আদম মালেক | বৃহস্পতিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২০ | প্রিন্ট | 361 বার পঠিত
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা মানছে না সরকার। এজন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আর্থিকবাজার, মুদ্রানীতি হিসাববিজ্ঞান ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা থাকলেও তাদের জায়গা তেমন নেই। বরং এসব পদে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থদের নিয়োগ দিয়ে খুশি রাখতে চায় সরকার। তাদের আবদারকেই সহানুভ‚তির সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই অতীতের মতো সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পদ পেতে ইতোমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন শাসক দলের নেতারা।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক আমাদের সংকটে ফেলেছে। এক্ষেত্রে নিয়োগের ব্যাপারে নীতিমালা থাকলেও সরকার তা অনুসরণ করছে না। সরকার কেন এমন করছে তা আমার বোধগম্য নয়। তবে এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আমি আশা করি।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদগুলোকে অধিকতর কার্যকর, দক্ষ ও পেশাভিত্তিক করতে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংকের পর্ষদগুলোতে অর্থনীতিবিদ; সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ (সিএ), আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি; সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী থাকবেন। প্রায় একযুগ হতে চললেও পর্ষদ সদস্য বা পরিচালক নিয়োগে ওই প্রজ্ঞাপনের কোনো প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন নেই। শুরু থেকে এ প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন করে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয় নিজেই।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ শুরু হলে ব্যাংকি খাতে বেশি অস্থিরতা দেখা দেয়। ২০০৯ সাল থেকে দলীয় নিয়োগে বেশি ঝুঁকে পড়ে সরকার। এজন্য ব্যাংক খাতে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জন্ম হয়। এ সময় ঢালাওভাবে দলীয় লোক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী জান্নাত আরা, আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা নাগিবুল ইসলাম, সাইমুম সরওয়ার কমল, মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া, যুবলীগের খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির, সাবেক ছাত্রলীগের বলরাম পোদ্দার, সুভাষ সিংহ রায়, শাহজাদা মহিউদ্দিন, জাকির আহমেদ, আবদুস সবুর প্রমুখ।
দুর্নীতিতে মারাত্মক উদাহরণ তৈরি করেছেন বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লোপাটের ঘটনা ঘটে। তার ব্যাংকবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ওই ব্যাংকের পরিচালক প্রয়াত রেজাউর রহমান অভিযোগ করেছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। কিন্তু বিভাগটি উল্টো তাকেই সরিয়ে দিয়েছিল।
অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারো রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পর্ষদে জায়গা পেতে তৎপরতা শুরু করছেন শাসক দলের নেতারা। নিয়োগ পেতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে বর্তমানে ৩০টির মতো দলীয় কর্মীর জীবনবৃত্তান্ত জমা রয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা ছাত্রলীগের কোনো না কোনো বর্তমান ও সাবেক নেতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ সরাসরি আসছেন, কেউ বা তদবির করছেন ফোনে।
সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির মধ্যেও নেই তারা। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পরিচালক আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর ভ‚মিকা রাখলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে অপসারণ করতে পারবে। তবে সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইনে আরো বলা আছে, তাদের আচরণ সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা পরে সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, পরিচালক নিয়োগের ফাইল অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে উপস্থাপনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাবেক আমলাদের সম্পর্কের ভিত্তিতে। কোনো কোনো নাম আসে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তবে প্রজ্ঞাপনের ধারে-কাছেও যাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সোনালী, অগ্রণী ও বিডিবিএলে একজন করে নারী পরিচালক থাকলেও জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে নেই। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, গবেষকও নেই। অগ্রণী ব্যাংকে অবশ্য গবেষক আছেন একজন।
চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) প্রতিটি ব্যাংকে পর্ষদ থাকার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে ১৩ সদস্যের। কিন্তু কোম্পানি হয়ে যাওয়া সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলে পূর্ণাঙ্গ পর্ষদ নেই।
সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ এখন ৯ সদস্যের। এর মধ্যে চেয়ারম্যান-এমডি ছাড়া সাবেক আমলা রয়েছেন দুজন। একজন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুল হক, অন্যজন বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোল্লা আবদুল ওয়াদুদ। এ ছাড়া রয়েছেন একেএম কামরুল ইসলাম নামে একজন সিএ এবং বুয়েটের সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। বাকি তিনজন সাবেক ব্যাংকার।
চেয়ারম্যান-এমডিসহ জনতা ব্যাংকের আট সদস্যের পর্ষদে একজন সাবেক জেলা জজসহ চারজনই সাবেক আমলা ও দুজন সাবেক ব্যাংকার।
অগ্রণীর পর্ষদ সাতজনের। এ ব্যাংকে সাবেক আমলা একজনও নেই। আছেন সাংবাদিক কাশেম হুমায়ুন, রাজনীতিবিদ কেএমএন মনজুরুল হক, সাবেক জেলা জজ তানজিনা ইসমাইল এবং দুই সাবেক ব্যাংকার খন্দকার ফজলে রশীদ ও ফরজ আলী।
রূপালী ব্যাংকের পর্ষদও সাত সদস্যের। সাবেক সচিব মনজুর হোসেন গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাংসদ হওয়ার আগে থেকেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, এখনো চেয়ারম্যান। এ ব্যাংকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে কর্মরত অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক খলিলুর রহমান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রিজওয়ানুল হুদা পরিচালক হিসেবে আছেন।
বিডিবিএলের আট সদস্যের পর্ষদে চেয়ারম্যান হচ্ছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন। অর্থ বিভাগে কর্মরত অতিরিক্ত সচিব এখলাছুর রহমানের পাশাপাশি আরো আছেন দুজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও দুজন সাবেক যুগ্ম সচিব। এমডি ও একজন সাবেক ব্যাংকার ছাড়া পুরো পর্ষদই আমলানির্ভর।
Posted ৩:২৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২০
bankbimaarthonity.com | Sajeed