বিবিএনিউজ.নেট | শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | প্রিন্ট | 599 বার পঠিত
দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গত এক দশকে বিদ্যুৎ, যোগাযোগসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে । এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই বৈদেশিক ঋণনির্ভর। ফলে এ সময়ে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এসব ঋণের বড় অংশই দীর্ঘমেয়াদি। তবে বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই দ্বিপক্ষীয়। ফলে উচ্চ সুদ ও কঠিন শর্তের এসব ঋণের বিপরীতে সুদ ব্যয়ও গত ১০ বছরে তিনগুণ বেড়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট স্ট্যাটিক্স ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এক দশকের ঋণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব প্রকল্প থেকে রিটার্ন বেশি আসবে, তাতে বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করলে লাভবান হবে বাংলাদেশ। তবে বাছবিচার না করে ও সময়োপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও অতিব্যয়ের প্রকল্পে এসব ঋণ ব্যবহার করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। এ ঋণ পরিশোধ আগামীতে দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৪০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১০ বছর পর ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে পাঁচ হাজার ২১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, এক দশকে বৈদেশিক ঋণ প্রায় সোয়া দুইগুণ হয়েছে।
এক দশকের বৈদেশিক ঋণচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩০০ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৬৩০ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে ছিল তিন হাজার ৮৮২ কোটি ৩০ লাখ ডলার ও ২০১৭ সালে চার হাজার ৭১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২০১৭ সালে। সে বছর এর পরিমাণ বাড়ে ৮৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর ২০১৮ সালে বেড়েছে ৪৯৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
পরিমাণ বেশি ও কম সুদ হওয়ায় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করতে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে বিভিন্ন দেশ। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে এসব ঋণের অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি খাতেই বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮ সালে বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ ছিল দাতা সংস্থার। সে সময় এর অনুপাত ছিল ৭৪ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে হয়েছে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৮ সালে দ্বিপক্ষীয় ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যার পরিমাণ বর্তমানে ৫২ শতাংশ। এক দশক আগে এর পরিমাণ ছিল ২৬ শতাংশ। আর ২০০৮ সালে রিজার্ভ ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ছিল ২৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬০ শতাংশ।
এদিকে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৫৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়েছে।
এর বিপরীতে ১০ বছরে ঋণের সুদ ও আসল বাবদ বাংলাদেশের ব্যয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আসল বা মূল অর্থ পরিশোধ করেছিল ৬৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ২০০৮ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ ১০ বছরে সুদ ব্যয় সাড়ে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরদিকে ২০০৮ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৮ সাল শেষে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০৩ কোটি ১০ লাখ ডলার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা ঠিক যে, আমাদের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে বিবেচনায় নিলে তা এখনও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু অবিবেচনাপ্রসূত প্রকল্পে ঋণ যাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। এতে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তা পরিশোধে সমস্যার সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের কিছু প্রকল্প আছে, যা সময়ের বিবেচনায় ব্যয়বহুল। কিন্তু এসব প্রকল্প থেকে ব্যয়ের তুলনায় রিটার্ন কম। যেমন, ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এ থেকে আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাব, তার চেয়ে কিন্তু অনেক বেশি হারে খরচ করছি। এখনই এ প্রকল্পে কিন্তু খরচ শুরু হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি কিছু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, যার ব্যয় তুলনামূলক বেশি। এসব প্রকল্প আমাদের কতটুকু উপকার করতে পারবে। এখানে বিনিয়োগ করে রিটার্ন কম আসবে। সেক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধে সরকারকে সমস্যায় পড়তে হবে।
তিনি আরও বলেন, সময়ের বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প নিলে রাষ্ট্র লাভবান হবে। শুধু খরচ করলেই হবে না, কোনো প্রকল্পের রিটার্নও বিবেচনায় নিতে হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের চেয়ে পদ্মায় রেল সেতু নির্মাণের ব্যয় বেশি। যদিও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ২১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার বলা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে; কিন্তু এটি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের কমিটমেন্ট। কিন্তু অর্থছাড় ও ঋণের পরিমাণ হিসাব করলে তা চার হাজার কোটি ডলারের ঘরেই থাকবে বলে জানান তিনি।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এক দশকে দ্বিপক্ষীয় ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ঋণ ছিল ২৯৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৬৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, এক দশকে এ ঋণ বেড়েছে ৮৭০ কোটি ডলার বা ২৯২ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালেই দ্বিপক্ষীয় ঋণ বেড়েছে ৩৮৬ কোটি ডলার। এছাড়া ২০১৭ সালে দ্বিপক্ষীয় ঋণ বাড়ে ২৩৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে ৮০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ও ২০১৫ সালে ১৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বিপক্ষীয় ঋণ বৃদ্ধির মূল উৎস তিনটি। প্রথমত. ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণ (এলওসি), দ্বিতীয়ত. চীনের ঋণ ও তৃতীয়ত. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণ। তবে ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি অনেক ধীর। এছাড়া চীনের ঋণও তুলনামূলক ধীরগতিতেই ছাড় হচ্ছে। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার ঋণ দ্রুত ছাড় হচ্ছে। এতে আগামী কয়েক বছরে দ্বিপক্ষীয় ঋণ আরও কয়েকগুণ হবে বলে মনে করছেন তারা।
Posted ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed