নিজস্ব প্রতিবেদক | মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট ২০২২ | প্রিন্ট | 125 বার পঠিত
লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অব্যবহিত নিম্নপদে (উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক) কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে ওই পদে চাকরিপ্রত্যাশী কয়েকজন লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে জানালেও ব্যতিক্রম ছিলেন কোম্পানির নিয়োগ বোর্ডের পছন্দের তালিকায় থাকা মোহাম্মদ মূসা। এই প্রার্থী জানিয়েছিলেন, তার লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। বিষয়টি সংবাদ আকারে গণমাধ্যমে প্রকাশের পরপরই এ নিয়ে সমালোচনা তৈরী হয়। অবস্থা প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ওই বক্তব্যকে সত্য নয় বলে দাবী করেন তিনি। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করায় এ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে ওই প্রার্থী কোন প্রকার চাপে পড়ে নাকি স্বেচ্ছায় এমন বক্তব্য দিচ্ছেন তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ জুন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে উক্ত পদের জন্য কিছু শর্তারোপ করা হয়। এরমধ্যে দুটি শর্ত ছিল প্রার্থীকে মহাব্যবস্থাপক পদে কমপক্ষে তিন বছর এবং বাগান ও কারাখানায় কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অন্যতম আরেক শর্ত ছিল বয়স অনুর্ধ্ব ৫২ বছর হতে হবে। এসব চাহিদা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের আবেদনপত্র পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীদের লিখিত ও ভাইভা (মৌখিক) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃতদের কোন প্রকার লিখিত পরীক্ষা হয়নি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নিয়োগপ্রত্যাশী। শুধু ভাইভা’র মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নিয়োগ শর্তের লঙ্ঘন। অন্যান্য প্রার্থীদের অভিযোগ, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পছন্দের লোক নিয়োগ দিতেই এমন ব্যবস্থা করেছেন ন্যাশনাল টি কর্তৃপক্ষ।
তবে অন্যান্য প্রার্থীদের এমন অভিযোগকে মিথ্যা দাবী করে চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রার্থী মোহাম্মদ মূসা জানান, তিনি লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। সংবাদ আকারে তার এই বক্তব্য প্রকাশের পরই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা তৈরী হয়। এমনকি ন্যাশনাল টি কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বিষয়টি অনুসন্ধানে নমিনেশন অ্যান্ড রিমুনারেশন (এনআরসি) কমিটিকে নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপরই পূর্বের বক্তব্যকে অসত্য বলে দাবী করেন মোহাম্মদ মূসা।
এ বিষয়ে দৈনিক ব্যাংক বীমা অর্থনীতি থেকে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, অন্যান্য প্রার্থীদের মতো আমার ক্ষেত্রেও কোন লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়নি। তাহলে কেন বলেছিলেন আপনারটা হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি জানান, আসলে আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সর্বশেষ তার এমন বক্তব্যে ফের বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, এমনিতেই তার বিষয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতার ঘাটতি থাকার পরও তিনি নিয়োগ পেতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার অসংলগ্ন বক্তব্য কোম্পানির জন্য মানহানিকর। এক্ষেত্রে তিনি কোন প্রকার চাপে পড়ে এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, নাকি নিজেই একেক সময় একেক রকম বক্তব্য প্রদান করছেন তা বোধগম্য নয়।
কোম্পানি সূত্রের সর্বশেষ তথ্যমতে, নিয়ম ভেঙে এমন নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে ব্যবস্থা নিচ্ছেন ন্যাশনাল টি কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। এজন্য এনআরসি কমিটিকে ইতোমধ্যে নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে নিজেদের ভুল অনুধাবনে এনআরসি কমিটি হয়তো এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাতিল করবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, ‘লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ’ শিরোনামে গত ১৬ আগস্ট একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)। মূলত পছন্দের প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করতেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আবার চাকরিবিধি অনুসারেও ওই প্রার্থীর বয়স নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ফলে দেশের একমাত্র সরকারি চা কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছে অন্যান্য চাকরিপ্রত্যাশীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ৮ জুন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের চা বাগান ও কারখানা পর্যায়ে কমপক্ষে ২০ বছর এবং মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে তিন বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা যোগ্যতার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া প্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতক বা ডিগ্রি পাশ এবং বয়স অনুর্ধ্ব ৫২ বছর হতে হবে বলে জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ৭ জুলাইয়ের মধ্যে প্রার্থীদের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসসহ আবেদন পত্র জমা দিতে হবে। যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীদের লিখিত ও ভাইভা (মৌখিক) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নিয়োগপ্রার্থী। এদের একজন মৌলভীবাজার উপজেলাধীন রাজনগর চা বাগানের এজিএম মো. মহসিন জানান, বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়, সেখানে ন্যাশনাল টির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করায় সবাই হতবাক।
তাছাড়া যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে শুনেছি, তিনি কখনো বাগানে কাজ করেননি। কারখানার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ছিলেন। ফলে বাগানের নিত্যকার কার্যাবলী সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নয়, এটাই প্রতীয়মান হয়।
ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে বর্তমানে চাকরিরত এবং ডিএমডি পদের আরেক নিয়োগ প্রার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, মৌখিক (ভাইভা) সাক্ষাৎকার সাধারণত কোনো কার্যকরী নিয়োগ পরীক্ষা নয়। কারণ, এখানে একজন প্রার্থীকে ইচ্ছে করলেই সহজ প্রশ্ন বা কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রার্থী যদি আগেই নির্দিষ্ট করা থাকে তাহলে তাকে সহজ প্রশ্নের মাধ্যমেই উত্তীর্ণ করানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী মোহাম্মাদ মুসা জানান ভিন্ন কথা। অন্যান্য প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা না হলেও এই প্রার্থীর জন্য আলাদাভাবে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
তবে লিখিত পরীক্ষায় তিনি কত নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং তার পরের প্রার্থীদেরও কে কত নম্বর পেয়ে তার পেছনে রয়েছেন সে বিষয়েও কিছুই জানাতে পারেননি। এদিকে চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রার্থীকে শুধু আলাদাভাবে লিখিত পরীক্ষাই নয়, তার বয়সের ক্ষেত্রেও বিশাল ছাড় দিয়েছে ন্যাশনাল টি কর্তৃপক্ষ, এমন অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অনুসারে একজন সরকারি কর্মচারী ৫৯ বছরে অবসর গ্রহণ করবেন।
এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ মুসা নামে ওই প্রার্থীর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি ১৯৬৪ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুসারে বর্তমানে (এই প্রতিবেদন লেখার সময়) তার বয়স চলছে প্রায় ৫৭ বছর ৯ মাস। আইন অনুসারে তিনি আর এক বছর তিন মাস চাকরি করার উপযুক্ত। সাধারণত এ পদে একজন কর্মকর্তার নিয়োগ কমপক্ষে দুই বছরের চুক্তিতে হয়ে থাকে। সে হিসেবেও তাকে নিয়োগ করা হলে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত আরও সাত মাস তাকে চাকরি করতে হবে।’
তবে সমস্যা কিংবা সন্দেহ কোম্পানির উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। যেখানে কখনোই মোহাম্মদ মুসা বাগানে কাজ করেননি এবং মাঠ পর্যায়ে, অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে কাজ করা অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে কারখানার গ্রুপ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করে বাগানের নিত্যকার কার্যাবলী সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা নয়। এতে বাগানের উন্নয়ন বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রতীয়মান হয়।
অথচ প্রাথমিক বাছাইয়ের পর নির্বাচিত ৬ নিয়োগপ্রার্থীর মধ্যে এমন প্রার্থীও ছিলেন যাদের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার এখনো ৬-১০ বছর বাকি। শুধু তাই নয়-রয়েছে বাগানের উন্নয়ন বিষয়ক ধারণা ও পূর্ব অভিজ্ঞতা। এরপরও জেনেশুনে কারখানার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কর্মরত মোহাম্মদ মূসার মতো এমন প্রার্থীকেই ডিএমডি পদে নিয়োগ দেয়ায় ন্যাশনাল টি কর্তৃপক্ষের অসদুদ্দেশ্য রয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাছাড়া অবসরের মাত্র এক বছর পূর্বেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে যোগদানের বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত দীর্ঘদিন কাজ করার পর অবসরের মাত্র বছর খানেক আগে কেউ চাকরি ছাড়েন না, যদি না প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে ছাঁটাই করা হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমডি পদের জন্য নির্বাচিত মোহাম্মদ মুসা ফিনলে চা কোম্পানিতে অদক্ষতার কারণে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) পদে পদোন্নতি পাননি। এর পরিবর্তে তারই এক সময়কার অধস্তন তাহসিন আহমেদ চৌধুরী ওই পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
Posted ১২:৫৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy