বিবিএনিউজ.নেট | বুধবার, ২২ মে ২০১৯ | প্রিন্ট | 1964 বার পঠিত
পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে অনেক দিন ধরেই কোন্দল চলছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে। এ নিয়ে কয়েক দফা মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। তার পরও মেটেনি একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকা প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকটির পর্ষদের এ কোন্দল।
পরিচালকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ছাপ ছিল ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ বৈঠকেও। নতুন চেয়ারম্যান কে হবেন, তা নিয়ে বিরোধে জড়ান পরিচালকরা। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র পরিচালক এম আজিজুল হক হয়েছেন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। যিনি ব্যাংকটির উদ্যোক্তা কিংবা শেয়ারহোল্ডার নন। তবে ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ ৬০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে এম আজিজুল হকের। তিনি ছিলেন ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী (সিইও)। দায়িত্ব পালন করেছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বতন্ত্র পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যানের। দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের শরিয়াহ কাউন্সিল তার হাতে গড়া।
দীর্ঘদিন পূবালী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তির মূল্যায়ন হলো, দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে পূবালী ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে রয়েছে দুটি প্রজন্ম। শুরুতে উদ্যোক্তা হিসেবে থাকা পরিচালকদের একটি অংশ এখনো রয়েছে পর্ষদে। অন্য অংশটি প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের সন্তান। বিভিন্ন বিষয়ে এ দুই প্রজন্মের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দেয়। এর বাইরে উদ্যোক্তাদের একটি অংশ সিলেট অঞ্চলের। অন্য অংশ কুমিল্লা ও বরিশাল এলাকার। নীতিনির্ধারণী পদ ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তিনটি অঞ্চলের পরিচালকরা স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান। তবে নির্দিষ্ট কোনো গ্রুপ তৈরি না হয়ে বরং সময়ে সময়ে পরিচালকদের অবস্থান পরিবর্তন হয়।
গত রোববার ছিল পূবালী ব্যাংক লিমিটেড পরিচালনা পর্ষদের ১ হাজার ২০০তম সভা। ওই সভার কার্যসূচিতে ছিল ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিষয়টি। সভা সূত্রে জানা যায়, শুরুতে ব্যাংকটির পরবর্তী চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রস্তাব রাখেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বরিশাল অঞ্চলের। এ প্রস্তাবের বিরোধিতা আসে সিলেট অঞ্চলের পরিচালকদের পক্ষ থেকে। পরে সিদ্ধান্ত হয় পরিচালকদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচন করার। কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন। পূবালী ব্যাংকের ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে তার মালিকানায়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ৩ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৮৪২টি শেয়ার ছিল সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের মালিকানায়। বিষয়টি নিয়ে বাগিবতণ্ডার পর স্বতন্ত্র পরিচালক এম আজিজুল হককে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার প্রস্তাব আসে। এ প্রস্তাবে সম্মতি জানান বেশির ভাগ পরিচালক। পরে এম আজিজুল হকই পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির পরিচালকদের দীর্ঘদিনের বিরোধ আপাতত নিরসন হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন চেয়ারম্যান এম আজিজুল হক বলেন, পরিচালকদের ইচ্ছায় আমি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। পূবালী ব্যাংকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ব্যাংকটির ইসলামী ব্যাংকিং উইংয়ের জন্য গঠিত শরিয়াহ কাউন্সিলে অনেক দিন থেকেই আমি আছি। ২০১৭ সাল থেকে আছি পরিচালক হিসেবে।
চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকটির কোন দিকটিতে বেশি গুরুত্ব দেবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পূবালী ব্যাংকের ইসলামী উইং আছে। তবে সেটি সাধারণ ব্যাংকিং ধারার তুলনায় দুর্বল। আমি চাইব, দুটি ধারাই সমান্তরালভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে দাপটের সঙ্গে চলুক।
এম আজিজুল হকের নেতৃত্বে পূবালী ব্যাংক এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরও। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী বলেন, নতুন চেয়ারম্যান এম আজিজুল হক সর্বজনগ্রাহ্য, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। পূবালী ব্যাংকের মতো দেশের প্রবীণতম একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তার দায়িত্ব নেয়াটি পুরো ব্যাংকিং খাতে প্রশংসিত হচ্ছে। আশা করছি, তার নেতৃত্বে পূবালী ব্যাংক সমৃদ্ধির পথে হাঁটবে।
১৯৫৯ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের কিছু উদ্যোক্তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক’। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করে ব্যাংকটির নামকরণ করা হয় পূবালী ব্যাংক। পরে ১৯৮৩ সালে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয় ব্যাংকটি। পূবালী ব্যাংক লিমিটেড নামে কার্যক্রম পরিচালনা করা ব্যাংকটির সারা দেশে শাখা রয়েছে ৪৭৩টি। শাখা সংখ্যার দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক এটি।
১৯৮৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার সংখ্যা ৯৯ কোটি ৮৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯০৩। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে ছিল ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার। সরকারি কোনো বিনিয়োগ না থাকলেও ব্যাংকটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ রয়েছে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। বাকি ৪১ দশমিক ১৮ শতাংশই রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
পূবালী ব্যাংকের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যাংকটির উদ্যোক্তা হাফিজ আহমদ মজুমদার। ২০১৬ সালে তিনি ব্যাংকটি থেকে অবসর নিয়ে কন্যা রানা লায়লা হাফিজকে পরিচালক মনোনয়ন দেন। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে টানা তিন বছর পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সিলেটের হাবিবুর রহমান। ডেল্টা হাসপাতাল ও গ্লোবাল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের এ উদ্যোক্তার পূবালী ব্যাংকের শেয়ার রয়েছে প্রায় দুই কোটি। ব্যাংকটির ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে তার মালিকানায়।
পূবালী ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে মনিরুদ্দিন আহমেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ শেয়ার। ব্যাংকটির পরিচালক মনজুর রহমান ২ শতাংশ, ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ২ দশমিক শূন্য ৫, আজিজুর রহমান ২ দশমিক ১৭, মুছা আহমেদ ২, মো. আবদুর রাজ্জাক মন্ডল ৩ দশমিক ৫ ও এম কবিরুজ্জামান ইয়াকুব ২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। অন্য পরিচালকদের মধ্যে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতিনিধি রুমানা শরিফের কাছে ৫ শতাংশ, আরিফ এ চৌধুরীর কাছে ২ ও আসিফ এ চৌধুরীর কাছে ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের আমানত ছিল ৩০ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। একই সময়ে ২৬ হাজার ৩৮২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে ৪১ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটি অবলোপন করেছে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
Posted ২:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২২ মে ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed