সোমবার ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চরম সংকটে পতিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত

আদম মালেক   |   শনিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২০   |   প্রিন্ট   |   287 বার পঠিত

চরম সংকটে পতিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত

প্রায়ই অস্থির হয়ে ওঠে ব্যাংকিং খাত। এমনিতেই সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণের অসহনীয় চাপ, অদক্ষতা, ঋণ কেলেঙ্কারি ও নানা অনিয়মে সংকটাপন্ন এই খাত। তার ওপর করোনাকালে একদিকে যেমন ব্যয় হ্রাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানো হয়, তেমনি কমেছে ব্যাংকগুলোর আয়। উদ্যোক্তাদের রক্ষায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও খেলাপি না করার মেয়াদ বারবার নবায়নের সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারল্য প্রবাহ বাড়াতে কমানো হয়ে নগদ জমার হার (সিআরআর)। বাড়ছে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের চাপ। এসব নানা প্রতিক‚লতায় ব্যাংকিং খাত চরম সংকটে পতিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, করোনার কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে কোনো গ্রাহক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। করোনার প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় গত ১৫ জুন আরো তিন মাস বৃদ্ধি করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। এরপর স¤প্রতি সেই সময় আরো তিন মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দিলেও চলবে। কিস্তি না দিলে কেউ ঋণখেলাপি হবে না। আবার এই সময়ে ঋণের ওপর কোনো ধরনের দণ্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি আরোপও করা যাবে না। তবে যদি কেউ ঋণ শোধ করে নিয়মিত গ্রাহক হন, তাকে খেলাপি গ্রাহকের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এতে কিছু অসাধু গ্রাহক সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না।

জানা যায়, ব্যাংকের ইতিহাসে বেসরকারি ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে এ করোনার সময়ে। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মী ছাঁটাই করেছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক। মাঝে মাঝে দেশের ব্যাংকগুলোতে কিছু কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা শোনা গেলেও একসাথে এতো অধিক সংখ্যক কর্মী কখনো ছাঁটাই হয়নি।

এ বছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার কথা সরকারের। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এদিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ১১ ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ও বেসরকারি সাতটি ব্যাংক রয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। শুধু প্রভিশন ঘাটতিই নয় মূলধন ঘাটতির কবলে রয়েছে অনেক ব্যাংক। ১০টি ব্যাংক মূলধন ভেঙে খাচ্ছে বলে জানা যায়। গত জুন শেষে ব্যাংকখাতে সার্বিক মূলধন ঘাটতি ১১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১০ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এ সময় অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১৫৯ কোটি টাকা। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ১০ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার আগে যে পরিমাণ কিস্তি আদায় হতো তার চেয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কিস্তি আদায় কমেছে। এখন আদায় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আর কিস্তি আদায় না হলেও খেলাপি করা যাবে না প্রকৃত ভুক্তভোগীদের ঋণে। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত কিস্তি দিচ্ছে না। এক সময় এ ঋণগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
তবে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত। তিনি মনে করেন, করোনাকালে ঋণ প্রবাহ ঠিক রাখতে সিআরআর কমানোসহ কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি সাব্যস্ত না করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। ঋণগ্রহীতাদের সদাচরণে ওপর এর সুফল নির্ভর করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুন মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত বছরের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিতরণ করা ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল খেলাপি। আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের বেশি থাকলেই ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশে আছে ৯ শতাংশের বেশি। এতে এমনিতেই ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকিং খাত। এর মধ্যে করোনার মহামারীর কারণে ঋণের কিস্তি আদায় না হলেও খেলাপি হিসেবে ধরা না হওয়ার কারণে অদৃশ্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া স¤প্রতি বৃহৎ ও ছোট শিল্পের করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঋণেও খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কিস্তি আদায় কম হওয়ায় ঋণ ও সুদ আদায় কমে গেছে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংকের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে লোকসানি শাখাও।

জানা গেছে, চলতি বছরে সোনালী ব্যাংক ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। তবে জুন পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে আড়াই কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা ২৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০টি। জনতা ব্যাংকের লোকসানি শাখা ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৯। বছরের প্রথম ৬ মাসে ব্যাংকটি ৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। অথচ গত বছরে ২৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল তারা। অবশ্য সোনালী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। পুরো বছরে রূপালী ব্যাংক খেলাপি ঋণ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে দেড় কোটি টাকা।

ব্যাংকটির লোকসানি শাখা ১১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬টি। অগ্রণী ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করলেও আদায় করেছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। আর লোকসানি শাখা বেড়ে হয়েছে ১৮ থেকে ৭৮। প্রথম ৬ মাসে নিট মুনাফা করেছে মাত্র ১৫ কোটি টাকা, গত বছরের পুরো সময়ে হয়েছিল ১০৭ কোটি টাকা।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ২:০৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২০

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।