বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ০৮ মে ২০১৯ | প্রিন্ট | 605 বার পঠিত
‘ভালো খেলাপি’র সুযোগ নিতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ঋণখেলাপিদের মধ্যে। পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখায় শত শত আবেদনও জমা পড়েছে। আবার খেলাপি নয়, এমন গ্রাহকও বিশেষ সুবিধার আওতায় আসার তোড়জোড় শুরু করেছেন। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থাকলে বিশেষ সুবিধা পাবেন, এমন খবরে খেলাপির খাতায় নাম তুলতে তদবির করছেন নিয়মিত গ্রাহকরা।
২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন গ্রাহক—অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর থেকেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক দিনে রাজধানীর মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এলাকার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় গিয়ে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। ব্যাংকাররাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে অনেকেই নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ঋণখেলাপি নন, এমন একজন গ্রাহকের সঙ্গে গত রোববার দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় কথা হয় এ প্রতিবেদকের। গত ডিসেম্বর থেকে তার ঋণটি খেলাপি দেখানো যায় কিনা, এমন তদবির নিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে আসেন তিনি। শাখা ব্যবস্থাপকের কক্ষে বসেই ওই গ্রাহক বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি হলে অর্থমন্ত্রী ঘোষিত বিশেষ পুনঃতফসিলের আওতায় পড়বেন, এমন তথ্য পেয়েই তিনি ব্যাংকে এসেছেন। ওই সময়ের মধ্যে তাকে খেলাপি করে দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে বারবার অনুরোধ করেন তিনি। এজন্য কিছু খরচ হলে সেটি দেয়ার সম্মতিও জানান ব্যাংকের ওই নিয়মিত গ্রাহক।
দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বড় শাখাগুলোর অবস্থান মতিঝিলে। এ শাখাগুলো থেকে দেশের বড় করপোরেট ও গ্রাহকদের ঋণ দেয়া হয়েছে। অন্তত এক ডজন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ও করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপকরা জানান, গত কয়েক দিন থেকে ব্যাংকের গ্রাহকরা অদ্ভুত সব আবদার নিয়ে আসছেন। শত শত ঋণখেলাপি বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদনও করে ফেলেছেন। এ-সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হলেও গ্রাহকদের অনুরোধে সে আবেদন জমা নেয়া হচ্ছে। সিংহভাগ নিয়মিত গ্রাহক মাসিক ও ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা জমা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ ডিসেম্বর থেকে খেলাপি দেখানোর দাবি নিয়ে আসছেন।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার ঋণবিষয়ক এক কর্মকর্তা জানান, অনেক চেষ্টা করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে, এমন একজন গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল করাতে রাজি করিয়েছিলাম। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের অর্থ জমা দিতে চট্টগ্রাম থেকে গত ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন ওই গ্রাহক। কিন্তু ওইদিন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে গ্রাহক টাকা জমা না দিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে যান। যোগাযোগ করলে ওই গ্রাহক বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের পুনঃতফসিল সুবিধা পেলে আপনাদের ৫ শতাংশ অর্থ দেব কেন?
খেলাপিদের পাশাপাশি নিয়মিত গ্রাহকদের নিয়েও বিপত্তিতে আছেন বলে জানান সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. কামাল হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঋণখেলাপিরা বিশেষ সুবিধা পাবেন, এমন ঘোষণায় নিয়মিত গ্রাহকরাও মাসিক ও ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা জমা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিশেষ সুবিধা চেয়ে ১৫-২০ জন গ্রাহক আবেদনও করেছেন। অথচ এ-সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপনই এখনো জারি হয়নি।
এ ব্যাংকার বলেন, খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনার প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে ব্যাংকের দৈনন্দিন জমা অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশের প্রায় সব ব্যাংকে নগদ তারল্য শূন্য হয়ে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমরা ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কলমানিতে অর্থ ধার দিই। কলমানি বাজারও ড্রাই হয়ে গেছে।
এর আগে গত মার্চ থেকে ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেয়া, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকবার বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, তফসিলি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-এমডিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেন তিনি।
খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে গত ২৫ মার্চ এক ঘোষণায় তিনি বলেন, মোট ঋণের ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে ভালো খেলাপিরা নিয়মিত হতে পারবেন। ঋণের পুরো অর্থ পরিশোধে সময় পাবেন ১২ বছর। সুদহার ১০, ১২ বা ১৫ যা-ই থাকুক না কেন, ঋণের সুদ হবে ৭ শতাংশ। ১ মে থেকে এটি বাস্তবায়ন হবে। এরপর ২ এপ্রিল তিনি ঋণের সুদহার ৭-এর পরিবর্তে ৯ শতাংশ হবে বলে জানান।
এর পরিপ্রেক্ষিতে খেলাপি গ্রাহকদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে খসড়া নীতিমালা পাঠানো হয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজের মতামত জানিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো খসড়া নীতিমালাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৫ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলসংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালাটি উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো খসড়া নীতিমালার শর্তগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতও পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হবে। পর্ষদ সভার নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অপ্রত্যাশিত বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এর আগে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি গ্রাহকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, তার পেছনে সৎ উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেসব সুবিধা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলসংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করতে পারে। কিন্তু অযৌক্তিক কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া হলে সেটি কার্যকর করা কঠিন হবে। ব্যাংকারদের দায়িত্ব হবে কোনো সুযোগের অপব্যবহার না করা। প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার আগে বিশেষ পুনঃতফসিলের কোনো আবেদন গ্রহণ না করার জন্য আমরা শাখাগুলোয় বার্তা পঠিয়েছি।
এদিকে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন জমা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (কলমানি), রেপো ও বিশেষ রেপোর সুদহার ও চাহিদায়। গত এপ্রিল থেকেই কলমানির সুদহার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ব্যাংকের ক্ষেত্রে কলমানি সুদহার গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। নগদ তারল্য সংকটের কারণে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে গত দুই মাসে ৯ শতাংশ সুদ দিয়ে বিশেষ রেপোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করেছে কয়েকটি ব্যাংক। রেপোতে ধার নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে এ সময়ে। গত সোমবার কলমানি বাজারে ছিল অর্থের তীব্র সংকট। সোনালী ব্যাংকের মতো বৃহৎ ব্যাংককেও এদিন অগ্রণী ব্যাংক থেকে কলমানিতে অর্থ ধার করতে হয়েছে।
Posted ১২:২০ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৮ মে ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed