্ষুদ্রবীমা’র উদ্দেশ্য দারিদ্র সীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা।

ক্ষুদ্রবীমা কম আয় এবং দরিদ্র ব্যক্তিদের তাদের ঝুঁকি পরিচালনা করতে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মনে করে, ক্ষুদ্রবীমার বার্ষিক প্রিমিয়াম স্তর গ্রাহকের ১০ দিনের আয়ের বেশি হওয়া উচিত নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্রবীমা এসডিজি, ডেল্টা প্ল্যান এবং সরকারের রূপকল্প ২০৪১ সহ অন্যান্য অগ্রাধিকার পরিকল্পনার সাথে গভীরভাবে জড়িত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে বীমার উপর বর্তমান মাথাপিছু ব্যয় জনপ্রতি ৮ মার্কিন ডলার যেখানে ভারতে এটি জনপ্রতি ৭১ ডলার। সুতরাং বাংলাদেশে বীমা বাজার বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে শস্য বীমার বাজার সম্ভাবনা ৫৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পশু সম্পদের জন্য এটি ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৭.৮ শতাংশ এসএমই নারীদের মালিকানাধীন। এই পরিসংখ্যানগুলি দেখায় যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার একটি সুস্পষ্ট বাজার রয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ, আইনগত সীমাবদ্ধতাসহ নানা বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতির বিশেষ প্রতিনিধি নাসির আহমাদ রাসেল। এসব সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো আজকের এই বিশেষ আয়োজনে।

 

সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ পদক্ষেপ থাকলে ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব

কামরুল হাসান, সদস্য (লাইফ) বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)

ক্ষুদ্রবীমা হচ্ছে প্রান্তিক বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বীমা সুরক্ষায় নিয়ে আসার অত্যাধুনিক একটি পদ্ধতি। বার্ষিক বা মাসিকভিত্তিতে খুব ছোট স্তরের প্রিমিয়াম প্রদান করে একটি বড় বীমা অংকের সুবিধা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে ক্ষুদ্রবীমায়। যেসব মানুষের বীমা সুরক্ষার আওতায় আসার বা পলিসি গ্রহণের কোনো আগ্রহ থাকে না, সঠিক বাজারজাত প্রক্রিয়া বা সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকেও ক্ষুদ্রবীমার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সবার জন্য বীমা বা সার্বজনীন বীমা বাস্তবায়নে ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কামরুল হাসান: আমি মনে করি, ক্ষুদ্রবীমা হচ্ছে প্রান্তিক বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বীমা সুরক্ষায় নিয়ে আসার অত্যাধুনিক একটি পদ্ধতি।

বার্ষিক বা মাসিকভিত্তিতে খুব ছোট স্তরের প্রিমিয়াম প্রদান করে একটি বড় বীমা অংকের সুবিধা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে ক্ষুদ্রবীমায়। যেসব মানুষের বীমা সুরক্ষার আওতায় আসার বা পলিসি গ্রহণের কোনো আগ্রহ থাকে না, সঠিক বাজারজাত প্রক্রিয়া বা সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকেও ক্ষুদ্রবীমার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, গৃহীনি, শ্রমজীবী মানুষদেরকে ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্পের মাধ্যমে বীমা সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে একটি বিরাট সম্ভাবনার বাজার। সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ পদক্ষেপ, সঠিক নির্দেশনা থাকলে ক্ষুদ্রবীমা থেকেই দারিদ্রবিমোচনে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

 

দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকদের বীমার আওতায় আনার জন্য ক্ষুদ্রবীমা কার্যকর মাধ্যম হতে পারে

এস এম শাকিল আখতার

নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ

দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে বীমার আওতায় আসতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বীমাকারীরা স্বল্প অঙ্কের এবং স্বল্প প্রিমিয়ামের পলিসি ইস্যু করে থাকে। কত টাকা প্রিমিয়াম হলে তাকে ক্ষুদ্রবীমা বলা হবে সে বিষয়টি সুনির্দিষ্ট নয়। কারণ মানুষের মাথাপিছু আয় পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে ক্ষুদ্রবীমার সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হয়।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত দেশে কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে? আদতে সর্বাধুনিক মডেলের স্বরূপ কী?

এস এম শাকিল আখতার: দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে বীমার আওতায় আসতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বীমাকারীরা স্বল্প অঙ্কের এবং স্বল্প প্রিমিয়ামের পলিসি ইস্যু করে থাকে। কত টাকা প্রিমিয়াম হলে তাকে ক্ষুদ্রবীমা বলা হবে সে বিষয়টি সুনির্দিষ্ট নয়। কারণ মানুষের মাথাপিছু আয় পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে ক্ষুদ্রবীমার সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হয়।
সুতরাং ক্ষুদ্রবীমার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। বীমা ব্যবসা কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে বীমা আইন-২০১০ এ নির্দেশনা রয়েছে। বীমা আইন ২০১০-এর ৫ ধারার বীমার শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। ক্ষুদ্রবীমা আলাদা কোনো শ্রেণিভিত্তিক বীমা নয়, প্রিমিয়াম আয় কম বলে একে ক্ষুদ্রবীমা বলা হয়। সুতরাং প্রচলিত বীমার বিক্রয় মডেলই ক্ষুদ্রবীমার বিক্রয় মডেল।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এস এম শাকিল আখতার: বাংলাদেশে প্রায় ২০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদেরকে বীমার আওতায় আনতে পারলে একদিকে যেমন প্রোটেকশন গ্যাপ কমে যাবে, অন্যদিকে ঝুঁকির বিপরীতে তাদের প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি হবে। দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকদের বীমার আওতায় আনার জন্য ক্ষুদ্রবীমা কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?
এস এম শাকিল আখতার : ক্ষুদ্রবীমার বিভিন্ন সুবিধা ও উপকারিতা থাকলেও এর বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যথা-
(১) দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে বিধায়, তাদের নিকট বীমাপণ্য বিপণনের খরচ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
(২) এ ধরনের বীমার প্রিমিয়াম অব্যাহত রাখার হারও অনেক কম।
(৩) গ্রামাঞ্চলে সকল কোম্পানির পর্যাপ্ত শাখা নেই, এতে করে তাদের কাছে বীমাসেবা পৌঁছানো যায় না।
(৪) বীমা বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাবও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের নূ্যূনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

এস এম শাকিল আখতার : বীমা স্বাক্ষরতা আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা। বীমার আইন-কানুন আর্থিকখাতের অন্যান্য আইন-কানুনের চেয়ে জটিল প্রকৃতির। বীমার যে আইন-কানুন রয়েছে তা পলিসিহোল্ডার ও কোম্পানি উভয়ের স্বার্থের কাম্য অবস্থা বজায় রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ আইন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তবে বীমাকারীরা বীমাগ্রাহকদের এ বিষয়ে আরো সচেতন করতে পারেন।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?
এস এম শাকিল আখতার : স্বাস্থ্যবীমা যদি অল্প প্রিমিয়ামের হয়, তাহলে এটি ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবীমা হবে। স্বাস্থ্যবীমাকে জনপ্রিয় করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু পরিকল্প তৈরির মধ্যেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয়। স্বাস্থ্যবীমার সামগ্রিক ইকো-সিস্টেমে অনেক বিষয় জড়িত। যেমন- হাসপাতাল, বিপণন পদ্ধতি, দাবি নিষ্পত্তি, আন্ডাররাইটিং এগুলো। বর্তমানে এ ধরনের সক্ষমতা আমাদের নেই। তাছাড়া এমন কোনো উদ্যোগ নিয়ে আগানো যাবে না, যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সুতরাং ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করার বিষয়ে আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকরা নানাভাবে দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কৃষি ও কৃষককে বীমার আওতায় আনতে বিশ্বজুড়ে দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদেরও বীমার আওতায় আনার। এটিকে কীভাবে দেখছেন এবং বাংলাদেশে কী উদ্যোগ রয়েছে? সরকারের কী করণীয় রয়েছে?

এস এম শাকিল আখতার : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ফলে কৃষকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা তৈরিতে ক্ষুদ্রবীমা কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে বীমা সুবিধা চালুর জন্য প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এগিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে কোনো একটি প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পাইলটিংও করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বীমা সুবিধা ফলপ্রসূ করার জন্য সরকারের ভর্তুকি প্রদানেরও প্রয়োজন হতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সবার জন্য বীমা বা সর্বজনীন বীমা নিশ্চিত করতে সরকার তথা, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কী কার্যক্রম রয়েছে?

এস এম শাকিল আখতার: সবার কাছে বীমা পৌঁছে দিবে মূলত বীমা কোম্পানিগুলো। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সর্বজনীন বীমা নিশ্চিত করতে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা।
আইন এবং বিধিবিধান যাতে সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয় সেসব বিষয় নিশ্চিত করা। বীমাদাবিগুলো সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে কি না, মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে কি না সেসব বিষয় দেখা। অর্থাৎ আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণ এবং কোম্পানিগুলোর জন্য বীমার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, সবধরনের সহযোগিতা দেয়া। এর অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষ তথা, সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রবিধান তৈরি করছে। প্রতি বছর বীমা দিবস পালন করছে, বীমা মেলা করছে; এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। মানুষ যাতে সঠিকভাবে, সচেতনভাবে, বুঝেশুনে বীমাকে গ্রহণ করে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। আমরা কাজ করছি একেবারে মানুষের দোরগোড়ায় বীমা সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দিতে, যাতে তারা বীমার প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা উপলব্ধি করতে পারে। গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে বীমাখাতকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এ ধরনের নানা উদ্যোগ মূলত সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষক, শ্রমিক, নারী, সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ বীমা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আওতায় কৃষকের জন্য শস্যবীমা, খামারিদের জন্য গবাদিপশু বীমা, কারখানার শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনাজনিত বীমা, দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্রবীমা রয়েছে। ক্ষুদ্রবীমার আওতায় আনার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে বীমাখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য এ খাতে ডিজিটালাইজেশন করা হচ্ছে। শস্যবীমা নিয়ে কাজ চলছে।

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের স্বাস্থ্যবীমা চালুর পরিকল্পনা আছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য টাঙ্গাইলে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্যবীমা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে সরকার হেলথকেয়ার ফিন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করেছে। এর আওতায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) শীর্ষক পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি নিয়মিত ঘটনা। এ ধরনের ঘটনায় কৃষককে রক্ষার্থে ‘শস্যবীমা’ চালু করা হবে। একইসঙ্গে কারখানা শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনাজনিত বীমার বিষয়ে মালিকদের কাছে থেকে প্রিমিয়ামের একটি অংশ নেয়া হবে, বাকি অংশ শ্রমিকদের বেতন থেকে হবে। এর বাইরে সরকারের একটি অংশও এখানে রাখা হবে। এই ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থার আওতায় বীমা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: গ্রামীণ এবং সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে কর্তৃপক্ষ কীভাবে কাজ করছে?

এস এম শাকিল আখতার: বীমা আইন-২০১০ এর ৬ ধারার সকল বীমা কোম্পানিকে গ্রামীণ বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। প্রবিধান দ্বারা এর হারও নির্ধারণও করে দেয়া হয়েছে।
বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি মূলত গ্রামেই কাজ করছে। প্রিমিয়ামের অধিকাংশ গ্রামীণ এবং সামাজিক খাত থেকেই আসে। আইডিআরএ’র হিসাবে গ্রামীণ এবং সামাজিক খাতে বীমার পরিমাণও বেশি। তবে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামেই জনসংখ্যা বেশি। সে কারণে গ্রামাঞ্চলে বীমার পরিধি আরো বাড়ানো দরকার।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতিকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ক্ষুদ্রবীমা বা ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমন্বিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

কাজী মো. মোরতুজা আলী, ইসলামি বীমা বিশেষজ্ঞ মহাপরিচালক

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি) প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত দেশে কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে? আদতে সর্বাধুনিক মডেলের স্বরূপ কী?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: যেহেতু আইন বাধা দিচ্ছে না, সেহেতু ক্ষুদ্রবীমা অবৈধ নয়। এখন প্রশ্ন হলো যদি আইন না থাকে, তাহলে এগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? চলছে দু’ভাবে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলো করছে, আরেকটি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো করছে। যখন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো করছে, তখন প্রত্যেকটি পরিকল্প অ্যাকচুয়ারি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। এরপর বীমা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে। অতএব আমরা এটিকে আইনসিদ্ধ বা বিধিসিদ্ধ বলতে পারি। কারণ বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এসব পলিসি বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। সুতরাং কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যা করছে, সেখানে এর কোনো আইনগত বা বিধিগত ব্যত্যয় ঘটেনি। কারণ তারা অনুমোদন নিয়ে করছে। আবার এনজিও বা মাইক্রো-ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলোও (এমএফআই) ক্ষুদ্রবীমা করছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এটি তত্ত্বাবধান করে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন-২০০৬ এর ২৪(২) (জ) ধারায় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও কার্যাদি বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের নিম্নবর্ণিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব থাকিবে। যথা- ‘ঋণগ্রহীতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভন্ন প্রকার বীমা সার্ভিস এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমুখী ঋণ সহায়তা প্রদান করা।’

এই ধারার ব্যাখ্যায় এমআরএ দাবি করছে, এখানে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের বীমাসেবা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বীমা বিক্রি করতে পারবে। অথচ বীমা আইন ২০১০-এর ৮ ধারা অনুযায়ী, ‘বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে নিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন বীমা ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম পরিচালনা করিতে পারিবে না ।’ যেখানে বীমা আইনে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, কেউ লাইসেন্স না নিয়ে বীমা বিক্রি করতে পারবে না। শুধু কোম্পানিই নয়, এজেন্টদেরও লাইসেন্স নিয়ে বীমা বিক্রি করতে হবে। সেখানে এমআরএ আইনের এই ধারা সাংঘর্ষিক। অথচ দুটোই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এখন সরকারকেই বলতে হবে কোনটি বৈধ।

এখন করপোরেট এজেন্টের কথা বলা হচ্ছে। এনজিওগুলো যদি এটি করতে চায়, তাহলে করতে পারবে। কিন্তু কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে তারা কমিশন গ্রহণ করতে পারবে। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সের যে মডেলকে সবাই সাজেস্ট করে, সেটিকে বলা হয় পার্টনার এজেন্ট মডেল। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির সাথে এনজিওগুলো এজেন্ট বা পার্টনার হিসেবে কাজ করবে। যদিও এখন এনজিওগুলো অনেকে ইন্স্যুরেন্স নাম না দিয়ে ইমার্জেন্সি ফান্ড, সোশ্যাল ফান্ড, এরকম নানা নামে ফান্ড কালেক্ট করছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিও এখন ইন্স্যুরেন্স বলছে না, তারা নাম দিয়েছে ইন্টিগ্রেটেড রিস্ক মিডিগেশন প্ল্যান বা সমন্বিত ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা। জাপান এবং ফিলিপাইনে এই মডেল চালু রয়েছে। সেখানে এটিকে বলা হয়, মিউচ্যুয়াল বেনিফিট অ্যাসোসিয়েশন। মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স তারা বলেনা। সুতরাং মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সই অন্য নামে হচ্ছে, অন্য ঢঙে হচ্ছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: ক্ষুদ্রবীমা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্সকে বলা যায়, ক্ষুদ্রবীমার সর্বশেষ সংস্করণ বা উন্নততর সংস্করণ। ক্ষুদ্রবীমার লক্ষ্য ছিলো শুধুমাত্র গরিব মানুষ বা অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত নয় এমন জনগোষ্ঠী। কিন্তু ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স যখন বলছি, তখন এর অর্থ হচ্ছে সর্বজনীন বীমা বা সবার জন্য বীমা। সে গরিব হোক, মধ্যবিত্ত হোক অথবা ধনী হোক, সবাইকে বীমার আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ যার বীমা নেই তাকে বীমার আওতায় আনতে হবে। এখানে শুধু গরিব মানুষ নয়। আমরা প্রথমে বলেছি, ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট; তারপর বলেছি, ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স। এরপর এসেছে ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সমন্বিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: এটির খুব সহজ উত্তর এভাবে বলা যায়, বীমার যে উদ্দেশ্য সেটি আসলে কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে? ক্ষুদ্রবীমা তো পরে আসবে। সরকার ‘জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪’ প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে জিডিপিতে বীমাখাতের অবদান ৪ শতাংশ করা হবে। কিন্তু ২০২১-এ দাঁড়িয়ে আমরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। জিডিপিতে বীমার অবদান এক শতাংশেরও নিচে। তাহলে আমাদের গতিটি কোন দিকে গেছে? ক্ষুদ্রবীমা যদি এরই অংশ হয়, তাহলে ক্ষুদ্রবীমা যে ভালো করছে এটি সঠিক নয়। পরিসংখ্যানে দেখবেন ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহকসংখ্যা কমছে। ক্ষুদ্রবীমাতে পলিসি তামাদির হারও বেশি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?

কাজী মো. মোরতুজা আলী: সরকারের উচিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাপ্রাপ্তির অধিকার যখন মৌলিক, তখন সরকারের উচিত এখানে ভর্তুকি দেয়া। স্বাস্থ্যবীমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নৈতিক বিপত্তি, স্বচ্ছতা থাকে না। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভর্তুকি দিয়ে সোশ্যাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালু করতে পারে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকদের এই ইন্স্যুরেন্স দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরেও সরকারের ভর্তুকিতে একটি স্বাস্থ্যবীমা আছে। এখানে সবার বীমা অঙ্ক, প্রিমিয়াম, ভর্তুকি, সুবিধা সব সমান হবে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে তহবিল নিয়ে সরকার এটি করতে পারে। কৃষিবীমার ক্ষেত্রে ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড, ডিজাস্টার ম্যানেজেমেন্ট ফান্ড থেকে একটি অংশ দিতে পারে। কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। সরকারের তরফ থেকে তত্ত্বাবধায়ন হতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ক্ষুদ্রবীমার একটি বিধি থাকা জরুরি

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন, এসিআইআই পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত দেশে কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে? আদতে সর্বাধুনিক মডেলের স্বরূপ কী?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: বীমা আইনে ক্ষুদ্রবীমার সংজ্ঞা দেয়া নেই। বর্তমানে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা মূলত বীমা আইন-২০১০ এর ৬ ধারার আলোকে। বীমা আইনে বলা আছে, সকল বীমা কোম্পানিকে গ্রামীণ বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। প্রবিধান দ্বারা এর হারও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মূলত এই সোশ্যাল ইন্স্যুরেন্সের আওতায় বীমা কোম্পানিগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বীমা চালু করেছে ‘ক্ষুদ্রবীমা’ নামে।

আমি যদি স্পষ্ট করে বলি, আমাদের দেশে আসলে ক্ষুদ্রবীমার নামে যা হচ্ছে তা আসলে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’-এর মতো।

আমাদের যে প্রচলিত মেয়াদি বীমা আছে ক্ষুদ্রবীমা আসলে একই জিনিস, একই বৈশিষ্ট্য। পার্থক্য শুধু এইটুকু ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক এক লাখ টাকা, যেহেতু আইনে বলা নেই কোনো কোনো কোম্পানি এটিকে দুই লাখ, তিন লাখও করেছে এবং তারা ক্ষুদ্রবীমা বলছে। দেশের প্রথম অ্যাকচুয়ারি সাফাত আহমেদ চৌধুরীর হাত ধরে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স সর্বপ্রথম বেসরকারিভাবে দেশে গণবীমা নামে ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালু করে। তখন বীমা অঙ্ক এক লাখ টাকা ছিলো। এখন অনেক কোম্পানি এর বেশি বীমা অঙ্ককেও ক্ষুদ্রবীমা বলছে। যেহেতু আইনে বলা নেই, সেহেতু আপাতত এভাবে চলছে। প্রচলিত মেয়াদি বীমার সঙ্গে ক্ষুদ্রবীমার বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই, যেটি কাম্য বা কাক্সিক্ষত নয়।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ক্ষুদ্রবীমার জন্য প্রবিধান করেছে। বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছে। সেখানে ক্ষুদ্রবীমার পরিমাণ কত হবে, কী কী বৈশিষ্ট্য হবে সেগুলো স্পষ্ট বলা আছে।

আমাদের দেশেও ক্ষুদ্রবীমার রেগুলেশন নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কিছু কাজ করছে, আলোচনা চলছে। ক্ষুদ্রবীমা আসলে কী সেটি স্পষ্ট করা দরকার। আমাদের দেশে একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যই কেবল দেখা যাচ্ছে, সেটি হলো মেয়াদি বীমার বীমা অঙ্ক পাঁচ লাখ, ১০ লাখ, ২০ লাখ। ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্কের চেয়ে কম। কিন্তু ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্যগুলো আরো ভিন্নতর হওয়া উচিত। আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে এটির স্পষ্টীকরণ দরকার আছে। যেমন বড় অঙ্কের মেয়াদি বীমার যে অবলিখন হয়, ক্ষুদ্র বীমার অবলিখন একই হলে সমস্যা হবে এবং সেটিই হচ্ছে। মেয়াদি বীমার ক্ষেত্রে যে কমিশন, বিধি না থাকায় ক্ষুদ্রবীমার কমিশনও একই। যার ফলে, যেসব কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প পরিচালনা করছে তারা সমস্যায় পড়ছে, ভবিষ্যতে আরো পড়বে। যেহেতু ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক কম, এই কমিশন বেশি দেয়াতে একটি বড় অঙ্ক বেরিয়ে যাচ্ছে এজেন্টদের হাতে। কোম্পানিগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। অনেক কোম্পানির এসব পরিকল্প মেয়াদপূর্তি হতে চলেছে, বীমাদাবি পরিশোধ তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। মেয়াদি বীমা আর ক্ষুদ্রবীমার অবলিখন, কমিশন একই হওয়া উচিত নয়, এটি সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। যে লোকের বীমা অঙ্ক ১০ লাখ, ২০ লাখ তার যে আন্ডাররাইটিংয়ের গাইডলাইন, ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রেও একই গাইডলাইন হওয়া কাম্য নয়। ক্ষুদ্রবীমার বিশেষ যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার বলে আমি মনে করি, সেগুলো হচ্ছে- স্বল্প আয়ের মানুষদের সমস্যা আমাকে চিন্তা করতে হবে। ক্ষুদ্র আয়ের একজন গ্রাহকের চাহিদা আর ২০ লাখ টাকা প্রিমিয়াম দানকারী একজন গ্রাহকের চাহিদা এক হবে না। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী, বীমার বৈশিষ্ট্য আলাদা করা উচিত। ক্ষুদ্রবীমা এবং মেয়াদি বীমার বৈশিষ্ট্য এক দেখা যাচ্ছে। মেয়াদি বীমাতে যেমন বীমা অঙ্ক ও বোনাস থাকলে সেটি পায় ক্ষুদ্রবীমাতেও সেটি পাবে। এর বাইরে দু-তিনটি প্রিমিয়াম দিয়ে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সে বীমা অঙ্কটি পাবে। কিন্তু ক্ষুদ্র আয়ের মানুষদের যা দরকার সেটি আমাদের দেশের এই ক্ষুদ্রবীমাতে নেই। দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র আয়ের একজন মানুষ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাভী কিনছে। সেটির দুধ বিক্রি করে তার জীবিকা নির্বাহ হয়। হঠাৎ দেখা গেল গাভীটি মারা গেছে। ফলে তার আয়ের পথ বন্ধ। তখন সে ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামটি আর দিতে পারবে না। সুতরাং ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত জীবনবীমার কাভারেজও থাকবে, আয়ও কাভারেজে থাকবে। যেমন- সে ঋণ নিলে সেটিও বীমার আওতায় আসা উচিত। আয়ের উৎস যাতে চালু থাকে সেই ব্যবস্থাও ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আসবে। অসুস্থ হলেও ক্ষুদ্র হেলথ ইন্স্যুরেন্স থাকা উচিত।

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার দৃষ্টিতে কোন কোন খাত ক্ষুদ্রবীমায় থাকতে পারে বা কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: আমি মনে করি, মাইক্রো-হেলথ, মাইক্রো-ইনকাম জেনারেশন, মাইক্রোক্রেডিট এবং মাইক্রো-ইনডোমেন্ট, মাইক্রো এগ্রিকালচার এগুলো ক্ষুদ্রবীমার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।

আবার সবগুলোকে সমন্বয় করে বান্ডেল আকারে ইন্স্যুরেন্স হতে পারে। যদিও এতে প্রিমিয়াম বেড়ে যাবে। প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য কষ্টের হবে। সেক্ষেত্রে অ্যাকচুয়ারিয়াল মতামত নিয়ে একটি গ্রাহক উপযোগী ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প হতে পারে। ভারতে একলাখ রুপি পর্যন্ত বীমা অঙ্ককে ক্ষুদ্রবীমা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশেও কত হবে সেটি ঠিক করে নেয়া উচিত। ক্ষুদ্রবীমার একটি বিধি থাকা জরুরি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: মেয়াদি বীমার যে কমিশন, এখানেও যদি তাই হয় তাহলে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট না হলে অনেক কোম্পানির পলিসিগুলোর মেয়াদপূর্তি হয়ে গেলেও তারা বীমাদাবি পরিশোধ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগালে ব্যবস্থাপনা ব্যয় কিছুটা কমবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সবার জন্য বীমা নিশ্চিত করতে কোম্পানিগুলোর কী করণীয় রয়েছে বলে আপনি মনে করেন? যেখানে প্রান্তিক আয়ের মানুষদের সামর্থ্য অনুযায়ী বীমা অঙ্ক নির্ধারণ করা উচিত, সেখানে বলা হচ্ছে ক্ষুদ্রবীমার বীমা অঙ্ক কমপক্ষে এক লাখ টাকা। কীভাবে এই প্রিমিয়াম কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: আমি মনে করি, ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম মাসিক হতে পারে। মাসে পাঁচশ টাকা প্রিমিয়াম প্রান্তিক আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হবে না। পাক্ষিকও হতে পারে। ক্ষুদ্রবীমাকে পরিচিত করতে, জনপ্রিয় করতে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে হলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

উপমহাদেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান হার্ট সার্জন ডা. দেবী প্রসাদ শেঠি। তিনি দুধ বিক্রি করেন এমন কিছু ব্যক্তিদের বলেছেন তোমরা সমিতির মাধ্যমে এই দুধ বিক্রির কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারো এবং সেই সঞ্চয় ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম বাবদ জমা হলে আমি তোমাদের চিকিৎসা করতে পারবো। এরকমটি আমরাও চিন্তা করতে পারি। আমরাও আমাদের চিকিৎসকদের কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র আয়ের ব্যক্তিদের উৎসাহিত করে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে পারি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোন কোন খাত ক্ষুদ্রবীমার আওতায় পড়ে?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: কৃষিপ্রধান দেশে ক্ষুদ্র কৃষিবীমার কথা বলতে পারি, ডেইরি ফার্ম, পোলট্রি ফার্মগুলোকে ক্ষুদ্র কৃষিবীমার আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। কৃষকদের জন্য সরাসরি কৃষিবীমা। এটি নিয়ে সরকার খুবই আগ্রহী। দাতা সংস্থাগুলোও আগ্রহী। সম্প্রতি সাধারণ বীমা করপোরেশন তিনটি জেলায় তাদের কৃষিবীমার পাইলট প্রকল্প শেষ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্রাথমিকভাবে কৃষিবীমায় ভর্তুকি দেয়। ভারতও ভর্তুকি দিচ্ছে। ভারতে আলাদা একটি এগ্রিকালচার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই আছে। শ্রীলঙ্কা, নেপালে অনেক আগেই এটি শুরু হয়েছে। সরকার কৃষকের সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়। এর একটি ক্ষুদ্র অঙ্ক কৃষিবীমার প্রিমিয়াম বাবদ দেয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সংযুক্ত করে কৃষিবীমার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। দেশের হাওর অঞ্চলে কৃষিবীমা শুরু হয়েছে। কৃষিবীমাকে সফল করতে টেকসই জাতের ফসলের চিন্তা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষরাও বীমার আওতায় আসতে পারে। কারণ ঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোনো সময় তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর আশ্রয়হীন হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। জলবায়ু তহবিল থেকে তাদের জন্য জলবায়ু বীমা হতে পারে। সরকার ও জাতিসংঘের কাছে আমরা এই দাবি তুলতে পারি। বিষয়টি চিন্তা ভাবনার সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে শিল্পকারখানারও ক্ষতি হতে পারে। সেখানেও রিক্সপুল গঠন করা যেতে পারে। সরকার আরেক ধরনের বীমা শুরু করেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ বীমা। প্রবাসগামীদের জন্য বাধ্যতামূলক করে জীবনবীমা করপোরেশনকে এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এটি খুবই অগ্রগামী একটি পরিকল্প। মন্ত্রণালয় এখানে ভর্তুকি দিচ্ছে। আমি মনে করি, এভাবে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা এগিয়ে আসতে পারে। যেভাবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এগিয়ে এসেছে। এভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে। তাহলে সবাইকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা খুব কঠিন হবে না।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: অবলিখন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে বিবেচনায় নিয়ে ক্ষুদ্রবীমার জন্য আলাদা রেগুলেশন করলে ক্ষুদ্রবীমা সফল হবে। কোম্পানিও লাভবান হবে। যেহেতু বীমা আইনে বলা আছে সকল বীমা কোম্পানিকে গ্রামীণ বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। প্রবিধান দ্বারা এর হারও নির্ধারণও করে দেয়া হয়েছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে যারা পিছিয়ে তাদেরকেই এগিয়ে নেয়া দরকার। দেশের যেহেতু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। মানুষের আয় বা সামর্থ্য বাড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা ধারণার আওতায় প্রান্তিক আয়ের মানুষদেরকে আমরা যদি বীমা সুরক্ষায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে তারা উপকৃত হবে। ইনক্লুসিভ ইন্স্যুরেন্স কনসেপ্টটি যথার্থ। বীমাটা যাদের সামর্থ্য কম তাদেরই বেশি দরকার। তাদেরকেই বেশি বীমার আওতায় আনার দরকার, যার সামর্থ্য আছে তিনি হয়তো আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কিন্তু যার সামর্থ্য নেই তার জন্য ঝুঁকি মোকাবিলা করতে বীমার দরকার। সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের ভাতা সরাসরি না দিয়ে ভাতাগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে প্রিমিয়াম আকারে দিলে দেশের অর্থনীতিতে বীমা ভূমিকা রাখতে পারবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ক্ষুদ্রবীমার বাজারজাত কৌশল ভিন্নতর হতে হবে। মেয়াদি বীমার মতো নয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে হবে। বিকল্প এজেন্সি চিন্তা করতে হবে। তাহলে কমিশন কমবে। কোম্পানিও লাভবান হবে। করপোরেট এজেন্টদের লাইসেন্স দেয়ার কথা এসেছে। এটি করা যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি চালু হয়েছে। বীমা কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ে কাজ করছে। অন্যান্য অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে যুগপৎভাবে এই কাজটি করা যেতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে সরকারের উদ্দেশ্য, কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যও সফল হবে। দরিদ্রতার হার কমবে। এসডিজির সাথে বীমা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেখানে দারিদ্র্য হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব। ক্ষুদ্রবীমা, কৃষিবীমা, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মানুষকে বের করতে পারে। জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বীমা কয়েকটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে অন্যতম হতে পারে ক্ষুদ্র কৃষিবীমা, স্বাস্থ্যবীমা, ঋণবীমা। নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বীমা ভূমিকা রাখতে পারে। নারীদেরকে বীমা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের ন্যূনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: বাধ্যবাধকতা বর্তমান আইনেই আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পলিসির শর্তাবলি গ্রাহককে জানানো বীমা কোম্পানির দায়িত্ব। আলাদা আইন বা বিধির দরকার নেই। কোম্পানিগুলো বাস্তবায়ন করছে কি না সেটি তদারকি করা দরকার।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ক্ষুদ্রবীমার যে উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিলো এবং যে পদ্ধতিতে এটি পরিচালনা করা উচিত ছিলো, সেই জায়গাগুলিকে যথাযথ করা হয়নি বলে বুমেরাং হচ্ছে। ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আমরা দরিদ্রতা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু এখন যে পদ্ধতিতে চলছে, প্রকারান্তরে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আমরা নিপতিত করছি, এটি দুঃখজনক। অবশ্যই বীমা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কাম্য। ক্ষুদ্রবীমা সম্মেলনেও আমি বলেছি, একটি রেগুলেশন দরকার। একটি ডেফিনেশন পর্যন্ত নেই। যদিও নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে সময় লাগে। কর্তৃপক্ষ হয়তো সময় নিচ্ছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্নদেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্পআয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?

এস.এম ইব্রাহিম হোসাইন: ইউরোপের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যবীমার ক্ষেত্রে সরকার বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনকালেও উন্নততর স্বাস্থ্যবীমার অঙ্গীকার থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়, কিন্তু ট্যাক্স কেটে নেয়া হয়। আয়ের শ্রেণিবিন্যাসও আছে। আয় থেকে ট্যাক্স নেয়। করের একটি অংশ সরকার স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেয়। আমাদের সরকারও চেষ্টা করছে। কিন্তু সকল জনগণকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সরকারের জন্য কঠিন। সুতরাং এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবীমা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। অন্যান্য বীমার চেয়ে স্বাস্থ্যবীমার প্রসার কম। অনেক কোম্পানিতে স্বাস্থ্যবীমা নেই। কারণ প্রিমিয়াম বেশি। সে ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আসলে প্রিমিয়াম কম হবে। বীমাও সফল হবে, কোম্পানি লাভবান হবে, মানুষ উপকৃত হবে।
স্বাস্থ্য বীমার বড় চ্যালেঞ্জ, নৈতিক ঝুঁকি, মিথ্যা চিকিৎসা বিল। এটির সংখ্যা বেশি হলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য তৃতীয়পক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালু করতে হবে। ভারতে এটি রয়েছে। হাসপাতালই বীমা কোম্পানিকে বিল দিবে। কোম্পানির সাথে এগ্রিমেন্ট হবে। বেশিসংখ্যক লোককে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসলে কোম্পানির জন্য লাভজনক উদ্যোগ হবে। সরকার সাপোর্ট দিলে প্রান্তিক আয়ের মানুষ এর আওতায় আসবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

 

ক্ষুদ্রবীমা প্রকল্পগুলো সফল করতে সকলের অংশীদারিত্বের প্রয়োজন

মো. আরাফাত হোসেন,

টিম লিডার, বাংলাদেশ মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিএমএমডিপি), সুইস কন্ট্যাক্ট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমা বিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো জীবন বীমা কোম্পানি মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের ক্ষুদ্রবীমার আওতায় নিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ক্ষুদ্রবীমা কম আয় এবং দরিদ্র ব্যক্তিদের তাদের ঝুঁকি পরিচালনা করতে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো মনে করে, ক্ষুদ্রবীমার বার্ষিক প্রিমিয়াম স্তর গ্রাহকের ১০ দিনের আয়ের বেশি হওয়া উচিত নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্রবীমা এসডিজি, ডেল্টা প্ল্যান এবং সরকারের রূপকল্প ২০৪১ সহ অন্যান্য অগ্রাধিকার পরিকল্পনার সাথে গভীরভাবে জড়িত। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ, আইনগত সীমাবদ্ধতাসহ নানা বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতির বিশেষ প্রতিনিধি নাসির আহমাদ রাসেল।  সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশ মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিএমএমডিপি) সম্পর্কে জানতে চাই। মূলত কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই প্রকল্প কাজ করছে?

মোঃ আরাফাত হোসেন:
বাংলাদেশ মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স মার্কেট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিএমএমডিপি) এর প্রথম ধাপের লক্ষ্য হল কৃষকদের কল্যাণ। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহনীয় উন্নত কৃষি উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কৃষকরা আবহাওয়ার কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার কারণে যার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। তাদের সীমিত সঞ্চয়ের কারণে, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষি বীমার সুযোগ না থাকার কারণে ক্ষুদ্র কৃষির কৃষকরা প্রায়ই একটি মৌসুমের ফসলের ক্ষতি বা গবাদি পশুর রোগের ক্ষতিসহ বিপর্যয়কর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক বীমা খাত এখনো পূর্ণবিকাশ লাভ করেনি এবং কৃষি ও দুর্যোগ বীমা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মৌসুমে ক্ষতি কমিয়ে আনতে কৃষকদের একমাত্র পদ্ধতি হলো কৃষিকাজে কম খরচ করা। এতে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি
কম থাকে। কিন্তু এতে সমস্যা হলো বিনিয়োগ কম হওয়ায় কৃষি উৎপাদনও কম হয়। এতে কৃষকদের দারিদ্রতা থেকেই যায়।

বিএমএমডিপি বাংলাদেশে কৃষি খাত, প্রাথমিকভাবে শস্য ও পশুসম্পদ উপখাতের উপযুক্ত আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা পরিকল্প নিয়ে কাজ করছে। একইসঙ্গে ঝুঁকি প্রশমনের পদ্ধতি সনাক্ত করবে। কৃষিখাত বিকাশের জন্য বিভিন্ন বীমা পরিকল্প ও এর বিপণন নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজের উপর ফোকাস করবে।

প্রথম ধাপে ১০ জেলার দুই লাখ ৩৩ হাজার কৃষকের ৭,৫৭৮ একর (৩০৬৭ হেক্টর) জমি শষ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে । দুই লাখ গবাদিপশুপালককে উন্নত পশুচিকিৎসা ও পশুপালন সেবা দেয়া হবে। ৬৩ হাজার কৃষক পশুসম্পদ বীমা ব্যবহার করবেন। এভাবে ক্ষতি হ্রাস করে কৃষকরা তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং দারিদ্রমুক্ত হতে পারবেন বলে আশা করা যায়।

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার বাজার সম্ভাবনা কতটা এবং চ্যালেঞ্জগুলো মূলত কী কী?

মোঃ আরাফাত হোসেন: সুইস কন্ট্যাক্ট বাংলাদেশ মনে করে, ক্ষুদ্রবীমা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সম্পর্কিত। এটি সরকারের রূপকল্প ২০৪১-এর সাথেও গভীরভাবে জড়িত। যা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় দুর্যোগ সহনশীল শস্য ও পশুসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দেয়। ক্ষুদ্রবীমা খাত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে কিন্তু এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে খাতটি তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলো দিন দিন বাড়ছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা প্রকল্পগুলিকে সফল করতে পাবলিক সেক্টর, প্রাইভেট সেক্টর এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের মধ্যে অংশীদারিত্বের তীব্র প্রয়োজন।
ক্ষুদ্রবীমা কম আয় এবং দরিদ্র ব্যক্তিদের তাদের ঝুঁকি পরিচালনা করতে সহায়তা করে। ক্ষুদ্রবীমার বার্ষিক প্রিমিয়াম স্তর গ্রাহকের ১০ দিনের আয়ের বেশি হওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশে বীমার উপর বর্তমান মাথাপিছু ব্যয় জনপ্রতি ৮ মার্কিন ডলার যেখানে ভারতে এটি জনপ্রতি ৭১ ডলার। সুতরাং, বাংলাদেশে বীমা বাজার বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফিলিপাইন মাত্র ২০ বছরে তার জনসংখ্যার ৩০ শতাংশকে ক্ষুদ্রবীমার আওতায় এনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে শস্য বীমার বাজার সম্ভাবনা ৫৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পশু সম্পদের জন্য এটি ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৭.৮ শতাংশ এসএমই নারীদের মালিকানাধীন। এই পরিসংখ্যানগুলি দেখায় যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার একটি সুস্পষ্ট বাজার রয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপিতে বীমার অবদান এক শতাংশের নিচে। আমরা যদি কৃষিক্ষেত্রকে এগিয়ে নেই, তাহলে আমরা সহজেই বাংলাদেশের অর্থনীতে বীমার অবদান বাড়াতে পারি।

আমাদের উচিত বীমা পণ্যের উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া। টার্গেট অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখে আমাদের প্রথমে পণ্য ডিজাইন করতে হবে তা বের করতে হবে। কৃষি বীমা পণ্যের উন্নয়নে তত্ত্বাবধায়ক নির্দেশিকা প্রয়োজন, এবং এখানে শিল্প এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে একটি সহযোগিতা নিশ্চিত করা উচিত।

ডিস্ট্রিবিউশন হল আরেকটি মূল উপাদান যার ফোকাস প্রয়োজন। যেহেতু বাংলাদেশের কৃষকরা পিরামিডের সর্বনিম্ন অংশে রয়েছে, তাই তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের অবশ্যই বিতরণের বিকল্প চ্যানেল ব্যবহার করতে হবে।আমাদের কৃষি বীমা পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্যথায়, একটি পণ্য তৈরি করা অর্থহীন হবে। আমাদের কৃষি বীমা পণ্যের উপর কর ও ভ্যাট কমানো উচিত।

আমাদের একটি নির্দেশিকা বা রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে যা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে যে আমরা একটি শিল্প হিসাবে কোথায় যেতে চাই। এটি আমাদের পরিকল্পনা তৈরি করতে এবং কীভাবে আমরা কৃষি ক্ষুদ্রবীমাকে উন্নত করব এবং বাজারে এটির জন্য চাপ দেব তা বের করতে সাহায্য করবে। প্রচার এবং বিতরণের সুবিধার্থে আমরা ক্রেডিটসহ বীমা পণ্যগুলিকে বান্ডিল করতে পারি। টেকসই বীমা হল জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপর্যয়ের কারণে কৃষকদের যে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয় তা প্রশমিত করার চাবিকাঠি। যাইহোক, একই সময়ে, আমাদের জলবায়ু এবং প্রকৃতির যত্ন নেওয়া উচিত।

 

সবার কাছে বীমা পৌঁছাতে হলে ক্ষুদ্রবীমা মডেল নিয়েই আগাতে হবে

শেখ রকিবুল করিম, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা,  গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমা বিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আপনারা কী মডেল বা কোন আইনের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?

শেখ রকিবুল করিম: বীমা আইন বা বীমা বিধিতে ক্ষুদ্রবীমার সরাসরি সংজ্ঞা দেয়া না থাকলেও কোন আইনের সাথে ক্ষুদ্রবীমার কনসেপ্ট সাংঘর্ষিক নয়। জীবন বীমা যেমন বীমা গ্রহীতার মৃত্যুতে আর্থিক সুরক্ষা দেয়, তেমনি ক্ষুদ্রবীমাও বীমা গ্রহীতার মৃত্যুতে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে। ক্ষুদ্রবীমা একটি সার্বজনীন স্বীকৃত ধারণা এবং মাইক্রোইন্স্যুরেন্স নেটওয়ার্ক হচ্ছে একটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত প্ল্যাটফর্ম। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ক্ষুদ্রবীমা / অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা হচ্ছে সেই পরিকল্পসমূহ যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে সাজানো হয়। ক্ষুদ্রবীমায় বীমাকারী মূল ঝুঁকি গ্রহণ করে, খুবই সহজ শর্তের ও স্বল্প প্রিমিয়ামের বীমাপণ্য সমষ্টিকারীর সাহায্যে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ছড়িয়ে দেয়। ক্ষুদ্রবীমার আওতায় প্রকল্পসমূহ অবশ্যই বীমার মূলনীতিদ্বারা পরিচালিত হতে হয়। সুতরাং আইনে সংজ্ঞা দেয়া না থাকলেও ক্ষুদ্রবীমা প্রচলনে আইনগত কোন বাধা নেই। এছাড়াও প্রতিটি বীমাকল্প চালু করার আগে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে যা ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে হ্যা, এ কথা স্বীকার করতে হবে ক্ষুদ্রবীমা বিষয়ক পৃথক সুস্পষ্ট গাইডলাইন বা নির্দেশনা থাকা উচিত। আমাদের জানা মতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সমন্বয়ে এই নীতিমালার কাজ এগোচ্ছে।

ভৌগলিক অবস্থা, জনবলের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সব কোম্পানির পৌঁছানো সম্ভব নয়। কিন্তু আর্থিক সুরক্ষার বাইরে থাকা বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর অন্যতম মডেল হচ্ছে ই২ই২ঈ মডেল। এই মডেলের মাধ্যমে মাত্র ৬ বছরে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স এক কোটি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল তৈরি করে এত দ্রুত এই বিশালসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কিছু জিনিস চাহিদা অনুযায়ী গড়ে উঠে। দেশে ক্ষুদ্রবীমার বিশাল বাজার যার প্রধানতম চাহিদা ক্রেডিট শিল্ড বা ঋণ সুরক্ষা বীমা।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলোর সাথে আপনাদের বিজনেস পলিসিটা কী? তাদের সঙ্গে আপনারা কোন মডেলে ব্যবসা করছেন? তারা কীভাবে প্রিমিয়াম কালেক্ট করে থাকে?

শেখ রকিবুল করিম: আমরা ব্র্যাক, ব্যাংক এশিয়া, গণজাগরণী উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি। গ্রুপ পলিসির আওতায় এটি একটি ইউনিক মডেল। এ মডেলে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকরা প্রতি হাজারে ন্যুনতম একটি অংক প্রিমিয়াম প্রদান করে গার্ডিয়ানের ক্ষুদ্রবীমা গ্রহণ করতে পারেন। এ বীমার মূল বৈশিষ্ট্য হলো বীমার মেয়াদের ভেতরে যদি ঋণগ্রহীতার মৃত্যু হয় তাহলে গার্ডিয়ান তার নিয়মিত ঋণস্থিতি/অবশিষ্ট ঋণ সংশ্লিষ্ট ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করে এবং এতে বীমাগ্রহীতার পরিবার ঋণ মুক্ত হয়। এছাড়াও ঋণগ্রহীতা বা সেকেন্ডারি বীমাগ্রহীতার মৃত্যুতে একটি নির্দিষ্ট পরিমান নগদ অর্থ অন্তোষ্টিক্রিয়া/দাফন-কাফন এর জন্য প্রদান করা হয়। এখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা প্রফিট শেয়ারিং মডেলে কাজ করছি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

শেখ রকিবুল করিম:
বিধিমালা থাকাটা জরুরি। যেহেতু বীমা খাত ও ক্ষুদ্রঋণ খাত দুটো ইন্ড্রাস্ট্রির একটি ইতিবাচক সমন্বয়ে এই প্রক্রিয়াটি কাজ করে। এখানে ব্যবস্থাপনা, বীমা দাবি, প্রিমিয়াম সংগ্রহ এসব বিষয় চলে আসে। সেক্ষেত্রে লভ্যাংশ ভাগাভাগি বা প্রফিট শেয়ারিংয়ের বিষয়টি চলে আসে। মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটগুলোর সাথে চুক্তিরক্ষেত্রে ক্ষুদ্রবীমা খাতের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ বিনিময় হতে পারে।

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার কোম্পানিতে ক্ষুদ্রবীমার কী কী পরিকল্প রয়েছে?

শেখ রকিবুল করিম:
গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্র্যাকের সাথে যৌথ ব্যবস্থাপনায় ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জন্য ‘গার্ডিয়ান ব্র্যাক বীমা (জিবিবি)’ নামক একটি বিশেষায়িত বীমা পরিকল্প পরিচালনা করে আসছে যার আওতায় আমরা ক্রেডিট শিল্ড বা ঋণ সুরক্ষা বীমা প্রদান করে আসছি। ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাগণ ঋণ গ্রহণকালে অতি অল্প প্রিমিয়ামে এই বীমা করতে পারেন। বীমা মেয়াদের ভেতর যদি ঋণগ্রহীতার মৃত্যু হয় তাহলে গার্ডিয়ান ঋণ গ্রহীতার নিয়মিত ঋণস্থিতি/অবশিষ্ট ঋণের সমপরিমাণ অর্থ ব্র্যাককে পরিশোধ করে এবং এতে বীমাগ্রহীতার পরিবার ঋণ মুক্ত হয়। এ বীমার আওতায় বীমাগ্রহীতা চাইলে একজন সেকেন্ডারি বীমাগ্রহীতা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে বীমাগ্রহীতা অথবা সেকেন্ডারি বীমাগ্রহীতা যেকোনো একজনের মৃত্যুতে গার্ডিয়ান ঋণস্থিতি/অবশিষ্ট ঋণ পরিশোধ করে থাকে। এছাড়াও বীমাগ্রহীতা অথবা সেকেন্ডারি বীমাগ্রহীতার মৃত্যুতে গার্ডিয়ান মৃত ব্যক্তির পরিবারকে একটি নির্দিষ্ট অংক অন্তোষ্টিক্রিয়া/দাফন কাফনের খরচ বাবদ প্রদান করে।
গার্ডিয়ান ব্র্যাক বীমা প্রকল্পটি ২০১৫ সালে ২০ টি শাখা নিয়ে পাইলটিং করা হয়। এই পাইলটিং এর ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় ২০১৬ সালে এই প্রকল্পের আওতায় শাখার সংখ্যা ৬৫০টিতে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে গার্ডিয়ান-ব্র্যাক বীমা প্রকল্পে মোট ২৫৩০টি শাখা রয়েছে, যা বিশ্বের সর্ব বৃহৎ ক্ষুদ্রবীমা প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় গার্ডিয়ান লাইফ তাদের সার্ভিস এবং কাজের মান বজায় রেখে দুটি ভাগে কাজ করে চলেছে যার মধ্যে একটি অপারেশন পরিচালনা এবং অপরটি দক্ষভাবে দাবি প্রক্রিয়াকরণ। দাবি প্রক্রিয়াটিকে আরও দ্রুত ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য গার্ডিয়ান লাইফ অনলাইনেও বীমা দাবি গ্রহণ করে। বর্তমানে এক কোটিরও বেশি জীবন গার্ডিয়ান-ব্র্যাক বীমা প্রকল্পের আওতায় সুরক্ষিত আছে।
এছাড়াও আমাদের রয়েছে ব্যাংক এশিয়া-গার্ডিয়ান বীমা (বিএজি)। ২০১৯ সালে, ব্যাংক এশিয়া ও গার্ডিয়ান লাইফ যৌথভাবে ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেলের অধীনে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণ সুরক্ষা বীমা চালু করেছে। এই বীমা পরিষেবার আওতায় বীমাকৃত ঋণধারীর মৃত্যুর কারণে সমস্ত বকেয়া ঋণ গার্ডিয়ান পরিশোধ করে।

আমাদের পোর্টফলিও তে আরেকটি খুবই প্রয়োজনীয় পরিকল্প রয়েছে আর তা হচ্ছে সঞ্চয় নিরাপত্তা বীমা যা ডিপিএস শিল্ড নামেও পরিচিত। আমরা আশা করছি যে খুব অচিরেই এই পরিকল্পটি কোন বেসরকারি সংস্থার সাথে আমরা ব্যাবসায়িকভাবে লঞ্চ করবো। এরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলো আয়ত্বে আনতে চাইলে কোনো বাউন্ডারির মধ্যে আটকে থাকা যাবে না। আমি মনে করি, সবার কাছে ইন্স্যুরেন্স পৌঁছাতে হলে এই মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স বা ক্ষুদ্রবীমা মডেল নিয়েই আগাতে হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

শেখ রকিবুল করিম:
ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমা (ইনক্লুসিভ) নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। এই বীমার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। কারণ এর সম্ভাবনা বিপুল। অন্যান্য বীমার তুলনায় ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহজে বীমার আওতায় নিয়ে আসা যায়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণে অন্যান্য মাধ্যমের পাশাপাশি ক্ষুদ্রবীমা একটি চমৎকার মাধ্যম হতে পারে।

প্রান্তিক জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, তাই দরিদ্র পরিবারগুলো কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়, যেমন পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যুতে ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ক্ষুদ্রবীমা এধরনের বিপর্যয়ে সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে ভূমিকা পালন করে। প্রান্তিক জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্ষুদ্রবীমার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যেহেতু অনেক সময় মৃত ব্যক্তির

অন্তোষ্টিক্রিয়া/দাফন-কাফনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করাও দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় এবং সন্তানদের শিক্ষার জন্যও নগদ অর্থের প্রয়োজন। সব মিলিয়ে একটি দরিদ্র পরিবারের উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যু পুরো পরিবারের জন্য বিরাট আর্থিক বিড়ম্বনা ও ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এমতাবস্থায় একটি ক্ষুদ্র বীমা এরূপ ঝুঁকি এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে পরিবারকে সুরক্ষা প্রদান করে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোন সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের ন্যুনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

শেখ রকিবুল করিম:
যদিও সর্বোপরি বীমা ক্ষেত্রের ইমেজ এখন আগের থেকে অনেক ভাল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু এখনও অনেক কিছু করার বাকী আছে। সচেতনতা আরও অনেক বাড়াতে হবে। বীমা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। সচেতনতা একটি নিয়মিত কাজ, এটি অব্যাহত রাখতে হবে। গ্রাহকরা ভাল কোম্পানিকে অনুসরণ করলে এই ধরনের সমস্যা হওয়ার সুযোগ নেই। আমার মনে হয়, একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন থাকার প্রয়োজন আছে। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত বীমার সুফল প্রত্যক্ষ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করবে না যে এটি সম্ভব।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমা’র উদ্দেশ্য দারিদ্র সীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তোলা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে? প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের কাছে কীভাবে বীমা সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব?

শেখ রকিবুল করিম:
দেশে ক্ষুদ্রবীমার বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত নয় এমন ব্যক্তিদের নানা ধরনের বীমাসুরক্ষা প্রয়োজন। তাদের স্বাস্থ্যবীমা প্রয়োজন। অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঘটলে পরিবারের সদস্যরা যাতে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে পারে সেই ব্যবস্থা বা সে ধরনের বীমা থাকা দরকার। আমরা সরাসরি টেকসই সুরক্ষা দিতে পারব না। আমরা তাদের সুরক্ষাজালে হয়তো নিয়ে আসতে পারব। এই লক্ষ্যে কেউ একা পৌঁছাতে হলে অনেক দেরি হবে। সবাই মিলে এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে হবে। আর্থিকখাতের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমরা একটি বন্ধনসৃষ্টির চেষ্টা করছি যাতে সম্মিলিতভাবে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা যায়।
ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?

শেখ রকিবুল করিম:
চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণগ্রহীতাদের জন্য জীবন বীমা বাধ্যতামূলক নয়। এমআরএ প্রবিধানের কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানর স্ব-বীমা নীতির অনুমতি পেয়ে যায়, আর এই কারণে বীমা কোম্পানির কাজের পরিধি ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে যায়। যদিও বীমা আইন অনুসারে কেবল লাইসেন্সপ্রাপ্ত বীমা কোম্পানিই বীমা ব্যবসায় যুক্ত হতে পারে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্র বীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল। ব্যয় সাপেক্ষ। সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে আপনাদের কী উদ্যোগ রয়েছে?

শেখ রকিবুল করিম:
জীবন বীমা কোম্পানি শুধু স্বাস্থ্যবীমা বিক্রয় করতে পারবে কি না এ সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে পণ্য উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারের সহজ স্বাস্থ্যবীমা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। বর্তমানে আমাদের ইজিলাইফ ডিজিটাল চ্যানেল ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন বীমার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবীমাও দিচ্ছি। ইজিলাইফ ডিজিটাল চ্যানেল ও রবির সাথেও আমাদের এই আঙ্গিকে কাজ হচ্ছে। বর্তমানে ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে এক বিশাল অবদান রেখে চলেছে। আমাদের এই ফিনটেক বিপ্লবের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ইনস্যুরটেক ভিত্তিক মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, আর তাহলেই আমরা জীবন ও স্বাস্থ্য বীমাসহ আরও অনেক সল্যুশন নিয়ে সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার মাধ্যমে খুব দ্রুত বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যেতে পারব। আমরা এই ব্যাপারে খুবই আশাবাদী।

 

ক্ষুদ্রবীমার জন্য আইন, পরিকল্পনা,  দায়বদ্ধতার দিকে নজর দিতে হবে
অজিত চন্দ্র আইচ
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আপনারা কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?

অজিত চন্দ্র আইচ: অবশ্যই ক্ষুদ্রবীমা পরিচালনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান থাকতে হবে। মডেল থাকতে হবে। কীভাবে পরিচালিত হবে এর একটি গাইডলাইন প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণত ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহকসংখ্যা বেশি হয়।

গ্রাহকসংখ্যা বেশি হলেও যত দ্রুত উন্নত কাস্টোমার সার্ভিস দেয়া যাবে, গ্রাহকের প্রিমিয়াম জমা দেয়ার পদ্ধতি যত সহজ হবে কোম্পানি বা পলিসির প্রতি তাদের আস্থা ততো বাড়বে। কোনো একটি কোম্পানি এ সার্ভিস দেয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটি করে ফেললে গোটা ইন্ডাস্ট্রির বদনাম হয়ে যাবে, ক্ষতি হয়ে যাবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

অজিত চন্দ্র আইচ: প্রান্তিক মানুষদেরকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা সময়ের দাবি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বীমার আওতায় থাকা ক্ষুদ্র আয়ের মানুষদের বীমার বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়। এতে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ সুগম হয়। জাপানে প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষকে ঋণ সুরক্ষা দেয়া হয়। প্রিমিয়ামের বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু পদ্ধতিগত কারণে এদেশে এটি বাস্তবায়ন একটু কঠিন। এদেশে প্রান্তিক আয়ের গ্রাহকরা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু এতে বীমাটি ব্যর্থ হয়। বিদেশের জন্য যেটি ফিট আমাদের দেশের জন্য সেটি ফিট নাও হতে পারে। ওইসব দেশে একজন নবজাতক হাসপাতালে জন্ম নিয়ে বাসায় আসার আগেই বীমার আওতায় আসে।

ক্ষুদ্রবীমার শুরুটা হয়েছিল সম্ভাবনা নিয়ে। এখনো এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে যদি শতভাগ ডিজিটালাইজড গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যায়। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি জরুরি। যেহেতু সচেতন লোক এখনো বীমা সম্পর্কে আস্থাহীনতায় ভোগে। অনেক চেষ্টা করে পলিসি বিক্রি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে এনজিওর মাধ্যমে, সমিতির মাধ্যমে প্রান্তিক লোকজনকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। তাদেরকে বীমার আওতায় এনে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনে সহায়তা করা। প্রয়োজনে আয়বর্ধক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে বীমা পলিসি সচল রাখা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে?

অজিত চন্দ্র আইচ: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য মহৎ ছিলো। কিন্তু আমরা ভুলভাবে নিয়েছি। সঠিক প্রয়োগ হয়নি। বীমা চালাতে না পেরে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অপপ্রচার হয়েছে। বীমাখাতের জন্য ক্ষুদ্রবীমা খুবই দরকার, এজন্য আইন, পরিকল্পনা, দায়বদ্ধতা এগুলো যাতে থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। কারো সামর্থ্যরে বেশি প্রিমিয়াম যাতে চাপিয়ে দেয়া না হয়।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

অজিত চন্দ্র আইচ: একক বীমা এবং ক্ষুদ্রবীমার ব্যবস্থাপনা, এজেন্ট একই হলে কোনো সমস্যা নেই। তাহলে খরচ বাড়বে না। এটি কোম্পানি ব্যবস্থাপকদের চিন্তা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। বিধি না থাকলেও আইডিআরএর একটি নিয়ম আছে, টার্ম আছে- এর ওপরে কমিশন নির্ভর করবে। কমিশন খুব সমস্যা নয়। বিষয় হলো, একেকটির জন্য আলাদা অফিস নেয়া যাবে না। অন্য অফিসের সাথে একীভূত করে দিতে হবে।

একই ব্যক্তি যদি ক্ষুদ্র, তাকাফুল, এককবীমা বিক্রি করে তাহলে সমস্যা নেই।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের ন্যূনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

অজিত চন্দ্র আইচ: সবকিছুর আগে ফোকাসিং দরকার। সাধারণ জনগণ বীমার আওতায় আসা উচিত। এটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অংশ। বীমা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কমিশন শিকার করা অনেকের উদ্দেশ্য থাকে। এজন্য সহজ সরল লোকের কাছে যায়। এজন্য ডেস্ক থেকে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বার্তা দিতে হবে। সচেতন করতে হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে আপনাদের কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?

অজিত চন্দ্র আইচ: আমাদের মিনিমাম প্রিমিয়ামে কৃষকদের বীমা সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এলাকাভিত্তিক কৃষকদের সমিতি সৃষ্টি করে, সংঘবদ্ধ করে গ্রুপ বীমার বীমার আওতায় নিয়ে আসা। যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কৃষকের মৃত্যু হলে, পঙ্গু হলে কৃষক পরিবার অসহায় হয়ে না পড়ে। সহায়তা পায়। সুরক্ষা পায়।

দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ক্ষুদ্রবীমা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
ডা. কিশোর বিশ্বাস
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
প্রোটেকটিভ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

 

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আপনারা কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?

ডা. কিশোর বিশ্বাস : যেহেতু বাংলাদেশের বীমা আইনে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি এবং কাঠামোগত কোনো নির্দেশনা নেই। তাই আমরা বিদেশের কোম্পানিগুলোকে মডেল হিসেবে নিয়ে ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। পাশাপাশি ক্ষুদ্রবীমার ওপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছি। তাদের সাথে বিভিন্ন আইডিয়া শেয়ারের চেষ্টা করছি। এমনও হয়েছে যে আমাদের মডেল অনুকরণ করে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বীমা প্রতিষ্ঠানের বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথক কোনো আইন কিংবা কাঠামোগত কোনো নির্দেশনা নেই। যার কারণে কমিশন কম থাকায় প্রতিনিধিরা আগ্রহ হারাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্রবীমার ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেশি। তাই ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয়-সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: আপনার কোম্পানিতে ক্ষুদ্রবীমার কী কী পরিকল্প রয়েছে?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: আমাদের প্রতিষ্ঠানের মেয়াদি মাসিক ডিপোজিট স্কিম, গ্রুপ ক্ষুদ্র জীবন এবং স্বাস্থ্যবীমা আছে। এই পলিসিগুলোতে প্রিমিয়াম মাসিক পদ্ধতিতে নেয়া হয় বিধায়, স্বল্প আয়ের কর্মজীবী মানুষের পক্ষে পলিসি চালিয়ে নেয়া সহজসাধ্য হয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেলিকম কোম্পানির মাধ্যমে কিছু ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম আমরা দৈনিক হারে নিয়ে থাকি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: বাংলাদেশের একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। যে কারণে সবচেয়ে বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই অপুষ্টিসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। এদের ক্ষতি নিবারণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রবীমার বিকল্প নেই। তাই দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনীতির সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ক্ষুদ্রবীমার অসীম সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে কিছু কিছু এনজিও যেমন- ব্র্যাক, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড-ওয়াইড আমাদেরকে সাথে নিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনছে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্পআয়ের মানুষের কাছে এই বীমা পৌঁছে দিতে আমরা বিভিন্ন নতুন স্বাস্থ্যবীমা প্যাকেজ এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছি। স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যবীমার সঠিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানানো এবং বীমা সুবিধার ব্যাপ্তি ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি বীমা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষমানব সম্পদ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: বীমা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের জ্ঞান খুবই সীমিত এই সম্পর্কে ধারণা থাকলেও তা নেতিবাচক। পাশাপাশি ক্ষুদ্রবীমা চালু এবং দক্ষভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অভিজ্ঞ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এছাড়া বীমাগ্রাহকদের বীমাসংক্রান্ত আইন-কানুন এবং শর্তাবলি সম্পর্কে জানানোর জন্য মাঠপর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি স্তরের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তোলা। দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে, তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমার নামে যেসব পরিকল্প চালু রয়েছে তার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা অনেকটা সম্ভব হচ্ছে। যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল তারা ক্ষুদ্রবীমা বিপণনের মাধ্যমে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হতে পারেন। পাশাপাশি কোনো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগাক্রান্ত হলে বিভিন্ন আর্থিক ক্ষতি নিবারণ হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্রবীমা খাতে আপনাদের সংগৃহীত প্রিমিয়াম কত এবং এটি মোট প্রিমিয়ামের কত শতাংশ?

ডা. কিশোর বিশ্বাস: বর্তমানে আমাদের ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক প্রায় ১০ লাখ। ক্ষুদ্রবীমা খাতে আমাদের সংগৃহীত প্রিমিয়াম ২৪ কোটি ৭২ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৭ টাকা যা মোট প্রিমিয়ামের ২১ শতাংশ।

 

তিন-চার কোটি মানুষকে ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে বীমা সুরক্ষায় নিয়ে আসা সম্ভব
এম.এম. মনিরুল আলম
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
বেঙ্গল ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এম.এম. মনিরুল আলম: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্রবীমার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ যেমন অর্থ সঞ্চয়ের জন্য ব্যাংকে যেতে পারে না, তেমনি তাদের কর্মক্ষম বা উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের মৃত্যু বা পঙ্গুত্বে তাদের পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা খুবই জরুরি। এই সব দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র বীমার গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। যদিও ধনী ব্যক্তিরা বীমা কিনছেন এবং আমরা আমাদের পলিসি বিক্রি করার জন্য জনগণের ধনী অংশকে লক্ষ্যবস্তু করছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তাদের বীমার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ তারা সবদিক থেকে ভালো। তাদের কাছে একধরনের জোর করে বীমা বিক্রি করা হয় বা কখনও কখনও তারা আয়কর কভারেজ ইত্যাদির জন্য এটি করে। তবে এটি প্রধানত তৃণমূল মানুষের প্রয়োজন। কারণ মূলব্যক্তির উপার্জনের অভাবে পুরো পরিবার বিপদে পড়ে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্রবীমার সুযোগ ভালো কারণ মানুষের বীমা প্রিমিয়াম দেওয়ার ক্ষমতা কম। আমরা যদি কাউকে বছরে ২৪ হাজার টাকা দিতে বলি, তবে তা মাসিক ২ হাজার টাকা হিসাবে বন্ধ হয়ে যায়, তাই অনেকের পক্ষে এটি বহন করা সহজ। কিন্তু যদি একবারে ২৪ হাজার টাকা দিতে বলা হয় তবে এটি তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এখন কয়েকটি বীমা কোম্পানি কিছু এনজিওর সাথে কিছু মাইক্রো প্রোগ্রাম চালাচ্ছে এবং তাদের জন্য প্রিমিয়াম খুব কম। আমি বলতে চাই বার্ষিক প্রিমিয়াম মাত্র ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং এটি গ্রামীণ জনগণের পক্ষে বহন করা সহজ। দেশের প্রায় তিন থেকে চার কোটি মানুষ ক্ষুদ্রঋণের উপর নির্ভরশীল। তাই আমরা যদি এই সংখ্যক মানুষকে ক্ষুদ্রবীমা কভারেজের আওতায় আনতে পারি, তাহলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চার কোটি মানুষকে কভার করা সম্ভব। আমরা যদি আমাদের এজেন্টদের মাধ্যমে এগুলি বিক্রি করতে যাই তবে এটি কঠিন হবে। কারণ আমাদের এজেন্টদের কমিশন দিতে হবে এবং যদি আমরা এটি এনজিওর মাধ্যমে করি তবে এটি অনেক কম ব্যয়বহুল। এর জন্য শুধু একটি বিশ্বাস এবং একটি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।
যখনই একটি পরিবার এমন একজন সদস্যকে হারায় যে আয় উপার্জন করে, এটি তাদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এই পরিস্থিতিতে বীমা একটি নিরাপত্তা জাল হিসাবে কাজ করে। একইভাবে, যদি এই সদস্য অক্ষমতার কারণে পরিবারকে সমর্থন করতে অক্ষম হয়, তাহলে বীমা কোম্পানি আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য পদক্ষেপ নেয়। বীমা সুবিধা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এটি বীমার সবচেয়ে বড় শক্তি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে বীমাগ্রাহক করা হয়। এরপর অনেকে প্রিমিয়াম অব্যাহত না রাখায় জমাকৃত অর্থ ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

এম.এম. মনিরুল আলম: এখন দেশে একটি স্বতন্ত্র বীমা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সংস্থা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং আমরা, কোম্পানিগুলিও কাজ করছি। আইডিআরএ আমাদের পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করছে যে আমরা যদি টেকসই ব্যবসা করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই নৈতিকভাবে কাজ করতে হবে। ব্যবসা ভুল করা আমাদের টেকসই ব্যবসায় ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাবে। সিইও লেভেলে, কোম্পানির বোর্ড লেভেল সবাই বুঝেছে যে ব্যবসা করতে হবে নৈতিক উপায়ে সব সম্মতি বজায় রেখে। কর্তৃপক্ষ আমাদের বোঝাতে সফল হয়েছে এবং এখন বীমা ব্যবসার মান দিনে দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। আগে আমাদের কোনো ব্যাংক নিশ্চয়তা ছিল না কিন্তু এখন সরকার এটা নিয়ে ভাবছে, ব্যাংক নিশ্চয়তা মানে ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পলিসি বিক্রি করা, বীমার প্রস্তাব ব্যাংকের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া হবে কারণ মানুষ ব্যাংকারদের অনেক বেশি বিশ্বাস করে তাই তারা আরও পলিসি বিক্রি করতে পারবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স বা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে বীমার কী ভূমিকা রয়েছে?
এম.এম. মনিরুল আলম: বর্তমানে, জনসংখ্যার প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ ব্যাংকিং অ্যাক্সেস পেয়েছে। বীমা কোম্পানিগুলি ব্যাংকযুক্ত এবং ব্যাংকবিহীন উভয় লোককে কভার করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরের লোকেরা বীমা পণ্যগুলিতে আরও আগ্রহ দেখায় এবং একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং নিয়মিত আমানত করতে চায়। তাদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্রবীমা বা গ্রামীণ বীমা, যা এখন বীমা কোম্পানিগুলির প্রধান ফোকাস। ব্যাংকবিহীন জনসংখ্যা এখন প্রধান ফোকাস এলাকা। ফলে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য একে অপরের পরিপূরক হচ্ছে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: দেশে স্বাস্থ্যবীমার সম্ভাবনা কতটা? এবং কীভাবে স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব?
এম.এম. মনিরুল আলম: পেশাগত এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবীমা খুবই প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। মানুষ অপ্রয়োজনে চিকিৎসাসেবা পেতে চায় না, আকস্মিক চিকিৎসা প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুত করে না। মানুষের এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। বাস্তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭০ শতাংশ পরিশোধ করা হয় পকেটের বাইরের খরচ থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ আসে বহুজাতিক কোম্পানি বা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বীমা সুবিধা থেকে। সুতরাং স্বাস্থ্যবীমার জন্য একটি বিশাল বাজার আছে। যত বেশি মানুষ এর আওতায় আসবে প্রিমিয়াম তত কমবে এবং প্রান্তিক পর্যঅয়ে এই বীমা সহজলভ্য করা যাবে।

 

দেশে প্রান্তিক জনগণের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ক্ষুদ্রবীমার সম্ভাবনাও ব্যাপক

মো. জালালুল আজিম
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমাবিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবনবীমা কোম্পানি ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আপনারা কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?

মো. জালালুল আজিম: এটি সত্য, বীমা আইনে ক্ষুদ্রবীমা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু নেই। গ্রামীণ ও সামাজিক খাতে কী পরিমাণ ব্যবসা করতে হবে সে সংক্রান্ত একটি প্রবিধান রয়েছে। বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই আমরা ক্ষুদ্রবীমার একটি গাইডলাইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছি। প্রবিধানের দাবি জানিয়েছি, কিন্তু হয়নি। যার ফলে একেক কোম্পানি একেকভাবে ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্ষুদ্রবীমা মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বীমার আওতায় আনা। বীমা আইনের ৬ ধারায় গ্রামীণ ও সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় বীমা নীতিতেও দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী বীমা পলিসির কথা বলা হয়েছে। মূলত বেসরকারি খাতে ডেল্টা লাইফ ক্ষুদ্রবীমা শুরু করে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বীমার আওতায় আনতে গণবীমা ও গ্রামীণ বীমা শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নতুন ক্ষেত্রে গিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানো। সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ছিলো বীমা অঙ্ক। কম প্রিমিয়াম। এভাবে দেশব্যাপী তারা বীমাকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদেরকে অনুসরণ করে। ডেল্টার ক্ষুদ্রবীমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিলো। কিন্তু অন্য কোম্পানিগুলো সেই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারেনি। তারা গুলিয়ে ফেলে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে আপনাদের কী কার্যক্রম রয়েছে?

মো. জালালুল আজিম: আমাদের এখানে একটি উইং রয়েছে ক্ষুদ্রবীমার। আমাদের মোট মোট প্রিমিয়ামের ১৫ শতাংশ ক্ষুদ্রবীমা থেকে আসে। এটি ট্র্যাডিশনাল বা এককবীমার মতোই চলছে। তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষুদ্রবীমার মতো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমাদের নেই। কিন্তু ক্ষুদ্রবীমাকে জনপ্রিয় করতে ও খরচ কমাতে পাইলট প্রকল্প চালু করেছি। কিছু এনজিও, টেলিকম কোম্পানি, গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশিপে যাচ্ছি। দ্রুত দাবি নিষ্পত্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করছি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ কমিশন হার এবং ব্যস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন কতটা জরুরি বলে মনে করেন?

মো. জালালুল আজিম: সার্বিক প্রবিধান হলেই কমিশনের বিষয়টি চলে আসবে। ক্ষুদ্রবীমাকে সফল করতে হলে অবশ্যই কমিশন কম হতে হবে। কমিশন শিডিউল থাকবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মো. জালালুল আজিম: বাংলাদেশের আপামর জনগণকে বীমার আওতায় আনতে হলে অবশ্যই ইনক্লুসিভনেস বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার কথা চিন্তা করতে হবে। এটি চিন্তা করলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পার্টনারশিপ থাকতে হবে। এটি হলো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশিপ- যার কাছে ইতিমধ্যেই অনেক সদস্য রয়েছে। সদস্যদের এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বীমা সুবিধা দেব। এভাবে খুব কম সময়ের ভেতরেই প্রচুর লোককে বীমার আওতায় আনা যাবে। যেমন- টেলিকম কোম্পানির প্রায় ১০ কোটি গ্রাহক আছে। যদি এসব কোম্পানিকে পার্টনার বানানো যায়। তাহলে একসঙ্গে ১০ কোটি গ্রাহককে বীমার আওতায় আনা যাবে। তাদের যত লেভেলের গ্রাহক আছে, সবাইকে বীমার আওতায় আনা যাবে। বাস-মালিক সমিতি যাত্রীরদের বীমার আওতায় আনতে পারবে। তারা প্রত্যেকটি টিকেটের সাথে প্রিমিয়াম নিতে পারে। এটি করতে হলে সার্বিকভাবে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। পার্টনারশিপ মডেল আইন দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। একটি এনজিওকে কীভাবে বীমা দিলাম সেই প্রশ্ন যাতে না আসে, সেই আইনগত বাধা দূর করতে হবে। এখন গ্রুপবীমার আওতায় আমরা এনজিওগুলোর সাথে বীমা পার্টনারশিপ করছি। কিন্তু সুন্দর একটি প্রবিধান করা গেলে আরো ভালোভাবে কাজ এগোবে। দেশে প্রান্তিক জনগণের সংখ্যা বেশি। সুতরাং এই সম্ভাবনাও বেশি, যদি আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: গার্মেন্ট সেক্টর, এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যদের আপনার কীভাবে বীমা সুবিধা দিচ্ছেন?

মো. জালালুল আজিম: গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যদের জন্য আমাদের স্বাস্থ্যবীমা রয়েছে। বীমার আওতায় থাকা কর্মীরা অসুস্থ হলে আমাদের পার্টনার হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পাবেন। এর সমস্ত খরচ আমরা হাসপাতালকে দেবো।
তাদের প্রিমিয়াম খুবই কম মাত্র ৫৭৫ টাকা। এর বিনিময়ে বছরে ৩০ হাজার টাকার স্বাস্থ্যবীমা, ৫০ হাজার টাকা জীবনবীমা আমরা দেই। নারীকর্মীদের সন্তান হলে সাড়ে ৭ হাজার টাকা খরচ আমরা দেই। এসব কিছুর জন্য আইনকে সহজ করে দিতে হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়ন এবং পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জনে চ্যালেঞ্জসমূহ কী বলে আপনি মনে করেন?

মো. জালালুল আজিম: বাংলাদেশে ক্ষুদ্রবীমা পদ্ধতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ প্রিমিয়াম, যথাযথ বা উপযুক্ত পরিকল্প নেই। এজন্য কম প্রিমিয়ামের পলিসি বানাতে হবে, কম খরচে ব্যবসা করতে হবে। না হলে প্রিমিয়াম কমানো যাবে না। পার্টনারশিপের আইনগত ফ্রেমওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সাথে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্সকে আগাতে হলে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আনতে হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সমাজের নিম্নবিত্তদের আইন-কানুন ও শর্তাবলি সম্পর্কে জ্ঞাত না করে, সঠিক তথ্য না দিয়ে ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক করা হয়। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি মনে করেই সঞ্চয় করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কোনো সময়ে প্রয়োজনবোধে জমাকৃত অর্থ সঞ্চয় ও উত্তোলন করা যাবে। ফলে অনেকে পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের ন্যূনতম সময় দুই বছর প্রিমিয়াম প্রদান না করেই কিংবা তার অধিক সময় প্রিমিয়াম প্রদান করে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে জমাকৃত সঞ্চয় ফেরত পেতে চান। কিন্তু আইনগত কারণে তাদের জমাকৃত অর্থও অনেক সময় ফেরত পান না। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা বা সংশোধনী থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

মো. জালালুল আজিম: কিছু কিছু অসাধু এজেন্ট পলিসি সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য না জানিয়ে এটি করে। ব্যাংক এবং বীমার মধ্যে পার্থক্য বোঝায় না। তবে এর থেকে উত্তরণের জন্য কোম্পানিগুলো ও বীমা কর্তৃপক্ষ প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ করছে। গ্রাহক প্রিমিয়াম জমা দিলে বীমা কর্তৃপক্ষ মোবাইল বার্তা দিচ্ছে। কোম্পানিও দিচ্ছে। এতে গ্রাহক নিশ্চিত হচ্ছেন যে, তার টাকা আত্মসাৎ হয়নি। অতীতে এটি ছিলো না। ডিজিটাল করার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা শুরু কেউ নতুন গ্রাহক হলে তাকে ওয়েলকাম মেসেজ দেই। প্রিমিয়াম দেয়ার সময় হলে মনে করিয়ে দেই। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিগুলো আসায় আর্থিক সমস্যাগুলো কমেছে, ভবিষ্যতে আরো কমবে। কিন্তু গ্রাহককে সচেতন করে পলিসি বিক্রি করা; এটির জন্য সময় লাগবে। পেশাদার এজেন্ট তৈরি হলে, তাদেরকে সঠিকভাবে ট্রেনিং দিলে এটিও দূর হবে, উন্নতি হবে। প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে আমাদের।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে আপনাদের কী উদ্যোগ রয়েছে?

মো. জালালুল আজিম: দুর্ভাগ্যবশত দেশে শুধুমাত্র কয়েকটি কোম্পানির স্বাস্থ্যবীমা প্রোডাক্ট আছে, তাও পরিপূর্ণ নয়। দেশে একক স্বাস্থ্যবীমা নেই। এটি সবার দরকার। বাংলাদেশের বীমা মার্কেটের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যবীমা।
স্বাস্থ্যখাতে খরচ যেভাবে বাড়ছে বীমা সুবিধা না নিলে তা নির্বাহ করা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির নামে সরকারের যা আছে, সেটিকে স্বাস্থ্যবীমা বলা হলেও স্বাস্থ্যবীমা নয়। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করতে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবীমার একটি বড় মার্কেট আছে। সবার জন্যই স্বাস্থ্যবীমা দরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যদি সরকারের সাপোর্ট থাকে, তাহলে গরিব-ধনী সবাইকে স্বাস্থ্যবীমার সুরক্ষা দিতে পারবো।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকরা নানাভাবে দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কৃষি ও কৃষককে বীমার আওতায় আনতে বিশ্বজুড়ে দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদেরও বীমার আওতায় আনার। এটিকে কীভাবে দেখছেন এবং আপনাদের কী উদ্যোগ রয়েছে?

মো. জালালুল আজিম: কৃষি ও কৃষককে বীমার আওতায় আনতে প্রথমদিকে পুরো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। সরকার মন্ত্রণালয়গুলোতে ক্ষতি পূরণের জন্য বরাদ্দ দেয়। এখান থেকে একটি অংশ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম বাবদ খরচ হতে পারে। কোথাও সাইক্লোন হলে ফসল নষ্ট হয়, গবাদিপশুর মৃত্যু ঘটে। এসময়ের জন্য সরকারের ত্রাণ বরাদ্দ থাকে, অর্থ সহায়তা থাকে। সেখান থেকে প্রিমিয়াম বাবদ কিছু অর্থ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে দিতে পারে। কোম্পানি সেখানে বীমা দিতে পারে। এতে সরকারের খরচ কমবে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সরাসরি এই অর্থ দিলে সিস্টেম লস কমবে। এ ধরনের বীমা নিশ্চিত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি, মৎস্য, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় পাইলট আকারে বীমা করে দেখতে পারে। গ্রাহকরা যখন ক্লেইম পাবে তখন তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে আসবে। নিজেরাই প্রিমিয়াম দিবে। নদীতীরবর্তী, বন্যাপ্রবণ, ভাঙনপ্রবণ এলাকার লোকজনকে বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

 

ক্ষুদ্রবীমাকে প্রসারিত করতে হলে এমআরএ ও আইডিআরএ’র মধ্যে সমন্বয় করতে হবে

এস এম জিয়াউল হক
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বাংলাদেশের বীমা আইন বা বীমা বিধিতে ক্ষুদ্রবীমার কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ক্ষুদ্রবীমা পরিকল্প চালুর বিষয়ে কাঠামোগত কোনো নির্দেশনাও নেই। তা সত্ত্বেও দেশের বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি
ক্ষুদ্রবীমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আপনারা কোন মডেলের ভিত্তিতে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?

এস এম জিয়াউল হক: বীমা আইনের ৬ ধারায় গ্রামীণ ও সামাজিকখাতে বীমা ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। কী পরিমাণ ব্যবসা করতে হবে সে সংক্রান্ত একটি প্রবিধানও রয়েছে। সাধারণত ছোট অংকের বীমাকে আমরা ক্ষুদ্রবীমা বলি।
অ্যাকচুয়ারি প্রোডাক্ট ডিজাইন করে দিলে বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয়। এখানে দুর্বলতার জায়গাটি অন্যখানে। প্রিমিয়াম সংগ্রহের পদ্ধতিটি কী হবে, প্রিমিয়াম জমা হচ্ছে কি না, নির্দিষ্ট সময়ে হচ্ছে কি না, জমা টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে- এগুলো হচ্ছে বিষয়। ক্রেডিট শিল্ড ইন্স্যুরেন্স বা ঋণ সুরক্ষা বীমা বাংলাদেশে রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এই ক্রেডিট শিল্ড মডেলে অনেকে কাজ করছেন।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এস এম জিয়াউল হক: দেশে অন্তত তিনকোটি লোক ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশালসংখ্যাটা যদি ইন্স্যুরেন্সের সুরক্ষায় আসে তাহলে একসঙ্গে তিন কোটি লোককে আমরা পেয়ে যাব। কিন্তু এখানে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ও বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। বীমা আসলে রিস্ক প্রোটেকশন দেয়। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের দেশ হবে। উন্নত দেশে কিন্তু এই বীমা সামগ্রিকভাবে সরকার তার জনগণকে প্রোটেকশন দিয়ে থাকে। কিন্তু আমদের বীমার ব্যাপারে অসচেতনতা আছে। আমরা আমাদের অবস্থান সেভাবে তৈরি করতে পারিনি। আমাদের বর্তমান সরকার বুঝতে পেরেছে ডাবল ডিজিট জিডিপি এনসিওর করতে হলে, বীমাশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটেই বীমাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। ঘরে ঘরে এই জীবন বীমাকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিতে হবে। ঘরে ঘরে যদি আমরা জীবন বীমা পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে মানুষ রিস্ক প্রোটেক্টেড থাকবে সঞ্চয়ের প্রোটেকশন আসবে। শিক্ষাবীমা করলে শিক্ষার প্রোটেকশন আসবে। পেনশন থেকে সুবিধা পাবে। স্বাস্থ্যবীমা নিলে স্বাস্থ্যের প্রোটেকশন পাবে। নিজের সঞ্চয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। সঞ্চয়ের ক্ষতিটা কিন্তু ইন্স্যুরেন্স ও রি-ইন্স্যুরেন্স পূরণ করবে। তেমনিভাবে রাষ্ট্রের যত কার্যক্রম আছে। যেমন এখন বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে, সেতু হচ্ছে, এগুলোর নিরাপত্তা বা রিস্ক প্রোটেকশন কিন্তু বীমার মাধ্যমে হয়ে থাকে। বন্যায় যে, আমাদের কৃষকদের ক্ষতি হয়ে যায়, বীমা এই ক্ষতির প্রোটেকশন দেবে। এভাবে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র তার প্রোটেকশন নিশ্চিত করতে পারে। আমরা যেহেতু উন্নত বিশ্বের দেশে যেতে চাই। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন প্রোটেকশন নিশ্চিত করা।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্পআয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে আপনাদের কী উদ্যোগ রয়েছে?

এস এম জিয়াউল হক: প্রান্তিক এবং গ্রামীণ জনগণের জন্য সরকারের একটি কর্মসূচি রয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি। আমি মনে করি, এই কর্মসূচির সঙ্গে ৬৪টি জেলায় আলাদা বীমা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হোক।
তারা সেখানে জনগণকে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিয়ে আসবে, সরকার এটি শুধু তত্ত্বাবধায়ন করুক। এভাবে সারাদেশের জনগণ স্বাস্থ্যবীমার আওতায় চলে আসবে। এতে সরকারের চাপ ও খরচ কমবে। প্রান্তিক মানুষরাও স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় চলে আসবে।

 

দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে ক্ষুদ্রবীমা

এসএম নুরুজ্জামান
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা
জেনিথ ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রবীমা বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বীমার (ইনক্লুসিভ) প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে ক্ষুদ্রবীমা অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বজনীন অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে এদেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম পথনির্দেশক। অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বীমা বা ক্ষুদ্রবীমার এই সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এসএম নুরুজ্জামান: দারিদ্র্যবিমোচনে ক্ষুদ্রবীমার কোনো বিকল্প নেই। ক্ষুদ্রবীমাই হয়ে উঠতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে সুনির্দিষ্ট আইন, সরকারের সহযোগিতা এবং কোম্পানিগুলোর আন্তরিকতা। ক্ষুদ্রবীমাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। কাঠামোটি এমন হতে পারে যে, গ্রাহক এ প্রকল্প হতে স্বাস্থ্য, সঞ্চয় ও ঝুঁকি- এ তিনটি সেবাই পাবেন। এর জন্য বাস্তবসম্মত প্রিমিয়াম হার নির্ধারণ, ব্যয় হার, প্রিমিয়াম সংগ্রহ পদ্ধতি- একটি নীতিমালায় আনতে হবে।

ক্ষুদ্রবীমাকে লোকসান প্রকল্প নয়, লাভজনক প্রকল্পে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু এসবের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। ক্ষুদ্রবীমা গ্রাহকের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণও এটি। ক্ষুদ্রবীমা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না দিয়ে পলিসি করানো এবং গ্রাহকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা দিতে না পারায় বীমাগ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বীমা সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য প্রচার করছে ভুক্তভোগী এসব গ্রাহক। এ জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার ওপর সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বীমাখাতে কাজ করতে আগ্রহী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যথাযথ মূল্য দিতে হবে তাদের পরিশ্রমের। পেশাগত মূল্য বাড়াতে হবে। দূর করতে হবে চাকরির অনিশ্চয়তা। তাহলে শুধু ব্যাংক নয়, বীমার দিকেও আগ্রহী হবে যোগ্যরা।

ক্ষুদ্রবীমার উন্নয়ন চাইলে প্রিমিয়াম জমা দেয়া বা সংগ্রহে সহজ মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। যাতে ঘরে বসেই গ্রাহক তার প্রিমিয়াম জমা দিতে পারে। নিশ্চিত হতে পারে তার পলিসি সম্পর্কে। এতে ব্যবসা সংগ্রহের খরচ কমে আসবে, জনবল কম লাগবে। তবে যারা কাজ করবে তাদেরকে অবশ্যই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হতে হবে। লেনদেন হতে হবে নিরাপদ মাধ্যমে। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর নীতিমালা। পাশাপাশি ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়ামের সর্বনিম্ন পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। কারণ মানুষের সক্ষমতা এখন বেড়েছে। জেনিথ ইসলামি লাইফে ক্ষুদ্রবীমাকেও আমরা সমান গুরুত্ব দেই। একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করি ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে। জেনিথ লাইফে মাসিক ৩শ’ টাকা দিয়ে ৩০ হাজার টাকার ঝুঁকি নেয়া যায়। এখানে এসবি সুবিধাও রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি ক্ষুদ্রবীমা গ্রাহকদের আরো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর।

এই বীমা জনপ্রিয় হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বিমোচনে কার্যকর ভূমিকাও রাখবে ক্ষুদ্রবীমা।

ব্যাংক-বীমা-অর্থনীতি: বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যবীমাকে ক্ষুদ্রবীমার একটি পণ্য বিবেচনা করা হয়। ক্ষুদ্রবীমা পণ্য হিসেবে যা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়-সাপেক্ষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়ন বা স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে এই বীমা সুবিধা পৌঁছে দিতে কী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন?

এসএম নুরুজ্জামান: অন্যান্য দেশ নানাভাবে তাদের জনগণকে বীমার আওতায় আনার চেষ্টা করছে। স্বাস্থ্যসেবা দিতে বীমাকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের দেশেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বীমার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রবীমা হতে পারে শক্তিশালী মাধ্যম। সরকার প্রয়োজনে প্রিমিয়ামের একটি অংশ বহন করতে পারে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি তাদের আর্থিক চাপও লাঘব হবে।

 

 

 

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৭:৩১ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।