শুক্রবার ২৮ জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অডিটর হুদাভাসি চৌধুরি অ্যান্ড কোং’র উদ্বেগ

ক্রমাগত লোকসান ও ব্যাংক ঋণে জর্জরিত ন্যাশনাল টি কোম্পানি

আজাদুর রহমান   |   মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   320 বার পঠিত

ক্রমাগত লোকসান ও ব্যাংক ঋণে জর্জরিত ন্যাশনাল টি কোম্পানি

নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ক্রমাগত লোকসানে পড়ছে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য দায়ের পরিমাণ সম্পদের তুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে গড়িমসি, নতুন পণ্য বৈচিত্র্যকরণে ব্যর্থতা, মেশিনারিজ স্থাপনে অদক্ষতা, উৎপাদন হ্রাস, ব্যাংক ঋণের দায় মেটাতে অক্ষমতা, ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চায়ের গুণগতমানের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

সূত্র মতে, ন্যাশনাল টি কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকে (৩১ মার্চ ২০২৩) দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা মোট সম্পদ থেকে প্রায় ৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বেশি। শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) ৪৮ টাকা ৭৯ পয়সা থেকে অস্বাভাবিকভাবে কমে ২ টাকা ২ পয়সায় নেমে এসেছে। শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৪৬ টাকা ২ পয়সা। যা আগের বছর শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৩১ টাকা ১২ পয়সা। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হ্রাস পেয়েছে ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা। যা একই সময়ে আগের বছর ছিল ঋণাত্মক ১২ পয়সা। শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ তুলনামূলক হ্রাস পেয়েছে ৩৪৭.০২ শতাংশ। বিনিয়োগকারীদের মতে, হঠাৎ এনওসিএফপিএস এতো বেশি হ্রাস পাওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের জ্ঞাতার্থে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড ২০১৮ এর শর্ত ১(৫)(রী) অনুযায়ী ডিসক্লোজার দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সেটা পালন করেনি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, সম্পদের তুলনায় দায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি, শেয়ারপ্রতি আয় ঋণাত্মক, অতিরিক্ত ঋণ ও শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধে অক্ষমতায় যে কোন সময় দেউলিয়া হতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। এরকম ধারাবাহিক অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করার অনুমোদন পায় তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ন্যাশনাল টি কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত লোকসানের তথ্য গোপনের বিষয়ে অভিমত উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির বহিঃনিরিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট লোকসান দেখিয়েছে ২২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকৃত লোকসান ছিল ৫৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বহিঃনিরিক্ষক মেসার্স হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অভিমত ব্যক্ত করেন, সমাপ্ত অর্থবছর ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ছিলো ৩৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। যা পরিশোধ করা হয়নি এবং পরিশোধের জন্য কোন প্রভিশন রাখেনি।

এছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এখানেও শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা আমলে নেওয়া বা প্রভিশন রাখা হয়নি। বকেয়া বেতন আমলে নেওয়া হলে নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াতো ৬৫ কোটি টাকার উপরে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, ন্যাশনাল টি কোম্পানির প্রতিটি প্লেসমেন্ট শেয়ার দশ টাকা অভিহিত মূল্যের সাথে ১০৯.৫৩ টাকা প্রিমিয়াম নেয়ার লক্ষ্যে কৌশলে প্রকৃত লোকসানের পরিমাণ গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) কেরামত আলী ও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সুকৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু সম্পন্ন করতে চেয়েছিলো। প্রকৃত সত্য গোপন করে মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডারদের নিঃস্ব করা লক্ষ্যে এ কাজটি করা হয়েছে। কিন্ত বহিঃনিরিক্ষক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তাদের মতামতে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেন। শুধু প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ও কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য স্ফিত দেখানোর লক্ষে ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এই অপকৌশলের আশ্রয় নেয়।

 

এছাড়া, ন্যাশনাল টি কোম্পানির বহিঃনিরিক্ষক তারল্য সংকট হেডে অ্যাম্পেসিস অব ম্যাটারে কোম্পানির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া তারল্য সংকট সর্বশেষ ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ৩০ জুন ২০২১ সালে যেখানে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ ছিল ঋণাত্মক ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, সেখানে ৩০ জুন ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২৩ টাকা ৫২ পয়সা এবং সর্বশেষ ৩১ মার্চ ২০২৩ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা। স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটির বহিঃনিরিক্ষক তার প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ধারাবাহিকভাবে তারল্য সংকট চলতে থাকলে শেয়ারহোল্ডারর্স ইকুইটি এন্ড লায়াবিলিটিজ, নন কারেন্ট লায়াবিলিটিজ ও কারেন্ট লায়াবিলিটিজের জন্য দায় দেনা পরিশোধ করা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। বহিঃনিরিক্ষক আদার অপিনিয়ন হেডে উল্লেখ করেন, ‘লোকসানের এই ধারা অব্যাহত থাকলে কোম্পানিকে অবসায়ন অথবা চা বাগানসহ সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প উপায় থাকবে না’।

ধারাবাহিক লোকসানের বিষয়ে এক বিনিয়োগকারী জানান, এনটিসির অদূরদর্শী ও দায়সারা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কারণে ক্রমাগত লোকসান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারসাজির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে প্রতিষ্ঠানের ভিতরের কিছু লোকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের সহযোগিতায় প্রকৃত তথ্য গোপন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ফলে কোম্পানিটিতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর পুঁজি আটকে যায়। প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু অনুমোদন এবং প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের উল্লস্ফন দেখে আকৃষ্ট হয়ে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। হঠাৎ সেই প্লেসমেন্ট স্থগিতে হাইকোর্টের রিটের সংবাদে শেয়ারের দাম তলানিতে নেমে যায়। এতে পুঁজি আটকে বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। আরেক বিনিয়োগকারী গোলাম ফারুক জানান, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে বিএসইসি থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ারের অনুমোদন নেয় প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর ধারা ১৫২ (১) (ক) লঙ্ঘন করে প্লেসমেন্ট শেয়ারের আবেদন বিএসইসি থেকে অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার অভিয়োগ রয়েছে কোম্পানির বিরুদ্ধে।

পরবর্তীতে বিষয়টি আমলে এনে জাকির হোসেন সরকার নামে এক বিনিয়োগকারী হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। জনসম্মুখে উঠে আসে ন্যাশনাল টি কোম্পানির অনিয়মতান্ত্রিক প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু আবেদন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি। হাইকোর্টের দৈত বেঞ্চের নির্দেশে বিএসইসি স্থগিত করতে বাধ্য হয় প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু প্রক্রিয়া। তিনি আরো বলেন, এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যথাযথ উদ্যোগ না নিলে প্রতিনিয়তই ক্ষতির সম্মুখীন হবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। এর প্রভাবে আরো তারল্য সংকটে পড়বে পুঁজিবাজার। তিনি দাবি করেন, যাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে হঠাৎ প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু স্থগিত হয় ও যারা কারসাজি করে এনটিসির শেয়ারে ফায়দা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

এদিকে এনটিসির তৃতীয় প্রান্তিক মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী ব্যাংক ঋণের (নন কারেন্ট পোরশান) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা ও স্বল্পমেয়াদী ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। কারেন্ট ও নন কারেন্ট পোরশানে সর্বমোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৯ কোটি ২৮ লাখ টাকার উপরে। এই সমস্ত ঋণ নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কৃষি ব্যাংক থেকে ন্যাশনাল টি কোম্পানির অনুকূলে ৩৪৩ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০৬ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এখন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে বাকি ৩৭ কোটি টাকা দিলেও বাগান পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এর সাথে অতিরিক্ত ৪৩ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের জন্য জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এই ৪৩ কোটি টাকা কৃষি ব্যাংক অনুমোদন করলে এনটিসির নিকট ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮৬ কোটি টাকা। সুদ-আসলে যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০০ কোটির ঊর্ধ্বে। এ দায় এনটিসির মোট সম্পদের তুলনায় অনেক বেশি।

এ বিষয়ে কৃষি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম খানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এক মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্যারের নির্দেশে সিলেটের কয়েকটি চা বাগানের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শন করে এসেছি। এনটিসির বাগানগুলো পর্যায়েক্রমে পরিদর্শন করা হবে। নতুন ঋণ ছাড়ের পূর্বে বাগান পরিদর্শনের তথ্য-উপাত্ত ও কোম্পানির সক্ষমতা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার অনিয়ম হবে না’।

এ সকল অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে এনটিসির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুসার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। আপনি কোম্পানি সচিব গোলাম মোহাম্মদ বেলালের সাথে যোগাযোগ করেন’। কোম্পানি সচিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোম্পানির আর্থিক দূরাবস্থার কথা স্বীকার করে বিস্তারিত জানার জন্য কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা কেরামত আলীর সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু কেরামত আলীর সাথে মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি। পরবর্তীতে বিষয়বস্তু উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।